পঞ্চব্রীহি: ধান চাষে বাংলাদেশি বিজ্ঞানীর যুগান্তকারী আবিষ্কার

অনুষ্ঠানে পঞ্চব্রীহি আবিষ্কারের ইতিহাস উপস্থাপন করছেন আবেদ চৌধুরী
ছবি: সংগৃহীত

ফলন শেষ হওয়ার পর একটি ধানগাছ পুরোপুরি না কেটে ওই একই গাছে বিভিন্ন মৌসুমে আরও চারবার একই ধান উৎপাদনের পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন বাংলাদেশি বিজ্ঞানী ডক্টর আবেদ চৌধুরী। তিনি তাঁর এ আবিষ্কারের নাম দিয়েছেন ‘পঞ্চব্রীহি’। ১২ অক্টোবর লন্ডন-বাংলা প্রেসক্লাব আয়োজিত ‘খাদ্যনিরাপত্তা ও মানবস্বাস্থ্য’ শীর্ষক এক বিশেষ বক্তৃতা অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের এ আবিষ্কারের কথা জানান তিনি।

ফি বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত, বন্যাপ্রবণ ও খরাপীড়িত দেশের ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর খাদ্যসংকট দূরীকরণে নিঃসন্দেহে এটি একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার। ডক্টর আবেদ চৌধুরীর ভাষায়, ‘এ নতুন ধান চাষ পদ্ধতি যদি সারা দেশের কৃষকদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া যায়, তাহলে আগামী ৫০ বছরের জন্য গোটা জনগোষ্ঠীর খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব’।

আবেদ চৌধুরী জানান, মৌলভিবাজারের কানিহাটি গ্রামের কৃষকদের সঙ্গে নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে মাঠপর্যায়ে গবেষণা করে কোনোরকম  রাসায়নিক ছাড়াই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির মাধ্যমে বহু প্রজাতির ধানের মিশ্রণ ঘটিয়ে তিনি এমন একটি ধান আবিষ্কার করেছেন, যা চাষের জন্য নতুন করে পাঁচ রকমের ধানগাছ রোপণ করতে হবে না। এতে কৃষকের সময় যেমন বাঁচবে, তেমনি সাশ্রয় হবে অর্থও। একইসঙ্গে একই জমিতে একই গাছে পাঁচবার ধান উৎপাদনের ফলে দূর হবে দেশের খাদ্যসংকট।

পূর্ব লন্ডনের এন্টারপ্রাইজ একাডেমি মিলনায়তনে আয়োজিত মতবিনিময় সভায় আবেদ চৌধুরী তাঁর এ আবিষ্কারের কাহিনি উপস্থাপনের পর গভীর মনযোগের সঙ্গে এ নিয়ে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্ন শোনেন এবং প্রতিটি প্রশ্নের সুনির্দিষ্ট উত্তর দেন।

এ নতুন ধান উৎপাদন পদ্ধতি বাণিজ্যিক উপায়ে ব্যবহার করা হবে, নাকি সাধারণের মধ্যে বিনা মূল্যে ছড়িয়ে দেওয়া হবে—এ প্রশ্নের উত্তরে আবেদন চৌধুরী বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে অনেক চিন্তা-ভাবনা শেষে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমার এ আবিষ্কারকে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করব না, আমি এটিকে সহজলভ্য করে দেব আমার দেশের দরিদ্র কৃষকদের জন্য।’

আবেদ চৌধুরী আরও বলেন, ‘আমার এ আবিষ্কারের গবেষণাগার হলো প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত মৌলভিবাজারের কানিহাটি গ্রাম, যে গ্রামে আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। সেখানে আমার গবেষণার সহযোগী ছিলেন স্বল্পশিক্ষিত, নিরক্ষর কৃষক যাঁদের গায়ে লেগে থাকে বাংলার জল-কাদার গন্ধ। তাঁরা দীর্ঘদিন ধরে মাঠপর্যায়ের গবেষণায় দিনরাত আমাকে সহযোগিতা করেছেন। তাঁদের বুকে মিশে আছে ধর্ম ও বিজ্ঞান।

এসব নিরক্ষর, সরলপ্রাণ, দেশপ্রেমিক কৃষককে সঙ্গে নিয়ে আমি বিশ্বকে উপহার দিতে চাই উৎপাদনের শ্রেষ্ঠতম বিজ্ঞান। আমি বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে আমার আবিষ্কার ব্যবহার করতে চাই না। আমি চাই আমার এ আবিষ্কার দেশের মানুষের জীবনমান বদলে দিক। খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত হোক আমার মাতৃভূমির মানুষের জন্য।’

উল্লেখ্য ‘পঞ্চব্রীহি’ চাষের মাধ্যমে একটি ধানগাছ থেকে বোরো মৌসুমে একটি এবং আমন ও আউশ মৌসুমে দুটি করে মোট পাঁচটি ফলন পাওয়া সম্ভব।

প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক তাইসির মাহমুদের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োলজির অধ্যাপক হিউ ডিকিনসন, স্বাস্থ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক বাণিজ্যিক সংস্থা জেনোফ্যাক্সের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) জাহাঙ্গীর আলম। শুরুতে শুভেচ্ছা বক্তব্যে অতিথিদের অভ্যর্থনা জানান ক্লাবের সভাপতি মোহাম্মদ এমদাদুল হক চৌধুরী।

হিউ ডিকসন বলেন, ‘৩০ বছর পর পূর্ব লন্ডনে বাঙালি অধ্যুষিত এলাকায় আসতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করছি। এখানে বাঙালিরা যেভাবে জীবনের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে, তা দেখে আমি খুব অভিভূত, আমি অভিভূত এখানকার পরিবর্তন দেখে।’ তিনি আবেদ চৌধুরীর আবিষ্কারের ভূয়সী প্রশংসা করেন। উল্লেখ্য, অধ্যাপক হিউ ডিকিনসন ১৯৭৮ সালে ছাত্রাবস্থায় বাঙালিদের ‘ব্যাটল অব ব্রিকলেন’ আন্দোলনে সক্রীয়ভাবে যুক্ত ছিলেন।

জেনোফ্যাক্সের সিইও জাহাঙ্গীর আলম কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল টেকনোলজি (এ আই) ব্যবহার করে মানুষের ‘জেনেটিক ডাটা’ সংগ্রহ করে এর বিশদ বিশ্লেষণের মাধ্যমে সুস্বাস্থ্য রক্ষায় জেনোফ্যাক্স কীভাবে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে— সাংবাদিকদের কাছে তা তুলে ধরেন।

এর আগে আবেদ চৌধুরী, হিউ ডিকিনসন ও জাহাঙ্গীর আলম লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাবের কার্যালয় পরিদর্শন করেন।

লেখক: লন্ডনপ্রবাসী কবি