দেশের রাজনৈতিক সংকট, প্রশাসনিক দুর্বলতা ও ভবিষ্যৎ: একটি সমন্বিত রোডম্যাপ

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন নতুন একটা বাংলাদেশের সম্ভাবনাকে সামনে নিয়ে এসেছে। সেটা অন্তুর্ভুক্তিমূলক রাজনীতিছবি : প্রথম আলো

বাংলাদেশ বর্তমানে একটি সংকটময় রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক বাস্তবতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের ১৬ বছরের শাসনকাল শেষে দেশ রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে গভীর অস্থিরতার মধ্যে পতিত হয়েছে। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা, প্রশাসনিক দুর্নীতি, জনগণের বিভ্রান্তি, বহির্বিশ্বের উসকানি ও কূটনৈতিক দুর্বলতা—সব মিলিয়ে বর্তমান পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল। এই প্রতিবেদনে বর্তমান সংকট, প্রশাসনের দুর্বলতা ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিশদ মূল্যায়ন করে একটি গঠনমূলক রোডম্যাপ প্রস্তাব করছি (যদিও অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নানা বিষয়ে পদক্ষেপ নিয়েছে এবং যথাযথভাবে কাজ শুরুও করেছে), যা দেশের ভবিষ্যতের জন্য একটি স্থিতিশীল পথ নির্দেশ করতে সক্ষম হবে।

১. রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও শাসনব্যবস্থা

শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সাল থেকে ক্ষমতায় ছিল। এ শাসনকালে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও অবকাঠামোগত অগ্রগতি যেমন ঘটেছে, তেমনি রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে অস্থিরতা ও সংকটও বৃদ্ধি পেয়েছে। দীর্ঘমেয়াদি শাসন ও এককেন্দ্রিক ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ বিরোধী দলগুলোর দমনের অভিযোগ নিয়ে বিতর্ক তৈরি করেছে। নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে জনগণের মধ্যে আস্থার সংকট এবং বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে সংঘাতের কারণে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা দেখা দিয়েছে। বিরোধী দলগুলো অবিলম্বে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছে, যা দেশের রাজনীতিতে উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে তুলছে।

২. প্রশাসনের আতঙ্ক ও দুর্বলতা

দীর্ঘদিনের এককেন্দ্রিক শাসনের কারণে প্রশাসন একটি স্থবির অবস্থায় পৌঁছেছে। প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে, কারণ, ক্ষমতার পালাবদলে তাঁদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে উঠতে পারে। দুর্নীতির বিস্তার ও অদক্ষ প্রশাসনিক ব্যবস্থার কারণে দেশের অবকাঠামো উন্নয়ন এবং জনগণের সেবা প্রদানের কার্যক্রমে ব্যাপক বাধা সৃষ্টি হচ্ছে। প্রশাসনিক দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে সরকার ও জনগণের মধ্যে আস্থার সংকট আরও গভীর হবে।

৩. বিরোধী দলের তৎপরতা ও জনগণের বিভ্রান্তি

বিরোধী দল, বিশেষত বিএনপি ও অন্য প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো অবিলম্বে একটি অবাধ নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আন্দোলন করছে। তাদের দাবি, বর্তমান সরকার দীর্ঘদিন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকলে জনগণের প্রকৃত রায় প্রতিফলিত হবে না। এ রাজনৈতিক উত্তেজনা ও সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ডের ফলে সাধারণ জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি ও অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর বিপরীতমুখী বক্তব্য এবং সঠিক তথ্যের অভাবে জনগণের একটি বড় অংশ পরিস্থিতি নিয়ে বিভ্রান্তিতে আছে।

৪. বহির্বিশ্বের উসকানি ও কূটনৈতিক দুর্বলতা

বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংকট নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে বিভিন্ন ধরনের মতামত রয়েছে। বিশেষ করে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত, চীন ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর সরাসরি বা পরোক্ষ প্রভাব ফেলার চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ উঠছে। বিশেষত ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতার কারণে বিভিন্ন মহলে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক মঞ্চে বাংলাদেশের কূটনৈতিক অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়েছে, যা দেশের স্বার্থ রক্ষায় জটিলতা তৈরি করতে পারে। দেশের সার্বভৌমত্ব ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখতে এই সমস্যাগুলো সমাধান করা জরুরি।

৫. শিক্ষার্থীদের সম্ভাব্য আন্দোলন

শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশে সব সময়ই বড় ধরনের রাজনৈতিক পরিবর্তনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে এসেছেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা বাড়ছে। তাঁরা শিক্ষার মান, ভবিষ্যতের চাকরির বাজার ও দেশের সার্বিক অবস্থা নিয়ে উদ্বিগ্ন। অতীতে যেমন দেখা গেছে, শিক্ষার্থীদের মধ্যে অসন্তোষ বা প্রতিবাদ শুরু হলে তা রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়িয়ে দিতে পারে। সরকারের উচিত শিক্ষার্থীদের উদ্বেগ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা এবং তাঁদের জন্য সমাধানমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

৬. দুর্নীতি ও প্রশাসনিক ব্যর্থতা

দুর্নীতি বাংলাদেশের জন্য একটি দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা। দেশের প্রায় প্রতিটি স্তরে প্রশাসনিক দুর্নীতি ও অপব্যবহার ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে, যা প্রশাসনের দক্ষতা ও স্বচ্ছতাকে ব্যাহত করছে। উন্নয়ন প্রকল্পগুলোতে স্বচ্ছতার অভাব ও অর্থের অপচয় সরকারের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। দুর্নীতি বন্ধ করতে না পারলে দেশের সার্বিক অগ্রগতি থেমে যাবে এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতি আরও জটিল হবে।

৭. আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ড

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের শেখ হাসিনার দলীয় কর্মীদের বিরুদ্ধে হিংসাত্মক কর্মকাণ্ড চালানোর অভিযোগ উঠছে। বিরোধী দল ও তাদের সমর্থকদের ওপর নির্যাতন, হুমকি ও সহিংসতার অভিযোগ ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে। এ ধরনের পরিস্থিতি রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সহিংসতার মাত্রা আরও বাড়িয়ে তুলছে। শেখ হাসিনার সরকার ও দলের নেতাদের উসকানিমূলক বক্তব্য পরিস্থিতিকে আরও ঘোলাটে করে তুলছে, যা দেশকে রাজনৈতিক সংকটে ফেলতে পারে।

করণীয় রোডম্যাপ

বর্তমান সংকট থেকে উত্তরণ ও দেশের ভবিষ্যৎ গঠনের জন্য নিচের পদক্ষেপগুলো নেওয়া যেতে পারে—

ক. প্রশাসনিক সংস্কার ও স্বচ্ছতা বৃদ্ধি

—প্রশাসনকে দুর্নীতিমুক্ত ও দক্ষ করতে একটি শক্তিশালী সংস্কার প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে।
—সরকারি পরিষেবায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে প্রযুক্তির আরও বিস্তৃত ব্যবহার করতে হবে।
—দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা উচিত।

খ. নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের পুনরুদ্ধার

—অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য একটি স্বাধীন নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে।
—সব রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য সংলাপ ও আলোচনার উদ্যোগ নিতে হবে।

গ. আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দক্ষতা বৃদ্ধি

—নিরাপত্তা বাহিনীর দক্ষতা বাড়ানোর জন্য আধুনিক প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তিগত সরঞ্জাম সরবরাহ করতে হবে।
—মানবাধিকার রক্ষা ও সুশাসন নিশ্চিত করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরিচালনা করতে হবে, যাতে জনগণের আস্থা ফিরে আসে।

ঘ. ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখা

—ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে কূটনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে, যাতে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষিত হয় এবং অন্য আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করা যায়।
—বহির্বিশ্ব থেকে আসা চাপ বা উসকানির মোকাবিলায় কৌশলী কূটনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

ঙ. শিক্ষার্থীদের জন্য উন্নয়নমূলক পদক্ষেপ

—শিক্ষার্থীদের জন্য আরও উন্নত শিক্ষাব্যবস্থা ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির উদ্যোগ নিতে হবে।
—শিক্ষার্থীদের উদ্বেগ গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে সঠিক পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে তাঁরা ভবিষ্যতের প্রতি আস্থা পান ও রাজনৈতিক অস্থিরতায় না জড়ান।

চ. গণমাধ্যম ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা

—গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে সরকারকে আরও উদার হতে হবে, যাতে সঠিক তথ্য জনগণের কাছে পৌঁছাতে পারে।
—মতপ্রকাশের অধিকার সুরক্ষিত করে গণতন্ত্রের মূল স্তম্ভগুলো শক্তিশালী করতে হবে।

বাংলাদেশ বর্তমানে একটি সংকটময় পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, যেখানে প্রশাসনিক দুর্বলতা, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বহির্বিশ্বের চাপ দেশের সার্বিক অগ্রগতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সুশাসন ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া পুনর্গঠনের মাধ্যমে এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ সম্ভব। প্রশাসনের সংস্কার, সুষ্ঠু নির্বাচন ও আন্তর্জাতিক কূটনীতির ভারসাম্য রক্ষা করে দেশের সার্বভৌমত্ব এবং স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা যেতে পারে। একটি সুসংগঠিত ও স্বচ্ছ পরিকল্পনার মাধ্যমে বাংলাদেশের জন্য একটি স্থিতিশীল ও উন্নত ভবিষ্যৎ গঠন করা সম্ভব।

সে ক্ষেত্রে আমি মনে করি, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সর্বাঙ্গীন সহায়তা করা জরুরি, যেন তারা একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপগুলো সঠিকভাবে সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়।

  • লেখক: রহমান মৃধা, সুইডেন

  • দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]