হুড টু কোস্ট: মাদার অব অল রিলে
শীতের তখন মাঝামাঝি, ওরেগনে সামার আসতে আরও তিন মাস বাকি। একদিন মাহফুজ ভাইয়ের বার্তা এল মেসেঞ্জারে। প্রশ্ন আমি হুড টু কোস্ট ম্যারাথনে দৌড়াতে আগ্রহী কি না। ফিটনেস নিয়ে আগের বছর কিছুদিন কাজ করায় আমার নিজে থেকে আগ্রহ ছিল এই ম্যারাথনে নাম লেখানোর। মাহফুজ ভাইয়ের প্রস্তাব পেয়ে তো আনন্দে আটখানা। কোনো প্রকার মেহনত ছাড়া একটা দলে নাম লিপিবদ্ধ করার সুযোগ পেলাম। যদিও বিয়ের পর ওজন বেড়েছে বেশ। তারপরও আগ্রহ দেখে আমার ওপর বিশ্বাস রেখেছেন মাহফুজ ভাই। কিছুদিনের মধ্যে এক এক করে ১২ সদস্যের দল ফাইনাল হয়ে গেল।
আমাদের দলের নাম ব্রোকেন বাঞ্চ, যার আক্ষরিক অর্থ ভাঙা দল। ভালো ফিট, আধা ফিট কিংবা ফিটনেসবিহীন সবার জন্যই উন্মুক্ত আমাদের দরজা। তবে শর্ত হলো নিয়মিত অনুশীলনের মাধ্যমে ফিটনেসের উন্নতি আর দলীয় লক্ষ্য অর্জনে থাকতে হবে অঙ্গীকারবদ্ধ। সামারের শুরু থেকে মাহফুজ ভাইয়ের তত্ত্বাবধানে এককভাবে এবং দলীয়ভাবে শুরু হয়ে গেল অনুশীলন। দু–তিন মাসের অনুশীলনে ফিটনেসের মাপকাঠিতে সবাই যার যার আগের অবস্থার চেয়ে উন্নতি করেছে বেশ। তারপরও সবার মনে কিছুটা শঙ্কা ছিল, যেহেতু আমাদের সবার জন্যই এটি প্রথম দৌড় হুড টু কোস্ট প্রতিযোগিতায়। এ দলে ম্যারাথন দৌড়ানোর পূর্বাভিজ্ঞতা আছে শুধু ওয়াশিংটনের বাসিন্দা তৌফিক ভাইয়ের। যা হোক, দলীয় অধিনায়ক মাহফুজ ভাইয়ের উৎসাহে আমরা সাহস নিয়ে মাঠে নামার জন্য ছিলাম প্রস্তুত। শেষ মুহূর্তে আমাদের শঙ্কা আরেকটু বাড়িয়ে দিল দলের সদস্য আবিদ ভাইয়ের বাবার আকস্মিক মৃত্যু। এক সদস্য কম নিয়ে তখন ম্যারাথন ঠিকভাবে শেষ করা হয়ে গেল অনিশ্চিত। কিন্তু আমাদের অবাক করে দিয়ে আবিদ ভাই দৌড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। উনার এ শোককে শক্তিতে পরিণত করার ইস্পাত কঠিন মনোভাব দলের মধ্যে জোগাল অন্যরকম অনুপ্রেরণা।
সাধারণত প্রতিবছর যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিক দিবসের আগের সপ্তাহান্তে এ ম্যারাথন অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। মাদার অব অল রিলে খ্যাত ২০০ মাইলের এই দৌড় পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘ রিলে দৌড়। প্রতিযোগীর সংখ্যা বিচারেও এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় রিলে দৌড়ের আসর। প্রতিবছর লটারির মাধ্যমে বাছাইকৃত সর্বোচ্চ ১২ সদস্যের ১০৫টি দল সুযোগ পায় এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার। এর সঙ্গে কয়েক বছর ধরে ছোট পরিসরে যুক্ত হয়েছে পোর্টল্যান্ড টু কোস্ট রিলে দৌড় ও হাঁটা প্রতিযোগিতা। মূল দৌড় শুরু হয় ওরেগনের আইকনিক পর্বত মাউন্ট হুডের চূড়া থেকে এবং শেষ হয় প্রশান্ত মহাসাগরের সৈকতঘেঁষা সিসাইড শহরে। ২০০ মাইলের রাস্তাকে মোট ৩৬টি লেগে ভাগ করা হয়। প্রতি লেগের দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৪ থেকে ৭ দশমিক ৮ মাইল। সাধারণত ১২ সদস্যের দলের সদস্যরা প্রত্যেকে ৩ লেগে দৌড়ে মোট ৩৬ লেগ সম্পন্ন করে থাকেন। এতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দল বেঁধে সময় লাগে ১৭ থেকে ৪০ ঘণ্টা। একজন দৌড়বিদ যখন একটি লেগে দৌড়ান, দলের বাকি সদস্যরা তখন এক বা দুটি ভ্যানে বিভিন্ন রিলে ব্যান্ড পরিবর্তন স্টেশনে ভ্রমণ করেন। উৎসবের আমেজ বাড়াতে ভ্যানগুলো বিভিন্ন শব্দ এবং বাক্যের বাহারে রঙিন করে তোলে অনেককে। এ আয়োজনের অর্জিত অর্থ সরাসরি চলে যায় ক্যানসার গবেষণার খাতে।
গত বছর হুড টু কোস্টের তারিখ নির্ধারিত হয়েছিল ২৯ আগস্ট। আমরা ১২ সদস্যের দল। প্রতিযোগিতার জন্য শুরুতে আমরা ছয়জন করে দুটি ভ্যানে ভাগ হয়ে যাই। ভ্যানের সদস্যরা বিকেলে রওনা দিয়ে প্রথম লেগের যাত্রাবিন্দুর কাছাকাছি একটি হোটেলে উঠি। কয়েক ঘণ্টা বিশ্রাম নিয়ে চলে যাই মাউন্ট হুডের প্রায় শীর্ষে টিম্বারলাইন লজে। রাত ৩টা ৩৫ মিনিটে আমাদের দলের দৌড় শুরু হয় আমাকে দিয়ে। প্রথম লেগে দৌড়াব বলে যেমন অনেক আনন্দিত ছিলাম, সঙ্গে আবার নার্ভাসও ছিলাম কিছুটা। কেননা প্রথম লেগের ৫ দশমিক ৪৪ মাইল পুরোটাই খাড়া পর্বত থেকে নামার ঢালু পথ। তবে কোনো ইনজুরি ও বাধাবিপত্তি ছাড়া শেষ করলাম লেগ এবং রিলে বন্ধনী পরিবর্তন করে নিলাম দ্বিতীয় লেগের তৌফিক ভাইয়ের সঙ্গে। আগে ম্যারাথন বিজয়ী তৌফিক ভাই আমি দ্বিতীয় লেগের যাত্রাবিন্দুতে আসার আগে উত্তেজনায় টগবগ করছিলেন। বন্ধনী পরিয়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দিলেন ভোঁ–দৌড় এবং অতিদ্রুত পরের লেগের স্টেশনে পৌঁছে গেলেন। এভাবে একেকজন একেকটি লেগের দৌড় শেষ করেন এবং বাকি ব্যক্তিরা গাড়িতে করে পরের স্টেশনে পৌঁছে যাই। দলের অন্য এক সদস্য প্রস্তুত থাকেন নতুন লেগে নামার জন্য। এ প্রক্রিয়া চলতে থাকে ৩৬ লেগ সম্পন্ন হওয়া পর্যন্ত এবং আমাদের দলের সময় লাগে প্রায় ৩৭ দশমিক ৫ ঘণ্টা। দলের প্রত্যেক সদস্যকে ১২ ঘণ্টা অন্তর মোট ৩টি লেগে দৌড়াতে হয়েছে।
এ বছর পোর্টল্যান্ড বাংলাদেশি কমিউনিটি থেকে হুড টু কোস্ট প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী দল ছিল সাতটি। আমাদের কমিউনিটি থেকে এ প্রতিযোগিতায় ৭ দলে ৮৪ জন সদস্যের অংশগ্রহণ এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ। দৌড়বিদ ও তাঁদের পরিবার ছাড়াও অনেকের আগ্রহ ছিল হুড টু কোস্ট নিয়ে। কেউ কেউ দৌড়ে অংশগ্রহণ না করলেও কাজ করেছেন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে। অংশগ্রহণকারী দলগুলোর সঙ্গে দৌড় শেষের আনন্দ উদ্যাপনে সঙ্গী হতে অনেকে দল বেঁধে চলে গেছেন সিসাইডের সমুদ্রসৈকতে।
আমাদের ব্রোকেন বাঞ্চ দলের উচ্চাভিলাষী কোনো লক্ষ্যমাত্রা ছিল না এই প্রতিযোগিতা ঘিরে। দলের ক্যাপ্টেন মাহফুজ ভাই প্রতিযোগিতার আগের দিন বলেন, ‘হুড টু কোস্ট প্রস্তুতির জন্য আমরা সবাই যার যার ফিটনেসের ক্ষেত্রে যথেষ্ট উন্নতি করেছি। এ প্রতিযোগিতায় আমরা অংশগ্রহণ করব শুধু আনন্দের জন্য এবং লক্ষ্য থাকবে কোনো ইনজুরি ছাড়া নিরাপদে দৌড় শেষ করা।’
শুরুতে দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য জনি ভাই হালকা ইনজুরির শিকার হলেও শেষমেশ নিরাপদে শেষ হলো আমাদের দলের দৌড় এবং সেটা আমাদের আনুমানিক টাইমিংয়ের মধ্যে ছিল। দলের সবার জন্য এ প্রতিযোগিতা ছিল জীবনের অন্যতম মাইলফলক অর্জন। আমাদের দলের ৩৬তম লেগ দৌড়ানো এমরাদ ভাই ফিনিশিং লাইন অতিক্রম করে বলেন, ‘কখনো ভাবিনি এত লম্বা দৌড় সম্ভব হবে আমাকে দিয়ে। আজ আমার স্বপ্ন সত্যি হলো। আত্মবিশ্বাসের পারদ উঠেছে অনেক ওপরে। আমিও পারি, আমরা সবাই পারি। শুধু প্রয়োজন ইচ্ছা আর প্রচণ্ড মনোবল।’
অন্যদিকে কোনো এক লেগে এক দেশি আপুর থেকে পিছিয়ে পড়ে সাকিব ভাই পণ করেছেন, ‘পরেরবার সবচেয়ে কঠিন লেগগুলো (লেগ ১৯ ও ২০) আমি দৌড়াব। দৌড় শেষে সিএনএনে সাক্ষাৎকার দেব।’
মজার মজার কথা বলে পুরো পথে আমাদের ভ্যান মাতিয়ে রেখেছিলেন সাকিব ভাই। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমাদের পুরো যাত্রা ছিল পিকনিকের আমেজে। প্রতিযোগিতা শেষ হতে না হতেই তৌফিক ভাই ঘোষণা দিলেন, ডিসেম্বেরে নামবেন হাফ ম্যারাথনে। বোঝা যাচ্ছে, ম্যারাথন শুধু একটি প্রতিযোগিতা নয়। ফিটনেসে আগ্রহীদের জন্য এটি এক বিশাল উৎসব। আনন্দের উৎসব। ফিটনেস উন্নতি করার উৎসব।
*লেখক: হাশেম মোহাম্মদ, প্রসেস ইঞ্জিনিয়ার, ইনটেল করপোরেশন, পোর্টল্যান্ড, ওরেগন, যুক্তরাষ্ট্র