গ্যালারিতে বসা রাজনৈতিক দর্শকেরাই ভালো বোঝেন?
ছোটবেলা থেকেই ফুটবলের আসক্ত ছিলাম। ঢাকা মোহামেডানের সমর্থক ছিলাম। পারতপক্ষে মোহামেডানের কোনো খেলা কখনো না দেখে রাতে ঘুমাতে পারতাম না। আমরা দর্শক হিসেবে খেলা দেখতাম বৈকি। খেলার কলাকৌশল এবং মাঠের ট্যাকটিক্যাল দিকগুলো স্বাভাবিকভাবেই টিমের কোচ দেখবেন। তারই দায়িত্ব। তিনিই ফলাফলের দায়দায়িত্ব নেন। এটাই কার্যত হয়ে আসছে দেশে–বিদেশে এবং ক্রীড়া অঙ্গনে।
মজার ব্যাপার হলো দর্শকেরা, যে দলেরই হোক না কেন, তারা গ্যালারি থেকে নিজ দলকে পরিচালনা করতে বা বিভিন্ন ধরনের কলাকৌশল দেখিয়ে দিতে কখনোই পিছপা হন না। আসলে গ্যালারি থেকেই খেলাকে ভালোভাবে দেখা যায় এবং নিজ দলের যাবতীয় ভুলত্রুটি দেখে কলাকৌশল বাৎচিতে সহজ। এমনকি দর্শকেরা বিপক্ষ দলের কৌশল ধরে ফেলে নিজ দলকে সেটা মোকাবিলা করার পরামর্শও দিতে পারেন এবং দেনও বৈকি। টিভি দর্শকেরা নিশ্চয়ই গ্যালারি থেকে বিস্তর চিৎকার ও চেঁচামেচি শুনেছেন? সমস্যা হলো দর্শকদের পরামর্শ আর হইহুল্লোড় সাইড লাইনে থাকা কোচের কাছে কখনোই পৌঁছায় না। খেলোয়াড়দের কাছে যাওয়া তো প্রশ্নই আসে না।
বার্সেলোনায় ক্যাম্প-নু–তে প্রায় ১ লাখ দর্শকের স্থান রয়েছে। বার্সেলোনার খেলা হলে মাঠে তিল ধারণের জায়গা থাকে না। ম্যানচেষ্টার ইউনাইটেডের মাঠ ওল্ড ট্রাফোর্ডে দর্শক স্থান রয়েছে ৭৬ হাজার। এখানেও তিল ধারণের জায়গা থাকে না এমইউর খেলা চললে। পৃথিবীর বিভিন্ন স্টেডিয়ামে এভাবে প্রতিনিয়ত খেলা দেখছেন মিলিয়ন মিলিয়ন দর্শক। আর চিৎকার–চেঁচামেচি করে করে জানান দিচ্ছেন মাঠে খেলোয়াড়দের কীভাবে খেলা উচিত। মাঝেমধ্যে চিৎকার–চেঁচামেচি হিংসাত্মক পর্যায়ে চলে যায়। মাঠে বা মাঠের বাইরে এর চিত্র ফুটে ওঠে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে হিংসার ফলে হত্যাকাণ্ডও ঘটে।
এসব কিছুই প্রচন্ড আবেগ আর আবেগ প্রবণতার ফসল। রাজনীতির মাঠেও আজকাল খেলা চলছে ভালো। ঘরে ঘরে আজ স্টেডিয়াম। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের যুগে রাজনীতির দর্শকেরা ভাষণ শুনতে, চিৎকার–চেঁচামেচি করতে, স্লোগান দিতে আর ময়দানে যান না। ময়দানে যাওয়ার জন্য আজ তাই ভাড়া করা লোকের প্রয়োজন পড়ে। তবে খেলার মাঠের দর্শকের মতো খেলা সম্পর্কে মতামত, কলাকৌশল বাতলে দেওয়ার রেওয়াজ কিন্তু রাজনীতির মাঠেও আছে। ইট–সিমেন্টের গ্যালারি পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আজ সোফা, চেয়ার, টুল বা মোড়ায় পরিবর্তিত হয়েছে। ময়দান আজ গিয়ে উঠেছে টিভি চ্যানেলে, ইউটিউব চ্যানেলে, ফেসবুকে বা এক্স–এ। আছে টক শো, সম্পাদকীয় বা রাজনৈতিক বিশ্লেষণ।
ফুটবল মাঠের দর্শক ছিলেন লাখের কাতারে। ডিজিটাল যুগে রাজনৈতিক দর্শকের সংখ্যা মিলিয়ন, বিলিয়ন বা আরও ওপরে। স্মার্টফোন, ছোট বা বড় পর্দার টিভি, কম্পিউটার ইত্যাদি থাকলেই আজকাল সাংবাদিক, ফটোসাংবাদিক, তর্কবাগীশ বা বিশেষজ্ঞ হওয়া যাচ্ছে অতি সহজেই। জ্ঞান বা অভিজ্ঞতার প্রয়োজন পড়ছে না আর। সে জ্ঞানের মাপকাঠিও আর নেই।
কাজে কাজেই ডিজিটাল গ্যালারিতে বসে অফুরন্ত চিৎকার, চেঁচামেচি, মন্তব্য আর পরামর্শ দেওয়ার কমতি হচ্ছে না। বরং সেটার আকার ও প্রকার দুটোর স্বাস্থ্যই দিন দিন বিস্তৃত হচ্ছে। প্রবৃদ্ধিও বাড়ছে বৈ কমছে না।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ফলে স্বৈরাচার সরকার পরিবর্তনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বয়স মাত্র দুই মাস যাওয়ার আগেই বিভিন্ন গ্যালারিতে বসা দর্শকদের চিৎকার, চেঁচামেচি, মন্তব্য আর পরামর্শ দেওয়ার আকার ও ধরন দেখে ভাবতে ভালো লাগছে যে স্বদেশ নিয়ে পরামর্শ দেওয়ার বিশেষজ্ঞ অগুনতি। দেশে কি বিদেশে বিশেষজ্ঞদের কমতি নেই। আলোচনা, মন্তব্য, বিশ্লেষণ ও পরামর্শ, ইত্যাদির ধরন দেখে মনেই হয়নি বাংলাদেশে গত ১৫ বছরে কোনো স্বৈরাচার সরকার তার মুগুর চালিয়েছে। কারণ, এমনতর ধারালো, ক্ষীণ ও জ্ঞানসমৃদ্ধ বিশ্লেষণ করার মতো বিশেষজ্ঞ থাকা সত্ত্বেও স্বৈরাচার কীভাবে অব্যাহত থেকেছে?
একটি বিশেষ লক্ষণীয় দিক হলো, ডিজিটাল গ্যালারির বিশেষজ্ঞরা যেন প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। কে কাকে ছাড়িয়ে নিজ তত্ত্বকে একমাত্র উপাত্ত বলে জাহির করবেন, সেটার চেষ্টায় রত থাকছেন অবিরত। কেউবা নিজেকে ছায়া সরকারে ভাবছেন, কেউবা নিজেকে সরকারের প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবছেন, আবার অনেকেই সরকারের একমাত্র পরামর্শদাতা বলে ভাবছেন।
ডিজিটাল দর্শক বা সমালোচকদের অনেকেই আবার মেরুদণ্ড টুইস্ট করতে একটুও দ্বিধা করেন না। সময় বুঝে ওনারা সে সুযোগটা নিয়ে নেন। গ্যালারিতে বসা দর্শকদের জন্য মেরুদণ্ড টুইস্ট করা ছিল আত্মহত্যার শামিল। সেখানে অ্যাকশনটা সঙ্গে সঙ্গেই হয়ে যেত। মোহামেডানের গ্যালারিতে বসে ভুলক্রমেও যদি আপনি আবাহনীর পক্ষে হাততালি দিয়ে বসেন, তাহলে নির্ঘাত হাসপাতাল গমন। ডিজিটাল গ্যালারিতে থাকার সুবিধা মেরুদণ্ড টুইস্ট করা দর্শকেরা ভালোই কাজে লাগাচ্ছেন। সুবিধা হলো ওনাদের দেখা যায় না, ছোঁয়া যায় না। কেউ দেশে, কেউ প্রবাসে, কেউ দুই জায়গায়ই আছেন। ইদানীং দেখা যাচ্ছে মেরুদণ্ড টুইস্টকারীরা কখনো ‘বিপক্ষে’ আবার সময় বুঝে ‘পক্ষে’ থাকার সংহতি প্রকাশ করছেন। অনেকেই ডিজিটাল ফটো গ্যালারি খুঁজে বের করছেন মানানসই ছবি। সে ছবি মানানসই প্রস্তাব বা পরামর্শের সঙ্গে সংযোগ করে মেরুদণ্ড টুইস্ট করাটাকে একটু আড়াল করার বৃথা চেষ্টা করছেন। এটাও একধরনের ডিজিটাল ব্যালান্স!
ঘণ্টা, মিনিট আর সেকেন্ডের হিসাবে অগুনতি বিশেষজ্ঞ ও পরামর্শদাতাদের কথা শুনতে হলে আমার প্রাথমিক হিসাবে বর্তমান সরকারের প্রতিজন সদস্যকে প্রতিদিন কমপক্ষে ১০০ ঘণ্টা করে সময় দিতে হবে। আমরা জানি দিনে ২৪ ঘণ্টা! বাকি ৭৬ ঘণ্টা কোথা থেকে ধার করা হবে? আর সরকারি কার্যক্রম? বিশ্রাম?
সুখের কথা, বর্তমান সরকার কাউকে বিমুখ করেননি এখন পর্যন্ত। সবার মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে ধৈর্য ধরে হয়তোবা শুনছেন ডিজিটাল দর্শক ও বিশেষজ্ঞদের মতামত, বিশ্লেষণ ও পরামর্শ। কিছু কিছু ক্ষেত্রে হয়তোবা শুনছেন এবং কাজও করছেন পরামর্শদাতাদের মতামত অনুযায়ী। আশা করি দেশে ও প্রবাসে বসবাসকারী ডিজিটাল দর্শকেরা তাঁদের চ্যানেলগুলোতে মন্তব্য আর পরামর্শ দেওয়ার ক্ষেত্রে একটু সংযত হবেন। আপনার মন্তব্যই বা বিশ্লেষণটিই সত্যি বা সঠিক, সেটা না–ও হতে পারে। আপনিই একমাত্র যুধিষ্টির, সেটা হয়তো ঠিক নয়। যুধিষ্ঠির আরও রয়েছে বা থাকতে পারে।
মরুভূমিতে দূর থেকে দেখে পানি মনে হলেও কাছে গেলে দেখবেন সেটা মরীচিকা!
*লেখক: কামরুল ইসলাম, স্টকহোম, সুইডেন
দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]