মা–বাবাকে মনে পড়েছে
আমাদের জীবনের পরিবর্তন কিন্তু জন্মের পর থেকেই নানাভাবে নানা দিক থেকে শুরু হয়। কিছু পরিবর্তন আছে, যা জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। হতে পারে সেটি দুঃখের বা সুখের। অবশ্যই অনেক ঘটনা এ অবধি ঘটেছে যা দুঃখ-বেদনায় ভরা সত্ত্বেও হৃদয়ে দাগ ফেলতে পারেনি। তবে ছোটবেলায় বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়া এবং সেই অভিজ্ঞতা জীবনের চলমান গতির পরিবর্তন এনে দিয়েছিল। সেদিন থেকেই আমার জীবনের পরিবর্তন শুরু হয় মা–বাবার অঢেল ভালোবাসা অনুভব করতে পেরে। যে অপরাধ আমি সেদিন করেছিলাম, সেটি কোনোভাবেই ক্ষমার যোগ্য নয়। রাতের আঁধারে বাড়ি থেকে পালিয়ে ঢাকা যাওয়া এক ভয়ংকর ব্যাপার এত অল্প বয়সে! কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়েছিল যে বাড়ি ছাড়তে হবে?
লেখাপড়ার চেয়ে গান-বাজনা এবং অভিনয়ের শখ ছিল বেশি ছোটবেলা থেকেই। বয়স আর কত হবে ১৫-১৬, সপ্তাহখানেক আগে থেকেই বাহানা ধরেছি, আমি একটি হারমোনিয়াম কিনব। এ জন্য ১০ হাজার টাকা লাগবে।
মাকে বললাম, মা, কিছু টাকা লাগবে।
মা বললেন, ড্রয়ারের মধ্যে ৫০ টাকা আছে দেখ।
আমি হা হা করে হাসছি।
মা বললেন, কী হলো?
আমি বললাম, ৫০ টাকা দিয়ে তো হবে না?
মা বললেন, তাহলে নিতে হবে না যা।
মা।
কী?
ও মা।
শুধু মা মা করছিস ক্যান? কাজ করছি, বিরক্ত করিস না।
শোনো না মা।
বল শুনছি।
একটি হারমোনিয়াম কিনব।
হারমোনিয়াম কেনা চলবে না এ বাড়িতে।
ক্যান মা?
হারমোনিয়াম বাজলে বাড়িতে ফেরেস্তা আসে না।
কে বলছে এসব কথা?
কে মানে?
তুমি বাবাকে বলো, এটা আমার চাই।
তা দাম কত?
কাশেম স্যার বলছে ১০ হাজার, তবে আমার কাছে ৫ হাজার আছে। কাশেম স্যার পরিবারের বেশ পরিচিত মুখ, গ্রামীণ শিক্ষক, বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে প্রাইভেট পড়ান।
তুই এত টাকা কোথায় পেলি?
কেন জমিয়েছি, হারমোনিয়াম কিনব বলে।
আচ্ছা বলব, এখন পড়তে যা। সুযোগ পেয়ে পড়ার জন্য চাপ দিচ্ছে। কী আর করা! জোরে জোরে পড়তে শুরু করলাম সবাইকে শুনিয়ে।
পড়া শেষে রাতের খাবার খেয়ে শুয়ে আছি। বাবা খাওয়ার পর নামাজে বসেছেন।
নামাজ শেষে মা বলছেন, শুনছ?
কিছু বলবে?
হুম।
বলো?
তোমার ছেলে একটা হারমোনিয়াম কিনবে বলছে। সে নাকি কিছু জমিয়েছে, কিন্তু দাম ১০ হাজার।
ও টাকা পেল কোথায়?
বলল জমিয়েছে, তুমি ওরে সাত হাজার টাকা দিয়ে দাও।
কিন্তু...
কিন্তু কী আবার?
কিছু বোঝো না? ওটা কিনলে তো লেখাপড়া লাটে উঠবে। মাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বাবা সোজা বলে দিলেন, হারমোনিয়াম টারমোনিয়াম এ বাড়িতে চলবে না। এ নিয়ে দ্বিতীয়বার আমি কিছু শুনতে চাই না।
আমি রাতে ঘুমাতে পারলাম না। পরের দিন প্ল্যান করলাম, বাড়ি থেকে পালাব। এ বাড়িতে আর এক দিনও নয়। ইগোতে লেগেছে আমার। মা আমাকে দেখেছে, আমি বেশ সকালেই ঘুম থেকে উঠেছি, তারপরও জিজ্ঞেস করলেন,
কখন উঠলি?
একটু আগে।
মন খারাপ নাকি?
চুপচাপ রইলাম কোনো উত্তর ছাড়া।
পরের দিন রাতে টাকা-পয়সা আর মায়ের সোনা যা ছিল, সব নিয়ে ভোররাতে ঢাকার পথে রওনা দিলাম।
আমি পরিবারের ৪ নম্বর সন্তান, আমার বড় তিন ভাই। একজন উচ্চশিক্ষার্থে ইউরোপে, একজন বিএমএ ট্রেনিংরত, তৃতীয় জন সম্ভবত খুলনা বিএল কলেজে। বাকিরা আমার ছোট এবং সবাই গ্রামের বাড়িতে। সবাইকে ছেড়ে চলে যেতে কষ্ট লাগছে, তারপরও যেতে হবে। রাগ এবং জিদ দুটো মিলে আমাকে দুর্দমনীয় করে তুলেছে। পৌঁছে গেলাম ঢাকায়। এ এক নতুন জীবন। এ জীবন সম্পর্কে অতীতে লিখেছি।
বাবা পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চে চাকরি করেছেন, স্বাভাবিকভাবেই আমাকে খুঁজে বের করতে খুব একটা সমস্যা হয়নি। মা ছাড়া এক সপ্তাহ আমি যে কষ্ট পেয়েছি, আমাকে ছাড়া মা তার চেয়ে হাজার গুণ বেশি কষ্ট পেয়েছে। সন্তান হারানোর জ্বালা মা ছাড়া অন্য কেউ বুঝবে কেমন করে! ভেবেছিলাম, বাবা খুব রেগে যাবেন, বকাঝকা করবেন; কিন্তু কিছুই করলেন না; বরং ভয়ংকর রাগী বাবা এমনভাবে পরিবর্তন হতে পারেন যা আমাকে অবাক করে ছিল!
বাবা ঢাকা শহরের সব গুরুত্বপূর্ণ স্থান থেকে শুরু করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সবকিছু দেখালেন। তার আগে মাকে টেলিগ্রাম করে জানিয়ে দিলেন আমাকে পেয়েছে।
ঢাকা শহর ছেড়ে বাড়ি আসতে গ্রামের সবাই আমাকে নতুন করে দেখতে এসেছে। এক সপ্তাহে কী এমন মায়া ছড়িয়েছিল আমাকে ঘিরে? আজও তা জানি না, তবে ঘটেছিল ঘটনা, যা এখনো মনে পড়ে। বুঝেছিলাম সেদিন প্রথম, ভালোবাসা কারে কয়!
এ ঘটনার পর আমি বাংলাদেশে চার বছর থেকেছি। এসএসসি এবং এইচএসসি শেষ করে সুইডেনে পাড়ি জমিয়েছি। পরিবারের বলতে গেলে সবাইকে নানাভাবে সাহায্য করেছি প্রতিষ্ঠিত করতে। বাবা-মাকে নিয়ে বিশ্বের নানা দেশ ঘুরেছি। মজা করেছি। সুইডেনে বসবাস সত্ত্বেও আমেরিকান কোম্পানিতে চাকরি করেছি। বাবাকে নিয়ে একবার ক্যালিফোর্নিয়ায় বেড়াতে এসেছি। সেখানে আমার তিন বোনের একজন থাকে। বাবাসহ আমার সঙ্গে আমার স্ত্রী মারিয়া এবং ছেলে জনাথান। জনাথানের বয়স তখন চার বছর। লস অ্যাঞ্জেলেসের আর্টেসিয়ায় কেনাকাটা শেষে ঢুকেছি লাঞ্চ করতে। রেস্টুরেন্টে নানা ধরনের খাবার বুফে আকারে দিয়েছে। জনাথান খাওয়ার মাঝে হঠাৎ বাবাকে প্রশ্ন করল, দাদু তুমিও কি আমার বাবাকে সব জায়গা নিয়ে ঘুরেছ, যেমনটি আমার বাবা আমারে নিয়ে ঘোরে?
কথাটি শোনার পরে বাবা অবাক না হয়ে কাঁদছেন আর বলছেন—দাদু ভাই, আমি তো তোমার বাবার মতো এত বড় চাকরি করিনি, তাছাড়া বাংলাদেশ একটি গরিব দেশ, সেখান থেকে বিশ্ব ঘোরা কখনো সম্ভব নয়।
বাবার মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। মাত্র চার বছরের একটি ছেলের কথা এত সিরিয়াস নিলেন, আমি নিজেও বেশ অপ্রস্তুত, কিছুই বুঝতে পারছি না। জনাথানই বা কীভাবে হঠাৎ এমন একটি প্রশ্ন করতে পারল? এদিকে মারিয়া জনাথানকে সঙ্গে সঙ্গে বলল, দাদু তোমার বাবাকে বিশ্ব ঘুরায়নি, তবে যাতে করে তোমার বাবা নিজে এবং আমাদের সবাইকে ঘোরাতে পারে, সে ব্যবস্থা করেছেন।
জনাথান জিজ্ঞেস করল কীভাবে?
মারিয়া বলল, তোমার বাবাকে সব থেকে ভালো স্কুল, কলেজ এবং বিদেশে পড়ার সুযোগ করে দিয়েছে, যার ফলে তোমার বাবা আজ সারা বিশ্ব ঘুরছে।
মাত্র চার বছরের ছেলে মায়ের কথার সত্যতা যাচাই করতে সাথে সাথেই আমাকে জিজ্ঞেস করল, মা যা বলছে তা-কি সঠিক?
আমি বললাম হ্যাঁ বাবা, তোমার মা যা বলছে, সেটা সঠিক।
জনাথান এর মধ্যে লক্ষ করছে দাদু ভাইয়ের চোখে পানি। সে জিজ্ঞেস করছে দাদু তুমি কি দাদিকে মিস করছ? বাবা উত্তরে বললেন হ্যাঁ ভাই। (প্রসঙ্গত আমার মা তখন সুইডেনে থাকেন। আমেরিকায় আমাদের সঙ্গে আসেননি, মার শরীরটা তখন একটু খারাপ ছিল)।
মা-বাবার ভালোবাসা সম্পর্কে খুব ভালো ধারণা বাংলাদেশ থেকেই জন্মেছে।
পরে নিজে বাবা হয়েছি। জীবনের একটা সময়ে হঠাৎ নিজে অসুস্থ হয়েছিলাম। সময়ো ছিল জীবনের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে পৃথিবীর সবকিছুর ঊর্ধ্বে যাদের নিয়ে বেশি ভেবেছি, তখন তারা ছিল আমার ছেলেমেয়ে। বাবা হয়েছি সেই কারণে বাবাকে আরও বেশি ভালোবেসেছি। আমার ছেলেমেয়ের মাকে যখন দেখি, কী করে আর কী না করে জনাথান ও জেসিকার জন্য, তখন আমি আমার মাকে নিয়ে ভাবি।
সত্যিই তো মা-বাবার সব ভালোবাসা তাঁদের সন্তানদের সুখের জন্য। কিন্তু আমরা এতটাই হতভাগা যে তা বুঝি না। যখন বুঝি, তখন অনেক দেরি হয়ে যায়।
আল্লাহ যেন আমাদের সবার মা–বাবাকে সুস্থ রাখেন; এবং যাঁরা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন, আল্লাহ তাঁদের যেন বেহেশত নসিব করেন। আমিন।