মেঘের ওপর বাড়ি: মৃত্যুঞ্জয়ী হুমায়ূন আহমেদ
বইয়ের শুরুতেই অন্যকথা নামের একটা ভূমিকা আছে। সেখানে আবার বন্ধনীর মধ্যে লেখা, ‘না পড়লেও চলবে’। কিন্তু আমার কাছে এই ছোট ভূমিকাটাকেই বইয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ বলে মনে হয়েছে। সেটা হুবহু তুলে দিচ্ছি। ‘প্রথম আলোর ঈদসংখ্যার জন্যে যখন আমি এই উপন্যাস লিখি, তখন ক্যানসার নামক জটিল ব্যাধি আমার শরীরে বাসা বেঁধেছে। এই খবরটা আমি জানি না। ক্যানসার সংসার পেতেছে কোলনে, সেখান থেকে রক্তের ভেতর দিয়ে সারা শরীরে ছড়ানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। কোনো এক অদ্ভুত কারণে আমার অবচেতন মন কি এই খবরটা পেয়েছে? আমার ধারণা পেয়েছে। যে কারণে আমি উপন্যাস ফেঁদেছি একজন মৃত মানুষের জবানিতে। উপন্যাসে এক মহিলার কথা আছে, যার হয়েছে কোলন ক্যানসার। সেই ক্যানসার ছড়িয়ে পড়েছে সারা শরীরে। বাসা বেঁধেছে লিভারে, ফুসফুসে। হঠাৎ এইসব কেন লিখলাম? জগৎ অতি রহস্যময়।’
‘আমরা কোথা থেকে এসেছি আবার মৃত্যুর পরে কোথায় যাব। জীবনটা কারো কাছে ক্ষুদ্র আবার কারো কাছে বৃহৎ। কারো জীবন আনন্দময় আবার কারো জীবন বিষাদে পূর্ণ। অবশ্য এই ক্ষুদ্র এবং বৃহৎ আর ভালো মন্দের তুলনাটা খুবই আপেক্ষিক। আমাদের একটাই জীবন। সেই জীবনও কত বর্ণিল। কিন্তু মারা যাবার সাথে সাথে আমাদের জাগতিক অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায়। এরপর সময়ের সাথে সাথে মানুষের স্মৃতিগুলোও ধূসর হয়ে আসে। আবার অনেক মানুষ রয়ে যায় আমাদের স্মৃতিতে। আমাদের স্মৃতিতে থাকা না থাকা দিয়ে আসলে একজন মৃত মানুষের কিছুই যায় আসে না। আরেকটা বিষয় হচ্ছে আমাদের শারীরিকভাবে যখন মৃত্যু হয় তখন কি আমাদের অনুভুতিগুলোরও মৃত্যু হয়। না কি সেগুলো উদ্বায়ী পদার্থের মতো আমাদের চারপাশে বিরাজমান থাকে। সৃষ্টির আদিকাল থেকেই মৃত্যুর পরের জীবন নিয়ে আমাদের মনে আগ্রহ তৈরি হয়েছে। মিশরের ফারাও রাজারা বিশ্বাস করতেন মৃত্যুর পর আমরা আবার জীবিত হবো তাই কবরের মধ্যে আনুষঙ্গিক সব উপকরণের পাশাপাশি দরকারি মানুষগুলোকেও কবর দেয়া হতো।’
লেখক এই বইতে মৃত্যুর পরের জীবন কেমন হতে পারে সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতে চেষ্টা করেছেন। এই বইটা লেখকের জীবনের শেষ বই হবে এটা কি তাঁর অবচেতন মন আগেই টের পেয়েছিল, যেমনটা উনি ভূমিকায় লিখেছেন। আমার কাছে বিষয়টাকে মোটেও কাকতালীয় মনে হয় না। আমার মনে হয়, এমন একজন আছেন যিনি আমাদের নিয়ে খেলছেন। কিন্তু সেই তিনিটা কে? তিনি কি সর্বশক্তিমান ঈশ্বর বা গড, নাকি অন্য কিছু। তার কি বস্তুগত কোন অস্তিত্ব আছে না কি নেই। এখন আমরা যখন কম্পিউটারে ভিডিও গেম খেলি তখন অসংখ্য চরিত্র তৈরি করি। তারপর আমরা তাদের দিয়ে আমাদের উদ্দেশ্য পূরণে এগিয়ে যাই। তাহলে যিনি আমাদের নিয়ে খেলছেন তারই বা উদ্দেশ্য কী?
এই বইয়ের মূল চরিত্র অধ্যাপক ইফতেখারুল ইসলাম। তিনি পদার্থবিজ্ঞানের তুখোড় শিক্ষক। তার মৃত্যু পরবর্তী অভিজ্ঞতার সমষ্টিই এই বই। মৃত্যুর পরের অনুভূতিগুলো কেমন হতে পারে, লেখক সে বিষয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন। জীবিত মানুষের স্পর্শানুভূতি থাকে, মৃতদের কি সেটা থাকে? মানুষের চেতনা কি এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে পারে? মৃত্যুর সময় কি মৃত আত্মীয়স্বজন আত্মাকে নিতে আসে? দেহধারী মানুষের অনেক আনন্দের ব্যবস্থাই পৃথিবীতে আছে? নাটক-সিনেমা-বই-চিত্রকলা-সংগীত? পরকালে এমন ব্যবস্থা কি আছে? মৃত মানুষের স্মৃতি কোথায় জমা থাকে? কোন সুপার কম্পিউটারে? জীবিত মানুষের জীবনের একটি অংশ কাটে সুন্দরের অনুসন্ধানে। পরকালের মানুষেরা নিশ্চয় সৌন্দর্য খুঁজবে। কী সৌন্দর্য খুঁজবে? তার তো সব সৌন্দর্যই জেনে ফেলার কথা।
পরকালের মানুষের জীবন হবে কর্মহীন জীবন। কর্ম নেই, কাজেই ক্লান্তিও নেই। ক্ষুধা নেই বলেই ক্ষুধার কষ্ট নেই। আবার ক্ষুধা নিবৃত্তির আনন্দও নেই। খাদ্য গ্রহণের আনন্দ থেকে মৃতরা বঞ্চিত। তাদের অন্য কোন আনন্দ কি দেয়া হবে যা থেকে জীবিতরা বঞ্চিত? মৃত মানুষ রিমোট কন্ট্রোল খেলনা। তাকে যেখানে নেওয়া হবে সে সেখানেই যাবে। তাকে যা দেখানো হবে সে তা-ই দেখবে। এমনকি হতে পারে জীবিত মানুষও রিমোট কন্ট্রোল খেলনা, যার নিয়ন্ত্রণ ছিল অন্য কারও হাতে। সেই অন্য কেউটা আসলে কে? সে কি ঈশ্বর? থিওলজিসিয়ান টমাস একুইনাস ঈশ্বরের পক্ষে অনেকগুলো প্রমাণ দিয়েছিলেন। তার একটা হলো, Nothing moves without a prior mover. Something had to make the first move, and that something we call God.
বিজ্ঞান বলছে, সময় বলে কিছু নেই। সময় মানুষের কল্পনা। অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ একইসঙ্গে আছে। আবার বলা হচ্ছে, Past is never dead. In fact, it is not ever past. মৃত্যুর পরের জগতে সময়ের ধারণা কী? সেখানে তো সময় থাকার কথা না। সেখানে তারা থাকবে অনন্তকাল ধরে। সূর্য একসময় বামন নক্ষত্র হয়ে পৃথিবী গিলে খাবে। এনট্রপি বাড়তে বাড়তে সর্বশেষ সীমায় পৌঁছাবে। পুরো বিশ্বব্রম্মাণ্ড হবে হিমশীতল। কোন তাপ-পার্থক্য না থাকায় ওয়ার্কেবল এনার্জি পাওয়া যাবে না। বিশ্বব্রম্মাণ্ডের করুণ মৃত্যু হবে। এখানে বইয়ের ভূমিকায় দেয়া এডগার অ্যালান পোর কবিতার লাইনগুলো প্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছে—
All the heavens, seem to twinkle
With a crystalline delight;
Keeping time, time, time,
In a sort of Runic rhyme,
To the tintinnabulation that so musically wells
From the bells, bells, bells, bells,
Bells, bells, bells—
মানুষ কোত্থেকে এসেছে, তা–ই সে জানে না। কোথায় যাবে, সে জানবে কীভাবে? তাহলে প্রশ্ন করা হচ্ছে, মানুষ কি শুধু একজন অবজার্ভার। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের ভাষায় অবজার্ভার এমন একজন, যার উপস্থিতি ছাড়া কোন ঘটনা ঘটবে না। কিংবা ঘটনা ঘটবে কি না, তা অবজার্ভারের উপর নির্ভর করবে। আকাশে পূর্ণচন্দ্র। চন্দ্রের পাশেই বড় একখন্ড মেঘ। কোয়ান্টাম মেকানিক্স বলছে, আকাশের চাঁদ একই সঙ্গে মেঘে ঢাকা এবং মেঘমুক্ত। একজন অবজার্ভার যখন চাঁদের দিকে তাকাবে তখনই শুধু নির্ধারিত হবে চাঁদ মেঘমুক্ত, না মেঘে ঢাকা। তাহলে আমাদেরকেও কি কেউ একজন দেখছে। সেই কেউটা কে? A Divine Observer. পবিত্র দর্শক, যিনি সবকিছুই দেখেন।
হুমায়ূন আহমেদ মানেই একান্ত আমাদের গল্প। আর সেই গল্পের পটভূমিজুড়েই থাকে বাংলাদেশের প্রকৃতি থেকে শুরু করে মানুষ, স্থানীয় ভাষা ও সংস্কৃতি। এই বইতেও ইফতেখারুল ইসলাম মারা যাবার পর গ্রামে মাইকিং করা হচ্ছে ঠিক এইভাবে, ‘একটি বিশেষ ঘোষণা—কলমাকান্দার কৃতী সন্তান, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেচর ইফতেখার ইসলাম সাহেব ইন্তেকাল ফরমায়েচেন। ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজিউন। অদ্য বাদ জোহর তার নামাজে জানাজা ঈদগাঁ মাঠে অনুষ্ঠিত হইবে। আপনারা দলে দলে যোগদান করুন।’ মাইকের ঘোষণা শুনে থালা হাতে ফকিরমিসকিন চলে এসেছে। তাদের চোখেমুখে আনন্দ। এরপর যখন তারা জানল যে সেদিন খানা দেওয়া হবে না, তখন আবার তারা বদদোয়া দেয়ার পরিকল্পনা করছে। যেই বদদোয়াই ‘গুষ্টিসুদ্দা’ মইরা সাফ হয়ে যাবে।
লাশের কবর খোঁড়া তদারক করছেন স্থানীয় জুম্মাঘরের মুয়াজ্জিন। তিনি হাত নেড়ে নেড়ে কবর খোঁড়া বিষয়ে কথা বলছেন। গোরখোদক অবাক হয়ে তাঁর কথা শুনছে। মুয়াজ্জিন বলছেন, ‘কবর দুই প্রকারের। সিন্দুক কবর আর বোগদাদি কবর। তোমরা শুধু পারো সিন্দুক কবর। আফসোস! শোনো, কবরের গভীরতা এমন হবে, যেন মুর্দাকে যখন জিন্দা করা হবে, তখন সে যেন বসতে পারে। মানকের নেকেরের প্রশ্নের জবাব তাকে বসে দিতে হবে, এটাই বিধান। তাদের প্রথম প্রশ্ন বড়ই অদ্ভুত। প্রথম প্রশ্ন, তুমি পুরুষ, না নারী। এই প্রশ্নের ভুল উত্তর দিলে শুরু হবে থানার মাইর।’
অবধারিতভাবেই এসেছে বাংলাদেশের বৃষ্টির কথা। শহরের ঝুম বৃষ্টি আর গ্রামের ঝুম বৃষ্টি আলাদা। শহরে ঝুম বৃষ্টি মানেই দুর্ভোগ। রাস্তায় একহাঁটু পানি। তীব্র যানজট, দূষিত বিষাক্ত পানিতে পা ডুবিয়ে পথচারীর বাড়ি ফেরা। গ্রামের ঝুম বৃষ্টি মানে বিশুদ্ধ আনন্দ। ছোটবেলায় বাড়ির পুকুরঘাটে বসে ইফতেখারুল ইসলাম বৃষ্টি দেখেছিলেন। সেই ঘটনা মৃত্যুর পরও তার স্মৃতিতে উজ্জ্বল, শুরু হলো ঝুম বৃষ্টি। দীঘির পানিতে বৃষ্টি পড়ছে, বুদ্বুদ উঠছে—দেখে মনে হচ্ছিল পুকুরটা আনন্দে খলখল করে হাসছে। বাতাসে গাছের ডালপালা দুলছে, মনে হচ্ছিল বৃষ্টির আনন্দে তারা নাচতে শুরু করেছে। বৃষ্টি শুরু হয়েছিল বিকেলে সেই বৃষ্টি থামলো এশার নামাজের পর।
বৃষ্টি থামার পর এক অদ্ভুত দৃশ্যের সূচনা হলো—হাজার হাজার জোনাক পোকা বের হয়ে এল। তারা সবাই একত্র হয়ে একটা বলের মতো বানাচ্ছে, আবার মুহূর্তের মধ্যে বল ভেঙে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। আবার বল তৈরি করছে। একসময় তারা তার চারদিকে ঘুরতে লাগল, সেই ঘুরাও বিচিত্র। কিছুক্ষণ ক্লকওয়াইজ, আবার কিছুক্ষণ অ্যান্টি-ক্লকওয়াইজ। তার মনে হলো, এই জোনাকিরা তাকে কিছু বলার চেষ্টা করছে, বলতে পারছে না। নিম্নশ্রেণির কীটপতঙ্গের সঙ্গে মানুষের মানসিক যোগাযোগের কোনো ব্যবস্থা প্রকৃতি রাখেনি। লেখক খ্রিষ্টান ধর্মযাজক লেমেট্রির জীবনের একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করে এই যোগাযোগের বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করেছেন। অবশ্যম্ভাবী হয়ে এসেছে মানব জীবনের সবচেয়ে বড় সত্য ক্ষুধার প্রসঙ্গও। মানুষের মৃত্যু হয়, কিন্তু ক্ষুধার মৃত্যু হয় না।
বইয়ে যে প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হয়েছে সেখানে ফিরে আসি। মানুষ কোত্থেকে এসেছে, তা-ই সে জানে না। কোথায় যাবে, সেটা জানবে কীভাবে? লেখকের কল্পনায় মৃত্যুর পরের যাত্রা ফুটে উঠেছে এইভাবে, ‘চারদিক কেমন জানি গুটিয়ে সিলিন্ডারের মতো হয়ে যাচ্ছে। সিলিন্ডারের শেষ প্রান্তে আলোর বন্যা। সেই আলোর ভয়াবহ চৌম্বক শক্তি। আমি ছুটে যাচ্ছি। আমি পেছন ফিরে বললাম, পৃথিবীর মানুষেরা! তোমরা ভালো থেকো। সুখে থেকো! আমি ছুটে যাচ্ছি আলোর দিকে। আমি জানি, আমাকে অসীম দূরত্ব অতিক্রম করতে হবে। অসীম কখনো শেষ হয় না। তাহলে যাত্রা শেষ হবে কীভাবে? কে বলে দেবে আমাকে?’ পরিশেষে লেখক কবিগুরুর ‘মৃত্যুর পরে’ কবিতার কয়েকটি চরণ উল্লেখ করে লেখাটা শেষ করেছেন—
‘চিরকাল এইসব রহস্য আছে নীরব
রুদ্ধ ওষ্ঠাধর
জন্মান্তের নবপ্রাতে সে হয়তো আপনাতে
পেয়েছে উত্তর।’
এই বইয়ের লেখক পরিচিতিটাও অন্য আর দশটা বই থেকে আলাদা। সেটার মধ্যেও কেমন যেন একটা বিদায়ের সূক্ষ্ম করুণ সুর আছে। সেটাও এখানে তুলে দিচ্ছি, ‘১৩ নভেম্বর মধ্যরাতে আমার জন্ম। সন ১৯৪৮। হ্যাঁ, মেঘে মেঘে অনেক বেলা হয়ে গেছে। লেখালেখি করছি প্রায় চল্লিশ বছর ধরে। আমি আনন্দিত, ক্লান্তি এখনো আমাকে স্পর্শ করে নি। ধানমন্ডির ১৮ শ স্কয়ার ফিটের একটা ফ্ল্যাট বাড়িতে কাটছে আমার দিবস-রজনী। আমি কোথাও যাই না বলেই মাঝে মাঝে আমার ফ্ল্যাটে জম্পেস আড্ডা হয়। যে রাতে আড্ডা থাকে না, আমি শাওনকে নিয়ে ছবি দেখি। জোছনা আমার অতি প্রিয় বিষয়। প্রতি পূর্ণিমাতেই নুহাশপল্লীতে যাই জোছনা দেখতে, সঙ্গে পুত্র নিষাদ, নিনিত এবং তাদের মমতাময়ী মা। প্রবল জোছনা আমার মধ্যে এক ধরনের হাহাকার তৈরি করে। সেই হাহাকারের উৎস অনুসন্ধান করে জীবন পার করে দিলাম।’
এই বইয়ের উৎসর্গ পত্রটাও দুর্দান্ত। লেখকের কথায়, ‘আমার অনকোলজিস্ট Dr Stephen R Veach-এর সঙ্গে কথোপকথন— আমি: Dr Veach! আমি কি মারা যাচ্ছি? Dr Veach: হ্যাঁ। আমরা সবাই মারা যাচ্ছি। আমাদের জন্মই হয়েছে মারা যাওয়ার জন্যে। এই বইটি Dr Veach-এর জন্যে।’ এই বইটি প্রকাশিত হয় একুশে বইমেলা ২০১২ সালে। আর তিনি মৃত্যুবরণ করেন জুলাই ২০১২ সালে। সেই হিসাবে এটাই উনার জীবনকালে প্রকাশিত শেষ বই। যেমনটা তিনি ভূমিকাতে বলেছিলেন, আমাদের অবচেতন মন কি আগে থেকেই কোন ঘটনা আঁচ করতে পারে। তার মানে তাঁর অবচেতন মন কি টের পেয়েছিল যে উনার আয়ু ফুরিয়ে আসছে। সেই জন্যই কি তিনি একজন মৃত মানুষের জবানিতে উপন্যাসটা লিখলেন। হতে পারে এটা কাকতালীয়। আবার হতে পারে এটা কোন পবিত্র দর্শকের ইশারা।
আরও একটা ব্যাপার লক্ষণীয়। সেটা হচ্ছে যখন উপন্যাসের প্রধান চরিত্র মারা গেছে তখন পৃথিবীতে তিনি তাঁর উত্তরসূরি রেখে যাচ্ছেন। তার মানে কেউ একজন চাই আমাদের বংশগতির এই ধারাবাহিকতা চলতে থাকুক অনন্তকাল ধরে। তার মানে কি এই দাঁড়াচ্ছে আমাদের যিনি রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করছেন, তিনি চাইছেন তার খেলাটা চলতে থাকুক। এই বইটা খুলে তার মধ্যে মুখ ডুবিয়ে প্রাণভরে শ্বাস নিলাম। প্রত্যেক নতুন বইতেই একটা গন্ধ থাকে। কিন্তু এই বইয়ের গন্ধটা আলাদা। অবস্থা এমন দাঁড়ালো যে আমি একটু পরপর বইটার গন্ধ নিতে শুরু করলাম। বইয়ের প্রচ্ছদে বইটার নাম খোদাই করে লেখা। একটু পরপর সেটাতে হাত বুলাতে শুরু করলাম। বারবার মনে হচ্ছিল হুমায়ূন আহমেদ যেন মরেননি। হয়তোবা এটা আমার আবেগী মনের কল্পনা।
হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর সাথে আমরা আমাদের স্বকীয়তা হারিয়ে ফেলেছি হোক সেটা লেখালেখির বিষয়বস্তু বা ধরন। আমাদের নাটক চলচ্চিত্রও এখন অন্যদের দেখাদেখি তৈরি হয়। আমাদের সাধারণ জীবনের সাধারণ গল্পগুলো আর কেউ লিখবে না। আর কেউ আমাদের দৈনন্দিন জীবনের হাস্যরসকে সেলুলয়েডের ফিতায় তুলে ধরবে না। আমাদের নিত্যদিনের অভাব, অভিযোগ আর বিশ্বাস নিয়েই যে সুখে বেঁচে থাকা যায়, সেটা আর কেউ জোর গলায় বলতে আসবে না। এই মৃত্যুর ক্ষতি আমরা আর কখনো কাটিয়ে উঠতে পারবো এমন কোন সম্ভাবনা আপাতত দৃশ্যমান নয়। তবুও আশাকরি একদিন এমন কেউ আসবে যে আমাদের নিজেদের অপূর্ণতাকে নিয়েই আবার বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখাবেন। জয়তু হুমায়ূন আহমেদ। জয়তু দক্ষিণ গোলার্ধের ছোট জনপদ বাংলাদেশ।