কিয়োটা থেকে বাকু—কেউ কথা রাখেনি!
‘আপনি যে শব্দটি শুনতে পাচ্ছেন, তা হলো ঘড়ির টিকিং। আমরা বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমাবদ্ধ করার চূড়ান্ত কাউন্টডাউনে রয়েছি। সময় আমাদের পক্ষে নয়।’ এ অনিশ্চয়তার মধ্যে আজারবাইজানের বাকুতে জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলনে প্রতিনিধিদের উদ্দেশে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এ কথা বলেন।
২০০১ সালে প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ জাপানে অনুষ্ঠিত ‘কিয়োটা প্রটোকল’কে ছুড়ে ফেলেছিলেন, যেখানে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের জন্য দায়ী গ্রিনহাউস গ্যাসের নিঃসরণ হ্রাসে শিল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ করে দিয়েছিল। এরই মধ্যে ট্রাম্প প্যারিস জলবায়ু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, যেমনটি তিনি তাঁর প্রথম মেয়াদে করেছিলেন। ট্রাম্প চুক্তিটিকে ‘সম্পূর্ণ বিপর্যয়’ বলে অভিহিত করেছেন। তবে তাঁর প্রশাসন জীবাশ্ম জ্বালানি শিল্পকে লক্ষ্য করে আরও কয়েক ডজন জলবায়ুনীতির সঙ্গে মিথেন নিয়ম বাতিল করবে বলে আশা করা হচ্ছে। লেম ডাক (খোঁড়া হাঁস) বাইডেন প্রশাসন শেষ সময়ে কীই–বা করতে পারবেন। একটি নীতির ক্ষেত্রে যেখানে প্রেসিডেন্টের ব্যাপক পরিবর্তন করার ক্ষমতা রয়েছে। সেখানে ট্রাম্পের পরিকল্পনায় বিশ্বের জলবায়ু লক্ষ্যগুলোকে হুমকির মুখে ফেলে জীবাশ্ম জ্বালানি কোম্পানিগুলোর মুনাফা বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে বলে খোদ যুক্তরাষ্ট্রে সমালোচনা সক্রিয়।
এদিকে বাকু সম্মেলনে পরিবেশ সুরক্ষা সংস্থার কর্মকর্তারা একটি নতুন নিয়ম চূড়ান্ত করে ঘোষণা করেছেন, পৃথিবীর শিল্পোন্নত দেশগুলোর তেল ও গ্যাস কোম্পানিগুলোকে (মিথেনের নির্গমন) একটি শক্তিশালী গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গত করার জন্য প্রথমবারের মতো ফি দিতে হবে। ২০২৪ সালে প্রতি মেট্রিক টন নির্গমনের ফি ৯০০ ডলার থেকে শুরু, যা ২০২৫ সালে ১ হাজার ২০০ ডলার এবং ২০২৬ সালে ১ হাজার ৫০০ ডলারে বৃদ্ধি পাবে। যদিও ফি ২০৩৫ সাল পর্যন্ত কার্যকর থাকবে। ইউএস এনভায়নরমেন্ট প্রটেকশন এজেন্সির প্রশাসক মাইকেল রেগান গত মঙ্গলবার বলেছেন, এটি তেল ও গ্যাস সেক্টরে দক্ষতা বাড়াবে, আমেরিকান চাকরির ক্ষেত্র বাড়বে, বিশুদ্ধ বাতাস রক্ষা করবে এবং বিশ্বমঞ্চে মার্কিন নেতৃত্বকে শক্তিশালী করবে। এতে ১ দশমিক ২ মিলিয়ন মেট্রিক টন মিথেন বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করতে বাধা দেবে।
বিজ্ঞানীরা গত মঙ্গলবার (১২ নভেম্বর) বলেছেন, গ্যাস সীমিত করার বৈশ্বিক প্রতিশ্রুতি অমান্য করে এবং পৃথিবীকে বিপজ্জনক তাপমাত্রা বৃদ্ধির পথে নিয়ে যাচ্ছে। কারণ, মিথেন ১০০ বছরের সময়সীমায় কার্বন ডাই–অক্সাইডের চেয়ে প্রায় ৩০ গুণ বেশি তাপ আটকে রাখে, গ্লোবাল কার্বন প্রকল্পের গবেষকেরা বলেছেন, ২০২১ সাল থেকে ১৫০টিরও বেশি দেশ এ দশকের শেষ নাগাদ গ্যাসের নির্গমন ৩০ শতাংশ কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
আন্তর্জাতিক শক্তি সংস্থার মতে, শিল্পবিপ্লব শুরু হওয়ার পর থেকে বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রায় এক–তৃতীয়াংশের জন্য মিথেন দায়ী। যদিও এটি কার্বন ডাই–অক্সাইডের চেয়ে দ্রুত ভেঙে যায়, তবে এটি স্বল্প মেয়াদে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রায় ৪০ গুণ বেশি তাপ আটকে যায়।
সিওপি-২৯ সভাপতি মুখতার বাবায়েভ প্রতিনিধিদের বলেছেন, ‘আমরা ভুল পথে এগোচ্ছি। গ্লাসগোতে বিশ্ব জলবায়ু আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন গ্লোবাল মিথেন প্রতিশ্রুতি চালু করার তিন বছর পরও বিশ্বের বৃহত্তম মিথেন নির্গমনকারী—চীন, ভারত, রাশিয়াসহ দেশগুলো এখনো স্বাক্ষর করতে পারেনি। যে কারণে বায়ুমণ্ডলে মিথেনের ঘনত্ব ক্রমাগত বাড়তে থাকে, যার কোনো শেষ দেখা যায় না। গ্লোবাল মিথেন প্রতিশ্রুতি চালু হওয়ার পর থেকে মিথেন নির্গমন আরও বেড়েছে। দুবাইয়ে গত বছরের ইউএন ক্লাইমেট চেঞ্জ কনফারেন্সে রেগান তেল ও গ্যাস অপারেশন থেকে মিথেন নির্গমনকে আরও রোধ করার উদ্দেশ্যে পৃথক প্রবিধান ঘোষণা করেছিলেন।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় স্যাটেলাইট পরিমাপগুলো প্রকাশ করেছে যে মিথেন নির্গমন ২০২০ ও ২০২৩–এর মধ্যে অতিরিক্ত ৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, চীন, দক্ষিণ এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। শুধু ইউরোপীয় ইউনিয়নই গত দুই দশকে অর্থপূর্ণভাবে মিথেন নির্গমন কমিয়েছে। প্রসঙ্গত, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বিবেচনায় কার্বন ডাই–অক্সাইডের চেয়েও বেশি ক্ষতিকর হাইড্রোফ্লুরোকার্বন। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই, যদি ডোনাল্ড ট্রাম্পের ‘নতুন আমেরিকা’ আগের অবস্থানে থাকে, তাহলে দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণকারী দেশটি আর কোনো নিয়মতান্ত্রিক খেলায় আইনি কাঠামোয় ফিরে আসবে না। বিশ্বের সর্বোচ্চ গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণকারী দেশ চীনের চুক্তি ভঙের আশঙ্কা ক্ষীণ। যেহেতু চীন তার দেশে দূষণ ও নিঃসরণ হ্রাসে ব্যাপকভাবে কর্মসূচি চালিয়ে রেখেছে। ভারতের সামনে রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত নানা ধরনের ঝুঁকি ও সমস্যা। মৌসুমি বায়ুর ওপর প্রভাব, আবহাওয়ার চরম বৈরী আচরণ, সাত হাজার কিলোমিটার উপকূলীয় এলাকায় সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, বনাঞ্চল ধ্বংসের প্রভাবে ভূমিধস, যা বনায়ন কার্যক্রমের মাধ্যমে এর ক্ষতিপূরণ সম্ভব নয়, হিমালয়ের অধিকাংশ এলাকার হিমবাহ গলে যাওয়া, ভাঙনে ভাটি অঞ্চল বাংলাদেশেও এর চরম প্রভাবে নদীর গতিপথ অস্তিত্বের সমম্মুখীন হবে। এ ক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বাংলাদেশের জাতীয় পরিকল্পনায় দ্রুত সৌরশক্তিতে সক্ষমতা অর্জন জরুরি। গিগাওয়াটের পেছনে না ছুটে কিলোওয়াটের দিকে মনোনিবেশ সময়ের প্রয়োজন। বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণপ্রক্রিয়ায় বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে সামাজিক রূপান্তর সম্ভব। কয়লাভিত্তিক উৎপাদনের প্রযুক্তি যুক্ত হলেও আগামী দশকের মধ্যে এর ব্যবহারের বিষয়টি জাতীয় বোঝা হিসেবে দেখা দিতে পারে। সব দিক বিবেচনায় এনে আমাদের মতো ছোট ছোট দেশে সর্বস্তরে পরিবেশ আইন কার্যকর করা উচিত। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন নিয়ন্ত্রণে বৈশ্বিক লক্ষ্য অর্জনে আঞ্চলিক ও বিশ্ব পরিসরে যোগাযোগ ও সহযোগিতার বিকল্প নেই।