তুষার বরণ এভারল্যান্ড
নভেম্বর থেকেই কোরিয়াতে ঠান্ডা পড়া শুরু হয়। ডিসেম্বর-জানুয়ারি তীব্র শীত থাকে। এ সময় শীতের তাপমাত্রা অসহনীয়ভাবে অনুভূত হয়। আর শীত এলে খুব বেশি আগ্রহ তুষারের প্রতীক্ষায়। বৃষ্টির মতো কোনো টাপুরটুপুর শব্দ নেই। পৃথিবীতে যেন কোথাও কিছু ঘটছে না, নিঃশব্দে তাণ্ডব চালিয়ে যায় প্রকৃতি। ঝিরঝির নিঃশব্দ হালকা সাদা সাদা তুলার মতো বিন্দু গায়ে লাগালে কেমন যেন একটা শীতল পরশ অনুভূতি হয়। শীতপ্রধান দেশ ছাড়া আর কেউ এই অসাধারণ উপলব্ধিগুলো নিতে পারে না। সে এক অদ্ভুত ভয়ংকর সুন্দর!
দক্ষিণ কোরিয়াতে টানা পাঁচ দিনের নববর্ষের (সল্লাল) ছুটি চলে। কোরিয়াতে বড় বন্ধগুলোতে সাধারণত কোরীয়রা এবং বিদেশিরা ঘুরতে যেতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। কিন্তু কোরিয়াতে হঠাৎ করোনার প্রকোপ বেড়ে গিয়ে প্রতিদিনই রেকর্ডসংখ্যক সংক্রমিত হচ্ছে। তারপরও স্বাস্থ্যবিধি মেনে দর্শনীয় স্থানগুলোতে দর্শনার্থীদের ভিড় চোখে পড়ার মতো ছিল ২০২১ সালে। এভারল্যান্ডের অনেক গল্প শুনেছি। এত দিন করোনা, সময় ও সুযোগের কারণে যাওয়া হয়নি সেখানে। যদিও বাসা থেকে বাসে ২৫ মিনিটের রাস্তা। হঠাৎ কয়েকজন বন্ধু মিলে এভারল্যান্ড যাওয়ার পরিকল্পনা। তার আগের দিন সারা রাত তীব্র আকারে তুষার পড়ে। রাস্তাঘাটে শুধু তুষারের স্তর। যত দূর চোখ যায়, চারদিক ধবধবে সাদা। সাকালে চরম ঠান্ডা (-১০°) আবহাওয়া। তারপরও…গন্তব্য এভারল্যান্ড।
সেখানে টিকিটে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য সাধারণত কোরিয়ান ৫৬ হাজার উয়ন খরচ হয়। সব রাইড এর ভেতরে। কিন্তু আপনি যদি Klook–এর মাধ্যমে টিকিট আগে থেকে কিনে থাকেন বা বিসি ব্যাংক কার্ড থাকে, তাহলে আপনি একটি ছাড় পাবেন। আমরা বিসি ব্যাংক কার্ড দিয়ে ৫০ শতাংশ ছাড় পেয়েছি। যেখানে অ্যাডভেঞ্চার ম্যাজিক থেকে সবকিছু রয়েছে। স্থানটি এতটাই আকর্ষণীয় প্রতিবছর ৭০ লাখের বেশি দর্শনার্থী থিম পার্কটিতে ভ্রমণে আসেন।
এভারল্যান্ড রিসোর্ট হলো দক্ষিণ কোরিয়ার প্রথম এবং বৃহত্তম থিম পার্ক, যা ইয়ংইন শহরের অবস্থিত। এটি স্যামসাং গ্রুপ অব কোম্পানিগুলোর মালিকানাধীন পরিচালিত। এভারল্যান্ডটি পাঁচটি থিমযুক্ত অঞ্চল নিয়ে গঠিত—গ্লোবাল ফেয়ার, জু–টোপিয়া, ইউরোপিয়ান অ্যাডভেঞ্চার, ম্যাজিক ল্যান্ড এবং আমেরিকান অ্যাডভেঞ্চার। এ পার্কটিকে আগে বলা হতো ‘জায়েওন নংওয়ন’, যার অর্থ প্রাকৃতিক খামার। তার আগে ইংরেজি নাম ছিল ‘ইয়ংগিন ফার্মল্যান্ড।’
এমন একটি জগৎ, যেখানে সারা বছর ধরে উৎসব চলতে থাকে। সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে, এই শীতে চারদিকে কৃত্রিম তুষার সাজিয়ে রাখা এভারল্যান্ড বাস্তবে তুষার বরণ নিল। প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করার মতো।
প্রতিটি ঋতুর জন্য বিভিন্ন ইভেন্ট ‘টিউলিপ ফেস্টিভ্যাল’ (মার্চ-এপ্রিল) সুগন্ধি বসন্তের ঘ্রাণ। যেখানে সুন্দর টিউলিপসহ একটি নতুন বসন্তের সূচনা হয়। পূর্ণ টিউলিপবাগানসহ একটি ফুল উত্সব ঘটে। রোজ ফেস্টিভ্যাল (মে-জুন) গোলাপের ঘ্রাণে ভরা এভারল্যান্ডের রোমান্সে মুগ্ধকর পরিবেশ তৈরি হয়! দিন থেকে রাত রঙিন গোলাপের মোহনায় নিজেকে হারিয়ে যেতে ইচ্ছা করে। সামার স্প্ল্যাশ (জুন-আগস্ট) কাল্পনিক ভূতের সঙ্গে বন্ধুত্ব করার সময়। গ্রীষ্মের তাপে সেরা মুহূর্ত এভারল্যান্ডে জলে থাকার মজাই আলাদা। হ্যালোইন ও হরর নাইটস (সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবর) বিশ্বের সবচেয়ে মজার হ্যালোইন পার্টি! ভয়ংকর ভূত বন্ধুদের সঙ্গে হ্যালোইন উদ্যাপনের রোমাঞ্চের একটি ভয়ংকর অভিজ্ঞতা তৈরি করবে। ক্রিসমাস ফ্যান্টাসি (নভেম্বর-ডিসেম্বর) সুন্দর আলো আর রূপকথার বাগান! এভারল্যান্ডে উষ্ণ ও রোমান্টিক ক্রিসমাস পরিবেশ। স্নো ফেস্টিভ্যাল (জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি) তুষারময় দিনে একটি আনন্দদায়ক রেস, স্নো বাস্টার! এভারল্যান্ড স্নো ফেস্টিভ্যাল এককথায় অসাধারণ।
দূরদূরান্ত থেকে পরিবারের ছোট শিশুদের নিয়ে সময় কাটাতে প্রতিদিন থিম পার্কে ছুটে আসেন হাজারো দর্শনার্থী। কী আছে এভারল্যান্ডে? এপ্রিল, ১৯৭৬ সালে একটি একক থিম পার্ক (এভারল্যান্ড) হিসেবে খোলা হয়েছিল এটি। থিমযুক্ত এলাকা এভারল্যান্ড পাঁচটি জোনে বিভক্ত: গ্লোবাল ফেয়ার, জু–টোপিয়া, ইউরোপিয়ান অ্যাডভেঞ্চার, ম্যাজিক ল্যান্ড এবং আমেরিকান অ্যাডভেঞ্চার।
গ্লোবাল ফেয়ার
গ্লোবাল ফেয়ার জোনের মাধ্যমে পার্কে প্রবেশ করা হয়। অন্যান্য জোনের মতো গ্লোবাল ফেয়ারের সুন্দর আকর্ষণ আছে। এখানে রেস্তোরাঁ, লকার ও স্ট্রলার ভাড়ার মতো পরিষেবা প্রদানকারীর সঙ্গে অনেক দোকান আছে। এভারল্যান্ডের সবচেয়ে বড় দোকান-গ্র্যান্ড এম্পোরিয়াম এখানেও রয়েছে। কিন্তু লাইভ হলোগ্রাম থিয়েটার এখানে একটি জনপ্রিয় আকর্ষণ। ভক্তরা মঞ্চে তাদের প্রিয় কে-পপ তারকাদের হলোগ্রাম দেখতে পান। বিশাল কৃত্রিম গাছ ম্যাজিক ট্রি রয়েছে গ্লোবাল ফেয়ারে। আমার চোখে দেখা সবাই সেই গাছের সঙ্গে প্রিয়জনকে নিয়ে ছবি তুলছে। এই গাছটি ঋতুর সঙ্গে তার রূপ পরিবর্তন করে ফেলে। মস্কোর ভেনিস সেন্ট বেসিল ক্যাথেড্রালের সেন্ট মার্কস প্লাজার মতো বিখ্যাত বিশ্ব ল্যান্ডমার্কের মতো ভবনগুলোকে নকশা করা হয়েছে।
জু-টোপিয়া
জু-টোপিয়া একটি প্রাণী-থিমযুক্ত অংশ। চিড়িয়াখানা, পোনি রাইড এবং পশু শো আছে। পাখি, মেরু ভালুক, সামুদ্রিক সিংহ, পেঙ্গুইন, ভালুক, সিংহ, বাঘ, প্রাইমেট এবং আরও অনেক কিছুসহ একটি ছোট চিড়িয়াখানা রয়েছে। একটি সাফারি পরিবহনে করে দেখায় যায় টাইগার ও ভাল্লুকের মতো প্রাণীগুলোকে। দর্শনার্থীরা বাসেই বসে উপভোগ করতে পারে। আমাজন এক্সপ্রেস হলো একটি ভেলা রাইড, যেখানে বেশির ভাগ দর্শনার্থী স্প্ল্যাশ হয়। পেটিং চিড়িয়াখানা পোষা প্রাণীদের জন্য ছাগল ও ভেড়ার মতো প্রাণী সরবরাহ করে।
ইউরোপীয় অ্যাডভেঞ্চার
ইউরোপীয় অ্যাডভেঞ্চারে ইউরোপীয় শৈলীতে অনেক রেস্তোরাঁ আছে। স্থাপত্য ইউরোপীয় শৈলী অনুকরণ, একটি ট্রেন, গেমস এবং আর্কেড দ্বারা ঘেরা একটি ফুলের বাগানও রয়েছে। এখানকার একটি প্রিয় আকর্ষণ হলো মিস্ট্রি ম্যানশন, যেখানে দর্শনার্থীরা ভূতের দিকে গুলি ছুড়তে পারে। একটি বৃত্তাকার গাড়িতে চারজন পর্যন্ত বসতে পারে এবং প্রত্যেক ব্যক্তি বাইরের দিকে মুখ করে এবং একটি লেজার-ট্যাগ-টাইপ বন্দুক দিয়ে সজ্জিত। এটি এই ভুতুড়ে-বাড়ির মতো পরিবেশের মধ্য দিয়ে যায়, যেখানে আপনার কাছে ভূত, কঙ্কাল, পিশাচ এবং গুলি করার মতো ভয়ংকর কাবওয়েবি যন্ত্র রয়েছে। যেকোনো ভূতকে গুলি করা যায়, তার ওপরে একটি ছোট সবুজ আলো থাকে। যে মুহূর্তে কেউ এটিকে গুলি করে, সবুজ আলো লাল হয়ে যায় এবং সেই ব্যক্তির জন্য একটি পয়েন্ট স্কোর করা হয়। রাইডের শেষে স্ক্রিনে প্রদর্শিত হিসেবে যাঁর সর্বাধিক পয়েন্ট রয়েছে, তিনি জিতবেন।
এই পরবর্তী অঞ্চলটিকে ইউরোপীয় অ্যাডভেঞ্চার বলা হয়। কারণ, অনেকগুলো বিল্ডিং ইউরোপীয় দেখতে ডিজাইন করা হয়েছিল। প্রশ্ন ছাড়াই, এটি এভারল্যান্ডের সবচেয়ে জনপ্রিয় আকর্ষণ ‘টি এক্সপ্রেস’। ২০০৮ সালের মার্চ মাসে এই রাইড যুক্ত করা হয়েছিল। কোরিয়ার প্রথম রোলারকোস্টার, যা সম্পূর্ণ কাঠ দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। এটি সর্বোচ্চ এবং দ্রুততম কাঠের রোলারকোস্টার। সর্বোচ্চ গতিবেগ ১০৪ কিলোমিটার/ঘণ্টা। এই রোলারকোস্টারে রাইড করতে চেয়েছিলাম লাইনেও দাঁড়িয়ে ছিলাম। ওপর থেকে নিচে এতটাই ঢালু, সত্যিই ভয় পেয়ে গেলাম। সাহস দেখাতে পারলাম না। মনে হয় হেরে গেলাম। আশা করি, অন্য এক সময় সাহসিকতার পরিচয় দেব।
ম্যাজিক ল্যান্ড
ম্যাজিক ল্যান্ড হলো বিল্ডিং এবং রাইডগুলোর একটি বিস্তৃত আকারের। ঈশপের গ্রাম নামে একটি অংশ রয়েছে, যেখানে চরিত্র ও থিমগুলো প্রাথমিকভাবে ঈশপের কল্পকাহিনি থেকে আঁকা হয়েছে। একটি লগ ফ্লুম, একটি ভবিষ্যৎ উড়ন্ত রাইড এবং একটি রোবট রাইড রয়েছে। রাইডের সঙ্গে রয়েছে রেস্তোরাঁ এবং স্ট্যান্ড।
আমেরিকান অ্যাডভেঞ্চার
আমেরিকান ইতিহাস থেকে থিম পার্কের এ অংশে উপস্থাপিত হয়। এই বিভাগে একটি পশ্চিমা থিমযুক্ত রাইড রয়েছে, যার নাম ‘রোডিও’। রক ভিলে থিম হলো ১৯৫০ সালের সংগীত। পার্কের রোলারকোস্টার রোলিং এক্স-ট্রেনের কাছে লাইভ ব্যান্ড বাজানোর কারণে ডাবল রক স্পিন দর্শনার্থীদের কাছে একটি প্রধান আকর্ষণ।
স্ন্যাক বাস্টার এভারল্যান্ডে। সুস্বাদু কোরিয়ান খাবার। আমরা স্ন্যাক বাস্টারে সন্ধ্যার খাবার খেয়েছিলাম, পার্কের অনেকগুলো খাবারের মধ্যে একটি। এই সুস্বাদু খাবার মাছ দিয়ে তৈরি করা।
ভ্রমণ শীতকালে যেকোনো সপ্তাহের দিন ভালো। আপনি যদি দীর্ঘ লাইন পছন্দ না করেন এবং ঠান্ডাকে কিছু মনে না করেন। তাহলে শীতের যেকোনো সপ্তাহের দিন এভারল্যান্ডে যাওয়ার জন্য উপযুক্ত সময় হতে পারে। তবে ক্রিসমাস ও নববর্ষ ছাড়া গেলে অতিরিক্ত ভিড় এড়িয়ে চলতে পারবেন। আমরা নববর্ষের গিয়েছিলাম, তাই চরম ঠান্ডা, করোনার আতঙ্ক ও ভয় কাজ করেছে। এভারল্যান্ড একটি বিশাল জায়গা নিয়ে গঠিত। পাহাড়ি এলাকাজুড়ে বিস্তৃত, যার জন্য প্রচুর হাঁটাও হয়েছে।
আপনি যদি ডিজনিল্যান্ড খুঁজে পাওয়ার আশায় এভারল্যান্ডে যান, তাহলে আপনি হতাশ হবেন। এটি ডিজনিল্যান্ড বা ইউনিভার্সাল স্টুডিওর মতো একটি আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের চেয়ে একটি আঞ্চলিক থিম পার্কের গুণমানের কাছাকাছি অনুভব করে। চিত্তবিনোদন পার্কটি অনেক মজার সঙ্গে আশ্চর্যজনক ছিল।
* মোহাম্মদ হানিফ, লেখক