মা জননী এবং প্রবাসের নিয়মাবলি

মারিটাইম মিউজিয়ামে মাছবি: লেখকের পাঠানো

মা জননী প্রবাসে এলেন এক বছর পেরিয়ে মাস চারেক হলো। এত দিনে তাঁর সময়টা মন্দ কাটছে, বলা যাবে না। তিনি নোভাস্কোশিয়ার রাজধানী হ্যালিফ্যাক্স শহরের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছেন সানন্দে। পিয়ের ২১ ইমিগ্রেশন মিউজিয়াম, ন্যাশনাল হিস্ট্রি অব মিউজিয়াম, পাবলিক গার্ডেনস, মেরি ক্লেটন পার্ক, ম্যারিটাইম মিউজিয়াম অব আটলান্টিকসহ আরও অসংখ্য জায়গায় গেছেন। গত বছর দুর্গাপূজা এবং এ বছরের সরস্বতীপূজায়ও অংশ নিয়ে সবার প্রিয় পরিচিত মুখ হয়ে উঠেছেন। এখানে স্থানীয় বাঙালি সংগঠন, বিশেষ করে BAAC (Bengali Association of Atlantic Canada) এবং শারদীয়া সোসাইটি দুটিতেই তিনি অংশ নিয়েছেন। পূজার কাজে বেশ ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন। তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী ভোরেই মাকে নিয়ে মন্দিরে পৌঁছে যেতাম, যাতে শুরু থেকেই তিনি কাজ করতে পারেন।

একবার এক আয়োজনে তাঁকে নিয়ে উপস্থিত হতে না পারায় প্রবেশপথে পৌঁছানোর পরপরই সবাই আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করতে লাগলেন, ‘মাসিমা, কই? আসেননি যে?’

আমাদের মা-ছেলে দুজনেরই জীবনে প্রবাসের মাটিতে সবার আত্মীয়তা অনেক বড় প্রাপ্তি। সময় সবকিছু মিলিয়ে কেটে যাচ্ছে বেশ। এত সুন্দর সময়ের মধ্যে চলে আসে দুশ্চিন্তা! কারণ, প্রবাসের অভিবাসী আইন।

মা-বাবাদের অভিবাসী আইন, জটিলতা

প্রথমত, বিদ্যমান আইনে মায়ের স্থায়ী নাগরিকত্ব অর্জনের কোনো সুযোগ আপাতত নেই। কানাডিয়ান সরকার ২০২০ সালে করোনার সময়ে মা–বাবা এবং সব বয়োজ্যেষ্ঠ অভিভাবকের স্থায়ী নাগরিক হওয়ার সুযোগ বাতিল করে। সেই আইন এত বছর স্থগিত থাকার পর চলমান জুলাই মাসেই পুনরায় সচল হয়। বর্তমানে ২০২০ সালে আবেদনকারীদের মধ্য থেকে ১০ হাজার জনের দরখাস্ত গ্রহণ করছে সরকার। হয়তো পর্যায়ক্রমে অন্যদেরও সুযোগ আসবে। এতে মায়ের অ্যাপ্লাই করার সময় আসতে লেগে যাবে আরও কয়েক বছর। এই মধ্যবর্তী সময়ে মা কীভাবে এই দেশে অবস্থান করবেন, সেটাই এখন কপালে চিন্তার রেখা ফেলছে।

দ্বিতীয়ত, সুপার ভিসায় অ্যাপ্লাই করা যায়। এটি একটি বিশেষ ধরনের ভিসা, যাতে সর্বোচ্চ ২০ বছর পর্যন্ত কোনো সমস্যা ছাড়াই থাকা যায়। তবে শুধু বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিদের এই বিশেষ ভিসা দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রেও রয়েছে বেশ কিছু শর্ত আছে।

১. আবেদনকারীকে অবশ্যই কানাডার স্থায়ী বাসিন্দা হতে হবে।

২. তাঁর বাৎসরিক আয় ৪৭ হাজার ৫৪৯ কানাডিয়ান ডলার (২ জনের পরিবার) হতে হবে।

পিয়ের ২১ ইমিগ্রেশন মিউজিয়ামে
ছবি: লেখকের পাঠানো

নিয়ম হচ্ছে, প্রতিবছর আমরা ফেব্রুয়ারি-এপ্রিল মাসে ট্যাক্সের হিসাব জমা দিই। তখন ডাকযোগে সবার কাছেই পৌঁছে যায় NOA (Notice Of Assessment)। সরকারি রাজস্ব সংস্থা কর্তৃক পাঠানো এই রিপোর্টেই উল্লেখ করা হয় আপনার বাৎসরিক আয় কত।

অভিবাসন আইনে উল্লিখিত আয়সীমার কম হলে আবেদনের সুযোগ থাকছে না। আবার আগামী বছরের অপেক্ষা। শুধু তা-ই নয়, চলতি বছরে আপনাকে নিশ্চিত করতে হবে যে বৎসরান্তে আপনার আয় ৪৭ হাজার ৫৪৯ ডলার থাকছে। সে ক্ষেত্রে অবশ্য এটাও লক্ষ রাখতে হবে যে সরকার এই আয়ের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছে কি না। যদি নিয়ম পরিবর্তন হয়, তখন সেটাই প্রযোজ্য হবে। এসব বিবেচনায় বর্তমানে মায়ের সুপার ভিসায় অ্যাপ্লাই করার পথ রুদ্ধ।

তৃতীয়ত, তিনি থাকতে পারেন ভিজিটর ভিসায়। মা সেভাবেই আছেন। মনে রাখতে হবে, প্রবেশের সময় আপনাকে কত মাসের বা বছরের ভিসা দেওয়া হয়েছে, সেটা বিবেচ্য বিষয় নয়। আপনাকে যদি ১০ বছরের ভিসাও দেওয়া হয়, তারপরও নিয়মানুযায়ী ছয় মাসের মেয়াদ ফুরানোর আগেই পুনরায় দরখাস্তের আবেদন করতে হবে। ভিজিটিং ভিসার সময় ছয় মাস ফুরিয়ে গেলে একটি সরকারি কাগজ আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আপনার হস্তগত হবে, যাকে বলে ভিজিটর রেকর্ড। পরবর্তী সময়ে ভিজিটিং ভিসার মেয়াদ বাড়ানোর আবেদনের প্রক্রিয়াকে বলা হয় ভিজিটর রেকর্ড এক্সটেনশন। দর্শনার্থীদের ভিসার মেয়াদ এক বছর পূর্ণ হলে মেডিকেল টেস্ট করাতে হয়; অর্থাৎ যখন আপনি পুনরায় আবেদন করবেন, তখন প্রয়োজনীয় অন্য সব কাগজের সঙ্গে অবশ্যই মেডিকেল টেস্টের রিপোর্ট জমা দিতে হবে। কত দিনের জন্য এক্সটেনশন পাবেন, এটা সম্পূর্ণ সরকারি সিদ্ধান্ত। তবে ছয় মাসের ভিসার মেয়াদ শেষ হলে সাধারণত এক বছরের ভিজিটিং রেকর্ডের কপি হস্তগত হয় আবেদনকারীর। মেয়াদ ফুরানোর আগে পুনরায় অ্যাপ্লাই করতে হবে। এক্সটেনশন পাবেন, এটার কোনো নিশ্চয়তা নেই। সাম্প্রতিক সময়ে কানাডিয়ান সরকার ভিসা বাতিল করছে বেশি। যদি না–বোধক উত্তর আসে, সে ক্ষেত্রে প্রার্থীকে কানাডা ত্যাগ করতে হবে। অবস্থান করার সুযোগ থাকছে না।

মা জননীকে নিয়ে দুশ্চিন্তা এখানেই। ওনার সুপার ভিসা এবং স্থায়ী নাগরিকত্বের আবেদন করার সুযোগ নেই। অতএব ভিজিটর রেকর্ডের আবেদন করতে হবে। কিন্তু সেটা পুরোটাই ভবিতব্যের হাতে।

স্বাস্থ্যবিমা ক্রয়

বয়োজ্যেষ্ঠ নাগরিকদের জন্য আরও একটি অত্যাবশ্যকীয় বিষয় হচ্ছে স্বাস্থ্যবিমা কেনা। তবে এটা সব বয়সের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এখানকার স্বাস্থ্যসেবা বেশ ব্যয়বহুল। স্থায়ী নাগরিক বা পারমিটধারী (স্টাডি/ ওয়ার্ক) ব্যতীত অন্য ব্যক্তিদের জন্য। তাই বিমা কেনা বাধ্যতামূলক। ইমিগ্রেশনের সময় বর্ডার অফিসার যে কয়েকটি প্রয়োজনীয় কাগজ দেখতে চান তার মধ্যে অন্যতম স্বাস্থ্যবিমা। ফিরতি টিকিট এবং স্বাস্থ্য বিমার কপি দেখাতে হয়। হরেক রকমের কোম্পানি থেকে এই বিমা নেওয়া যায়। মায়ের জন্য নিয়েছিলাম Rimi থেকে। এ ছাড়া Allianz Global Assistance ও ব্যবহার করার অভিজ্ঞতা হয়েছিল। Rimi–এর কভারেজ ভালো। ওরা সময়মতো নির্ধারিত ফেরতযোগ্য টাকা প্রদান করে।

মায়ের দাঁতে প্রচণ্ড ব্যথা। একদিন ভোররাতে উঠে দেখি, ব্যথায় কাতর মা পানির কলের সামনে বসে আছেন। কখন উঠেছেন, সেটাও জানি না। মাকে ওখান থেকে এনে ওষুধ খাইয়ে ঘড়িতে সময় দেখি ভোর সাড়ে চারটা! আমি হতবাক হয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে গেছি। মা পাশ ফিরে শুয়েছেন। যদিও জানি, উনি ঘুমাতে পারবেন না। কানাডায় নিজে ডেন্টিস্টের কাছে যাইনি। তাই পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই। ফোন হাতে নিয়ে বের করতে লাগলাম ভোরের আলো উঁকি মারলেই কোথায় নিয়ে যাওয়া যায়। সকাল আটটার আগে কোনো চেম্বারই খোলে না। নিজে ডেন্টিস্ট হওয়ার সুবাদে এটা জানি যে মায়ের ব্যথা ইমার্জেন্সিতে নেওয়ার মতো কেস নয়। তবে এখানকার মেডিকেল ডাক্তারের কাছে যাওয়ার অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও ভুল করে বসলাম। আটটা বাজতেই সোজা মাকে নিয়ে উপস্থিত হলাম ডেন্টাল চেম্বারে। তবে এমন হওয়ার যথোপযুক্ত কারণ ছিল। ওয়েবসাইটে লেখা আছে, ইমার্জেন্সি চিকিৎসা দেওয়া হয়। মায়ের অমন অবস্থা আগে কখনো দেখিনি। ২৮ বছরের অভিজ্ঞতায় এবারই প্রথম মাকে এত অসহায় লাগল। সবকিছু মিলিয়ে ভ্যাবাচেকা খেয়ে যাওয়া আমি তাই সরাসরি চেম্বারমুখী হয়ে ভাবলাম, হয়তো ওরা তাৎক্ষণিক কোনো ব্যবস্থা নেবে। তবে নিয়েছিল। অভ্যর্থনাকারী মেয়েটি জানাল, ওরা বিনা অ্যাপয়েন্টমেন্টে কোনো রোগীর চিকিৎসা করে না। আমরা বেলা ১টা ৩০ মিনিটে আসতে পারব কি না? চাকরি থাকায় সেটা আর সম্ভব হয়নি। ওই দিন অফিসে ইমার্জেন্সি মেইল করে জানালাম, দেরিতে আসব। এক দিন পর সকাল আটটায় অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেলাম। এর মধ্যে ওষুধ চলল। এটাও একটা সমস্যা। কারণ, অফিসে বারবার আপনাকে জানাতে হবে, কত দিন আপনি দেরিতে আসবেন। কখন, কেন এমন হচ্ছে ইত্যাদি ইত্যাদি। এরপর মায়ের চিকিৎসা চলল প্রায় দুই মাসব্যাপী।

মায়ের সঙ্গে লেখক
ছবি: লেখকের পাঠানো

‘যেখানে বাঘের ভয়, সেখানে সন্ধ্যা হয়।’ বিদেশের মাটিতে দাঁতের চিকিৎসার পাহাড়সম খরচ এড়াতে নিজেই এখন পর্যন্ত দেশে গিয়ে ডেন্টিস্ট দেখিয়েছি। এত দিন সবার মুখে মুখে শুনেছিলাম, ‘ওহ বাবা! দাঁতের খরচে পকেট কাটা বিল আসে!’ আর আজ তার চাক্ষুষ প্রমাণ হাতেনাতে পেয়েছি। থাক, ওসবের বিস্তারিত বিবরণ না দিই। তাহলে আমার লেখা আর ট্র্যাভেনিয়ারের ভারত ভ্রমণের মধ্যে কোনো তফাত থাকবে না। মোগল আমলে তিনি তৎকালীন ভারতবর্ষে ভ্রমণ করেছিলেন। ছবিসমেত মাস, দিনক্ষণসহ খরচাপাতির যাবতীয় হিসাব-নিকাশ খুব যত্নসহকারে তুলে ধরেছেন, যা ইতিহাসপ্রসিদ্ধ।

রিমি থেকে প্ল্যান অনুযায়ী আমাদের প্রাপ্য ছিল ৫০০ ডলারের মতো। ওরা ধাপে ধাপে পুরোটাই দিয়েছিল। যেহেতু খরচ অনেক বেশি ছিল, আমি এরপরও আবেদন করেছিলাম। ওরা উত্তর দিয়ে নিজস্ব নিয়মাবলি এবং সীমাবদ্ধতা আমাকে জানিয়েছিল।

এসব ক্ষেত্রে পাঠকদের মনে প্রশ্ন হলো, ভিজিটিং ভিসা বা যেকোনো ভিসায় আবেদন কীভাবে করব?

বলে রাখি, অ্যাপ্লাই করার ক্ষেত্রে নিজেও করতে পারেন বা কোন লাইসেন্সড ইমিগ্রেশন উকিলের সহায়তা নিতে পারেন। আমরা উকিলের সাহায্যেই দরখাস্তের সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছি।

‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

মায়ের ব্যথা হয়েছিল শীতকালে। এ সময়ে জীবনে মোটামুটি স্থবিরতা নেমে আসে। মা আমার ঘরনি হওয়ায় টিভি, ইউটিউব, সিরিয়াল দেখে আর বই পড়ে সময় দিব্যি কাটাচ্ছেন। গ্রীষ্মে, বছরের অন্যান্য সময়ে হাঁটতে নিয়ে গেলেও শীতের বরফের চাঁইয়ের মধ্যে বের হওয়া বন্ধ থাকে প্রায়ই। বরফ গললে বেশ দেখেশুনে, আবহাওয়া বুঝে বের হতে হয়।

উপসংহারে বলব, প্রবাসে বাবা-মাকে নিয়ে আসা অনেকেরই দীর্ঘদিনের স্বপ্ন থাকে। সে ক্ষেত্রে অগ্রিম পরিকল্পনা করুন। নিয়মকানুন নিয়ে প্রবাসী বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করার পাশাপাশি কানাডীয় ইমিগ্রেশন ওয়েবসাইট ভালো করে অধ্যয়ন করুন। অহেতুক ভুল এড়াতে প্রয়োজনে লাইসেন্সড ইমিগ্রেশন উকিলের সাহায্য নিন। নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় যা দেখেছি, আশপাশের বন্ধুদের মা–বাবা বেড়াতে এসেছেন। মাস দুয়েক থেকে চলেও গেছেন। আমার ক্ষেত্রে পরিস্থিতি বেশ ভিন্ন। তাই ভেবে দেখুন, ভবিষ্যতে আপনার হালও আমার মতো হয়ে দাঁড়ায় কি না। সে বিবেচনায় আশা করছি লেখাটা কিছুটা হলেও দিকনির্দেশনা দিতে পারবে।