বাংলাদেশের দুর্নীতি: চরিত্রের পরিবর্তন, শাসনব্যবস্থার প্রভাব এবং প্রতিরোধের উপায়

দুর্নীতিপ্রতীকী ছবি

বাংলাদেশে দুর্নীতি আজ এক গভীর সামাজিক ব্যাধি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। রাষ্ট্রের প্রায় সব স্তরে দুর্নীতির বিস্তার দেশের উন্নয়ন, সুশাসন ও সামাজিক ভারসাম্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে দুর্নীতি প্রতিরোধে মানুষের চরিত্রের পরিবর্তন এবং শাসনব্যবস্থার সংস্কার অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। দুর্নীতির প্রেক্ষাপটে মানুষের চরিত্রের পরিবর্তন কীভাবে সম্ভব, তা নিয়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ যুক্তি ও গঠনমূলক ব্যাখ্যা তুলে ধরা হলো।

দুর্নীতির বর্তমান পটভূমি

বাংলাদেশে দুর্নীতি একটি দীর্ঘস্থায়ী এবং বহুল আলোচিত সমস্যা। সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করেছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও প্রশাসনিক কাঠামোতেও এর নেতিবাচক প্রভাব লক্ষ করা যায়। আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশ দুর্নীতির সূচকে উচ্চ অবস্থানে রয়েছে, যা দেশের জন্য একটি অশুভ সংকেত।

দুর্নীতির পেছনের কারণগুলো—

বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে দুর্নীতির পেছনে কয়েকটি মৌলিক কারণ বিদ্যমান

১.

একতরফা শাসনব্যবস্থা ও ক্ষমতার অপব্যবহার: ক্ষমতার অপব্যবহার ও একতরফা শাসনব্যবস্থায় জবাবদিহি ও স্বচ্ছতার অভাব দুর্নীতির সুযোগ সৃষ্টি করে। যখন একটি দেশের শাসনব্যবস্থা একতরফা হয়ে যায়, তখন ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ ঘটে এবং দুর্নীতি বাড়ে।

২.

নৈতিক অবক্ষয় এবং সামাজিক মূল্যবোধের অভাব: নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধের অভাবে অনেকেই ব্যক্তিগত স্বার্থে দুর্নীতিতে লিপ্ত হন। ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী তাদের স্বার্থ রক্ষায় প্রতিপক্ষের সঙ্গে প্রতিহিংসামূলক আচরণ করে এবং চাটুকারিতা ও তোষামোদকে উৎসাহিত করে।

৩.

স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাব: প্রশাসনিক ও সরকারি কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির অভাব দুর্নীতির প্রবণতাকে বাড়িয়ে দেয়। জবাবদিহি না থাকায় দুর্নীতি বাড়ে এবং প্রশাসনিক কাঠামো দুর্বল হয়ে পড়ে।

৪.

অর্থ পাচার ও প্রতিহিংসার রাজনীতি: দুর্নীতির ফলে অর্থ পাচার একটি গুরুতর সমস্যা। ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার করা হচ্ছে, যা দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তিকে দুর্বল করছে। এ ধরনের প্রতিহিংসাপূর্ণ রাজনীতি দুর্নীতির পরিমাণ আরও বাড়ায়।

দুর্নীতি প্রতিরোধে চরিত্রের পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা

দুর্নীতি প্রতিরোধে মানুষের চরিত্রের পরিবর্তন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, মানুষের চিন্তাধারা ও মূল্যবোধই তাদের কার্যক্রমকে প্রভাবিত করে। চরিত্র পরিবর্তনের মাধ্যমে দুর্নীতি প্রতিরোধের জন্য কিছু কার্যকর উপায়:

১. নৈতিক শিক্ষা ও নৈতিকতার উন্নয়ন: শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা উচিত। নৈতিকতা ও মূল্যবোধ শিক্ষাপ্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

২. সুশাসন ও স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণ: প্রশাসনিক ব্যবস্থায় সুশাসন ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির বিধান এবং জনগণের ন্যায্য অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।

৩. আইন ও শাস্তির কার্যকর প্রয়োগ: দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর আইন প্রয়োগ এবং দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে প্রশাসনের ক্ষমতা ব্যবহারে স্বচ্ছতা প্রয়োজন।

৪. গণসচেতনতা বৃদ্ধি: দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনগণকে সচেতন করতে হবে এবং তাঁদের মধ্যে সামাজিক দায়িত্বের বোধ জাগ্রত করতে হবে। গণমাধ্যম, সাহিত্য ও সংস্কৃতির মাধ্যমে ইতিবাচক মূল্যবোধ প্রচার করা উচিত।

৫. নেতৃত্বের ইতিবাচক ভূমিকা: নেতৃত্বের ক্ষেত্রে নৈতিক ও আদর্শমূলক ব্যক্তিত্বের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নেতৃত্বে যাঁরা সততা, স্বচ্ছতা ও নৈতিকতা বজায় রাখবেন, তাঁদের অনুসরণ করা উচিত।

৬. প্রযুক্তির ব্যবহার: দুর্নীতি প্রতিরোধে প্রযুক্তির ব্যবহার, যেমন ডিজিটালাইজেশন এবং ই-গভর্ন্যান্স একটি কার্যকর উপায় হতে পারে। তথ্যপ্রযুক্তির সাহায্যে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা যেতে পারে।

৭. আন্তর্জাতিক সহযোগিতা: দুর্নীতি প্রতিরোধে আন্তর্জাতিক সংস্থার সহযোগিতা এবং বৈশ্বিক মানদণ্ড অনুসরণ করা প্রয়োজন।

৮. নাগরিক সমাজের ভূমিকা: দুর্নীতি প্রতিরোধে নাগরিক সমাজের সংগঠন, গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।

বাংলাদেশের মতো একটি দেশে, যেখানে দুর্নীতি একটি গভীর সামাজিক ব্যাধি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেখানে মানুষের চরিত্রের পরিবর্তন এবং শাসনব্যবস্থার সংস্কার অপরিহার্য। নৈতিক শিক্ষা, সুশাসন, আইনের কার্যকর প্রয়োগ, প্রযুক্তির ব্যবহার এবং সামাজিক সচেতনতা একসঙ্গে মিলে একটি দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়ে তুলতে সহায়ক হবে। মানুষের চরিত্রের পরিবর্তনের মাধ্যমে একটি সুশীল সমাজ গড়ে তোলাই বর্তমান পরিস্থিতিতে সবচেয়ে কার্যকর ও সময়োপযোগী সমাধান হতে পারে। দুর্নীতি প্রতিরোধে আমাদের সবার সম্মিলিত প্রয়াসের মাধ্যমে একটি সৎ, স্বচ্ছ ও নৈতিক বাংলাদেশ গড়ে তোলার স্বপ্ন পূরণ সম্ভব।

*লেখক: রহমান মৃধা, সুইডেন। [email protected]

**দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]