অতঃপর হুমায়ূন আহমেদ

হুমায়ূন আহমেদফাইল ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম

হুমায়ূন আহমেদ ভক্তপাঠকের ভালো লাগার জায়গায় চিরস্থায়ী আসন পেয়ে গেছেন বললে ভুল বলা হবে না। তাঁর পাঠকেরা শুধু লেখা নয় লেখক হুমায়ূন আহমেদকেও এমন আসনে বসিয়েছেন যা ব্যাখ্যা করা বা বোঝানো কঠিন। এ বিষয়ে আমার সামান্য অভিজ্ঞতা বর্ণনা করছি।

বেশ কিছুদিন আগে মেলবোর্নের আবৃত্তি সংগঠন ‘কবিতায়ন’–এর অনুষ্ঠানে কবিতা পড়ার দাওয়াত পাই। অনুষ্ঠানে মেলবোর্নে বাংলা সাহিত্য সংসদের আমন্ত্রিত অতিথি লেখক নবকুমার বসু (লেখক সমরেস বসুর সন্তান) উপস্থিত ছিলেন।

অভিনবত্ব ছিল উপস্থাপনায়। যেমন—প্রত্যেকেই অল্পকথায় সেই বিশেষ কবিতা বিষয়ে নিজস্ব সংস্কৃতি বিজড়িত অনুভূতি বা উপলব্ধির কথা বর্ণনা করে তবেই কবিতা পড়তে বা আবৃত্তি করতে শুরু করছিলেন।

গুলতেকিন খানের কবিতার বই ‘আজো, কেউ হাঁটে অবিরাম’ সবে মাত্র হাতে পেয়েছি। ভালো লাগল কবিতাগুলো। আমি ওই বই থেকে পড়ার জন্য বেছে নেই ‘সাতকাহন’ শিরোনামের ছোট একটি কবিতা।

কবিতাটি পড়ে আমার উপলব্ধি—এ কবিতায় যেন কবির জীবন বিবৃত হয়েছে এবং তা উল্লেখও করলাম। মাত্র ১২পংক্তিতে ৫৭ শব্দে কি অসাধারণ কাহিনী বর্ণিত।

ওই কবিতা পাঠের কারণে আমি অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়লাম। হুমায়ূন আহমেদের প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসা থেকেই কেউ বললেন, এটি কেন পড়ার জন্য বেছে নিলাম? অন্য আরেকজনের তাচ্ছিল্যভরা মত ‘ওহ্ গুলতেকিন খানতো ছন্দ মিলিয়ে লিখেন’ (ভাবটা এমন যে ওগুলোতো পদ্য!)।

একজন মহা বিরক্তি নিয়ে বললেন, ‘গুলতেকিন খান অত্যন্ত সচ্ছল পরিবারের মেয়ে; উনার উচিতই হয়নি হুমায়ূন আহমেদের মতো সাধারণ মানুষকে বিয়ে করা!’

আমি বিভ্রান্তিতে পড়লাম। প্রথমতঃ ভাবলাম আমি কি কবিতা আদৌ বুঝি না? দ্বিতীয়তঃ ধনী কবি বলেই কি গুলতেকিন খানের কবিতা পড়া হলো?

আসল কথা হলো এরা সবাই হুমায়ূন আহমেদের অন্ধভক্ত। গুলতেকিন খান ধনী পরিবার থেকে এসেছেন এ কথা হুমায়ূন আহমেদও তাঁর ভাই লেখক অধ্যাপক জাফর ইকবালের লেখা থেকে আমরা সবাই বহু আগেই জেনে গেছি। গুলতেকিনের গল্প হুমায়ূন আহমেদ বলতে শুরু করেছিলেন বাসর রাতের ঘটনা দিয়ে। সেই যে ম্যাজিক দেখিয়ে নববধুকে চমকে দিতে চেয়েছিলেন। ম্যাজিক রহস্য ধরতে পেরে লেখকের বালিকা বধু হেসে কুটিকুটি।

হুমায়ূন আহমেদ কবিতা খুব একটা লিখেন নি অথবা আমি হুমায়ূন আহমেদের বেশী কিছু পড়িনি তাই হয়তো তেমন ভালো করে জানি না। তবে হুমায়ূন আহমেদ কবিতা পছন্দ করতেন, কবিদের সম্মানের বিষয়ে সচেতন ছিলেন। তাঁর অন্যতম উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি ‘শঙ্খনীল কারাগার’ উপন্যাসটির নামকরণ করেন কবি রফিক কায়সারের কবিতার নামে। হুমায়ূন আহমেদের একটি কবিতার কথা মনে পড়ছে ‘আজন্ম সলজ্জ সাধ.....’।

তো আমি যখন আমার কবিতা যাচাইবাছাই বিষয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছি তখনই এক স্বনামধন্য জ্যেষ্ঠ কবির সাক্ষাত পেলাম। ওই কবিও আমাদের বাসাস (বাংলা সাহিত্য সংসদ) মেলবোর্নের আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন। কবি আসাদ চৌধুরী। ছিলেন ক'দিন আমাদের সাথে ঘরোয়া আতিথ্যে। আসাদ চৌধুরীর মন্তব্য শুনলাম ‘গুলতেকিন ভালো কবিতা লিখে’।

হুমায়ূন আহমেদ একদা কোন এক লেখায় (সম্ভবত: হুমায়ূন আহমেদের ‘আমি’ বইতে পড়েছি) বলেছিলেন বা লিখেছিলেন, ‘একজন কবি যাচ্ছেন উঠে দাড়াও’।

কবিদের বিষয়ে যাঁর এমন গভীর সম্মানবোধ আজ উঁনি বেঁচে থাকলে গুলতেকিন খানের কবিতা তাঁকে অবশ্যই ভাবাতো।

এই প্রসঙ্গে আরও একটি তথ্য হুমায়ূন আহমেদের নাটক ‘দ্বিতীয় জন’ বিষয়ে। টিভিতে নাটকটি অভিনীত হয়। হুমায়ূন ফরিদী ও সুবর্ণা মোস্তফার অসাধারণ চরিত্রচিত্রণ মন থেকে মোছে যাবে না কখনো।

দূর পরবাস-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

লেখক হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর পরে কলকাতাতে ‘হুইলচেয়ার’ শিরোনামে একটি স্টেজ ড্রামা দারুন প্রশংসিত হয়। ভারতের ‘দেশ’ পত্রিকায় নাটকের আলোচনা পড়েই মনে হলো এই ‘হুইলচেয়ার’ নাটক ও আমাদের লেখকের নাটক ‘দ্বিতীয় জন’ হুবহু এক।

আলোচনা পড়ার পর পরই আমি আমার পর্যবেক্ষণ বিষয়ে ‘দেশ’ পত্রিকা বা সাময়িকীতে একটি চিঠি লিখি। ‘দেশ’এ চিঠিটি প্রকাশিত হয়েছিল। এ জন্যে ‘দেশ’কে জানাই আন্তরিক কৃতজ্ঞতা।

চিঠিটি তুলে দিলাম।

প্রসঙ্গ নাটক ‘হুইলচেয়ার’

গত ২সেপ্টেম্বর ২০১৮ সংখ্যা দেশ–এ সুবোধ ঘোষ আলোচিত নির্বাক অভিনয় একাডেমির ‘হুইলচেয়ার’ (রচনা ও পরিচালনা সুরঞ্জনা দাসগুপ্ত) নাটকটির কাহিনী  বিষয়ে এই পত্রের অবতারণা।

বাংলাদেশের জনপ্রিয় লেখক প্রয়াত হূমায়ুন আহমেদের নাটক ‘দ্বিতীয় জন’ ঢাকা টিভিতে প্রচারিত হয় বেশ আগে। মাত্র ৪২:৩০ সেকেন্ডের নাটক। এ নাটকে অভিনয় করেছিলেন শক্তিশালী অভিনেতা প্রয়াত হুমায়ুন ফরিদী ও আজও জনপ্রিয় অভিনেত্রী  সুবর্ণা মোস্তফা। চারটি মাত্র চরিত্র নিয়ে নাটক। পরিচালনায় স্বয়ং হূমায়ুন  আহমেদ।  বিস্মিত হই  জেনে যে দুই নাটকের কাহিনী এক। একটি বাংলাদেশের  টিভি নাটক  অন্যটি কলকাতার সাম্প্রতিক মঞ্চ নাটক।

‘দ্বিতীয় জন’ নাটকের নায়িকা কর্মজীবী মেয়ে জরী ১০ বছর ধরে হুইলচেয়ার বাউন্ড স্বামীকে নিয়ে যাপিত জীবনে শেষে একসময়ে মানসিক অসুস্থতায় নিপতিত হয়। সে কিছুদিনের জন্য মায়ের কাছে যাওয়ার উদ্যোগ নেয়। স্বামী বিষয়টি জেনে যায়। তখন জরী স্বামীকে তাঁর নিজস্ব সম্মোহনের (হ্যালুসিনেশন) বিষয়টি  খুলে বলে। স্বামী সব শুনে জরীকে বলেম জরী এই রোগ থেকে বাঁচাতে পারে। জরীর স্বামী নিজেই তারপরে পৃথিবী ছেড়ে চলে ষায় স্বেচ্ছায়। অপূর্ব এই নাটক যা দেশ-কাল বা সময়-স্থানকে  অবলীলায় অতিক্রম করার ক্ষমতা রাখে ।

 দুটো নাটকের কাহিনি এক, ঢাকার জরী কলকাতার নাটকে জয়িতা!

*লেখক: দিলরুবা  শাহানা, মেলবোর্ন, অষ্ট্রেলিয়া