পয়লা বৈশাখ এবং আমাদের গন্তব্য

বাঙালির প্রাণের উৎসব পয়লা বৈশাখ, বাংলা নববর্ষ। প্রতিবছর ১৪ এপ্রিল বাঙালিরা মহা ধুমধামে বাংলা নববর্ষ উদযাপন করে থাকেছবি: আশরাফুল আলম

কিংবদন্তি কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের প্রকাশিত সর্বশেষ গ্রন্থ ‘হিজিবিজি’। যেটার প্রচ্ছদ তিনি দেখে গিয়েছিলেন। এই গ্রন্থে লেখকের বহুমাত্রিক শিল্পীসত্তার পরিচয় পাওয়া যায়। এই গ্রন্থেরই একটা প্রবন্ধ বা গল্পের নাম ‘একজন আমেরিকানের চোখে বাংলা বর্ষবরণ উৎসব’। খুবই ছোট কলেবরের এই প্রবন্ধে একজন বিদেশির চোখে দেখা বাংলাদেশের বর্ষবরণ উৎসবের পাশাপাশি বাংলাদেশের মানুষের সামগ্রিক মূল্যবোধের এক নিপুণ চিত্র আঁকা হয়েছে। শুরুতেই বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান তুলে ধরা হয়েছে, ‘এই ক্ষুদ্র দেশটির অবস্থান ভারতের পূর্বে। দেশটির দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, উত্তরে হিমালয় পর্বতমালা। ট্রপিক্যাল জোনের বেনানা বেল্টে এর অবস্থান।’

এরপর এসেছে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক প্রসঙ্গ, ‘বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এই দেশের জনগোষ্ঠীর ৯০ শতাংশই দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। দারিদ্র্যের সঙ্গে দুর্নীতি সম্পর্কযুক্ত। দুর্নীতিতে শীর্ষ সূত্রে প্রায় প্রতিবারই এই দেশের নাম আসে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে (বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, খরা) আছে মানুষের সৃষ্ট দুর্যোগ। যেমন জঙ্গি মৌলবাদ। এরা দেশে ইসলামি শাসন কায়েম করতে চায়। এই উদ্দেশ্যে প্রায়ই তারা বোমাবাজি করে। দেশটিতে আমেরিকার মতোই প্রধান দুটি দল। পরস্পরের প্রতি এদের আচরণ অত্যন্ত বিদ্বেষপূর্ণ। যে দল ক্ষমতায় থাকে না, তার প্রধান লক্ষ্য থাকে হরতাল দিয়ে দেশকে অচল করে দেওয়া। হরতাল মানেই দোকানপাট, গাড়ি ভাঙচুর।’

এমন বেশ কিছু বর্ণনার পর বিদেশি ভদ্রলোক বাংলাদেশের ঢাকা শহরের মানুষের পয়লা বৈশাখ উদ্‌যাপনের এক বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছেন। অবশ্য তিনি এটা বলতেও ভুল করেননি, ‘এই দেশটিতে সরকারিভাবে কিংবা কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই বাংলা ক্যালেন্ডার অনুসরণ করা হয় না। এই ক্যালেন্ডারের ব্যবহার বিভিন্ন উৎসবের দিন নির্ধারণে। বাংলা ক্যালেন্ডারে নববর্ষ হলো বৈশাখের প্রথম দিন। গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে এপ্রিলের ১৪ তারিখ।’ পয়লা বৈশাখের আবহাওয়ার বর্ণনাও দেওয়া হয়েছে, ‘দিনটি ছিল অসম্ভব গরম। তাপমাত্রা ৩৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সূর্যের প্রখর উত্তাপ।’

তিনি বনানী থেকে একটা রিকশা নিয়ে শহর কেন্দ্রের দিকে যাচ্ছিলেন। প্রতিটি রিকশার পেছনের বহুবর্ণ পেইন্টিংও তাঁর দৃষ্টি এড়ায়নি। এরপর তিনি বাংলাদেশের মানুষের মনস্তত্ত্বের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁর মতে, ‘বাংলাদেশের সবাই হাসিখুশি। আন্তর্জাতিক একটি জরিপে বাংলাদেশ বিশ্বের সুখী দেশ হিসেবে শীর্ষ অবস্থানে স্থান করে নিয়েছে।’ রিকশাচালক হাসিখুশি যুবক হামিদ এরপর তাঁকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন উৎসবের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। হামিদের ভাষায়, ‘সূর্য ওঠার আগে আমাদের অনুষ্ঠান শুরু হয়। রমনা বটমূলে। কী সুন্দর গান যে হয়! গান শুনলে চোখে পানি আসে।’

পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে জেলা প্রশাসনের আয়োজনে শহরে বের করা হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। মুজিব সড়ক এলাকা, সদর উপজেলা, ফরিদপুর, ১৪ এপ্রিল
ছবি: আলীমুজ্জামান

ইলিশ মাছ ভাজা দিয়ে এরপর পান্তা খাওয়ার কথা এসেছে। এসেছে পোশাকের কথা। ফাল্গুন মাসের ১ তারিখে মেয়েদের পরতে হয় হলুদ শাড়ি। আর পয়লা বৈশাখে পরতে হয় লাল শাড়ি। এরপর শাড়ি বিষয়ে বলা হয়েছে, ‘শাড়ি বাংলাদেশের মেয়েদের প্রধান পোশাক। এটা ছয় গজ লম্বা ও সোয়া গজ প্রস্থের একখণ্ড বর্ণিল বস্তু।’ এরপর এসেছে মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রসঙ্গ। সেটাকে তিনি ব্রাজিলের সাম্বা উৎসবের শোভাযাত্রার সঙ্গে তুলনা করেছেন। মঙ্গল শোভাযাত্রাতে সবাই মুখোশ পরে উদ্দাম মিছিল করে। পয়লা বৈশাখের উৎসবে মেয়েদের কাচের চুড়ি কেনা নাকি বাধ্যতামূলক।

এরপর রিকশাচালক হামিদ নিজের টাকায় তাঁকে পান্তা ইলিশ খাওয়ান। এটাতে আমাদের চিরায়ত অতিথিপরায়ণতার দিকটি ফুটে উঠেছে। এরপর তিনি তাঁর অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন এভাবে, ‘আমি আমেরিকান। আমেরিকানরা আবেগশূন্য না। তবে আবেগে আমেরিকানদের চোখ কখনো ভিজে ওঠে না। আমি লক্ষ করছি, আবেগে আমার চোখ ভিজে উঠছে। যে দেশের মানুষ দুঃখ-কষ্ট-হতাশা-বঞ্চনা একপাশে ফেলে আনন্দে মেতে উঠতে পারে, সে দেশের মানুষ অনেক দূর যাবে তা বলাই বাহুল্য। থ্রি চিয়ারস ফর দেম! হিপ হিপ হুররে!’

এ তো গেল একজন বিদেশির চোখে দেখা আমাদের বর্ষবরণ উৎসবের বর্ণনা। এবার আসি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বিষয়ে। টেলিকম কোম্পানিতে চাকরির সুবাদে দেশের প্রায় সব কটি জেলা ঘুরে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। তখন দেখেছি বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ ঠিক কতটা পরিশ্রমী। খাতা–কলমে আমরা দুর্নীতিতে শীর্ষে। এই দুর্নীতির সঙ্গে সাধারণ মানুষের কোনো যোগ নেই। কারণ, একজন কৃষক যদি তাঁর কৃষিকাজে ফাঁকি দেন, তাহলে তিনি কোনো দিনই কাঙ্ক্ষিত ফসল পাবেন না। একজন শ্রমিক কাজ না করলে তার পরিবার সেদিন না খেয়ে থাকবে। একজন প্রবাসী হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে তাঁর উপার্জনের পুরোটাই দেশে পাঠিয়ে দেন। আমার মতে, বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল ভিত্তি হচ্ছেন এসব খেটে খাওয়া মানুষ।

আর উৎসব পালনের বিষয়টাও খুবই অনুপ্রেণাদায়ী। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ অতি সামান্যতেই আনন্দিত বোধ করেন। জীবনের মৌলিক প্রয়োজনগুলোর কোনো কিছুই ঠিকঠাক না পাওয়া মানুষগুলো যখন কোনো কিছু পেয়ে যান, তখন তাঁদের খুশিটা হয় দেখার মতো। তাঁরা বিশ্বাস করেন অদৃষ্টে। তাঁরা তাঁদের সব না পাওয়ার দায় চাপিয়ে দেন সৃষ্টিকর্তার ওপর। ওপরওয়ালা চান নাই বলেই আমি এটা পেলাম না। আসলে আমার ভাগ্যে নেই জিনিসটা তাহলে পাব কীভাবে। এমন মনস্তত্ত্ব যাঁদের, তাঁদের আপনি শত বাধা দিয়েও আটকে রাখতে পারবেন না। উৎসবের দিনে সামান্য একটু ভালো খাবার, সস্তার একটা পোশাক তাঁদের অপরিমেয় আনন্দ দেয়। সামান্য একটা মাটির পুতুলও যেন তাদের কাছে সাত রাজার ধন।

বাংলাদেশের শিক্ষিত, শহুরে, সংস্কৃতিমনা মানুষ কখনোই এই দেশটাকে নিজের মনে করে না। এরা দেশের সাধারণ মানুষের দেওয়া ট্যাক্সের টাকায় পড়াশোনা করে আরও বেশি নিরাপত্তার আশায় বিদেশে পাড়ি জমায়। পাশাপাশি দেশের সব সহায়–সম্পত্তি বিক্রি করে সেই টাকাটাও সঙ্গে করে নিয়ে যায়। আর শিক্ষিত দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা দুর্নীতির টাকা হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে পাচার করে সেখানে প্রাসাদ গড়ে তোলেন। কিন্তু প্রবাসী শ্রমিকেরা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যৎসামান্য যা–ই উপার্জন করেন খেয়ে না খেয়ে তার পুরোটাই দেশে পাঠিয়ে দেন। তাই শিক্ষিত এবং দুর্নীতিবাজদের শত শত কোটি টাকা পাচারের পরও আমাদের দেশটা তলাবিহীন ঝুড়ি হয়ে যায়নি।

এরপর আছে আমাদের দুঃখী বাংলা ভাষা। দুঃখী কেন বলছি। আমরাই মনে হয় পৃথিবীর বুকে একমাত্র জাতি, যারা ভাষার জন্য বুকের তাজা রক্তে রাজপথ রঞ্জিত করেছিল। রাষ্ট্রের সব পর্যায়ে তাই মাতৃভাষা বাংলার প্রচলন হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু উপনিবেশের দাস আমাদের শিক্ষিত মানুষেরা সেটা হতে দেয়নি অত্যন্ত সচেতনভাবে। কারণ, সবকিছু যদি বাংলায় লেখা হয় তাহলে তাদের একক কর্তৃত্ব খর্ব হবে। তাদেরকে আর কেউ মানবে না। তাই এখনো আমাদের সমাজে ভুলভাল বিদেশি ভাষা বলাটাকে স্মার্টনেস ধরা হয়। শিক্ষিত মানুষের পরিবারে বাংলা ভাষার কোনো স্থান নেই। যদি কেউ বাংলায় কথা বলেন, তাকে দেওয়া হয় ‘খ্যাত’ ট্যাগ। আর যদি কেউ স্থানীয় আঞ্চলিকতায় কথা বলেন, তাহলে তাকে দেওয়া হয় ‘মূর্খ’ ট্যাগ। শিক্ষিত মানুষ তাই দিনে দিনে বাংলাটাকে ভুলে যান।

বাংলাদেশ বলি আর বাংলা ভাষায় বলি—এই দুটিকেই টিকিয়ে রেখেছেন আপামর সাধারণ মানুষ। তাঁরাই দেশটাকে নিজের মনে করেন। তাঁদের তো আর দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। তাই দেশের উৎসবগুলোও তাঁরাই টিকিয়ে রাখেন। ইদানীং শহরের মানুষের মধ্যে একটা প্রবণতা লক্ষ করলাম। গ্রামের প্রতি তাঁদের ভালোবাসা দেখানোর জন্য শহরে তারা ‘গ্রামের মিনিয়েচার’ তৈরি করে নিয়েছেন। এতে এখন আর শিকড়ের টানে শহর থেকে গ্রামে যেতে হয় না। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে তাঁরা এই মিনিয়েচার দেখিয়েই আত্মপ্রসাদে ভোগেন। এটা যে কত বড় আহাম্মকি, সেটা ন্যূনতম বোধবুদ্ধিসম্পন্ন যেকোনো মানুষের পক্ষেই অনুভব করা সম্ভব কিন্তু আমাদের শিক্ষিত মানুষ সেটা টের পান না। কারণ, তাঁরা শিক্ষিত হওয়ার পাশাপাশি জড় বস্তুতেও পরিণত হন।

যাহোক, তবু বাংলাদেশ এগিয়ে যাবেই। বিদেশি মানুষটার কণ্ঠের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে তাই বলতে ইচ্ছে করে, যে দেশের মানুষ দুঃখ-কষ্ট-হতাশা-বঞ্চনা একপাশে ফেলে আনন্দে মেতে উঠতে পারে, সে দেশের মানুষ অনেক দূর যাবেই। আমিও ব্যক্তিগতভাবে অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গেই এটা বিশ্বাস করি। আমরা যারা দেশের এবং দেশের মানুষের সমালোচনা করি, আমরা আসলে কখনোই দেশটাকে আপন মনে করি না, নিজের মনে করি না। দেশটার মালিক সাধারণ মানুষ। তাঁরাই দেশটাকে, ভাষাটাকে লালন করেন। কারণ, তাঁদেরকে দেশেই থাকতে হয়, বাংলা ভাষাতেই কথা বলতে হয়। থ্রি চিয়ারস ফর দেম! হিপ হিপ হুররে!

*দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস [email protected]