গ্রামের মানুষ প্রাণের মানুষ

গ্রামেই আমাদের সবার শিকড় গ্রথিত

গ্রামের মানুষদের সবচেয়ে ভালো ব্যাপার হচ্ছে এরা, মুখে ও মনে সব সময়ই একই কথা বলে। মানে, যেটা সে অন্তরে ধারণ করবে, মুখেও সেটাই বলবে, তা শুনতে যতই তিক্ত লাগুক না কেন। আপনার কোনো আচরণ তাঁদের পছন্দ হলো না, সেটা আপনার সামনেই ঠাস করে বলে দেবে। আবার আপনার কোনো কিছু ভালো লাগলেও সেটাও অসংকোচে সবার সামনেই প্রকাশ করবে। আপনি যদি কোনো কারণে তাঁদের মন একবার জয় করতে পারেন, তিনি সারা জীবনের জন্য আপনার ভালো চাইবেন। তবে অনুভূতিগুলো প্রকাশের ভাষাটা হয়তো ব্যাকরণশুদ্ধ হবে না। কিন্তু সেই ভাষা তাঁর মায়ের ভাষা, যেটা জন্মের পর থেকে তাঁর মায়ের মুখে শুনে এসেছেন। যে ভাষাতে তাঁর মায়ের কাছে বায়না ধরেছেন, যে ভাষাতে তাঁর মা তাঁকে শাসন করেছেন। কিন্তু শহরের মানুষ খুব সুন্দর, পরিমার্জিত ও ব্যাকরণশুদ্ধ ভাষায় সামনাসামনি আপনার প্রশংসা করবে আর আপনি পেছন ফিরলেই এমন ভাষায় আপনাকে গালি দেবে, যেটা গ্রামের ওই মানুষদের ভাষার চেয়ে হাজার গুণ খারাপ ভাষা। আর যদি আপনি তাঁর স্বার্থে সামান্যতম ভাগ বসান, সুযোগ পেলেই আপনার তেরোটা-চৌদ্দটা বাজানোর তালে থাকবেন, তা আপনি যতই তাঁর কাছের মানুষ, আত্মীয় বা বন্ধু হন না কেন। যদি কোনো প্রতিযোগিতায় আপনি তাঁর প্রতিযোগী হন, তাহলে তো কথাই নেই, তিনি আপনাকে খুন করতে পর্যন্ত দুই পায়ে খাড়া।

গ্রামের অকৃত্রিম জীবনধারা

শৈশবে আমার কাছে সবচেয়ে মধুর ডাক ছিল, ‘শালা’। কারণ, আমার দাদির বাবারা সাত ভাই আর তাঁদের প্রায় প্রত্যেকেরই ১০-১২ জন করে ছেলেমেয়ে। আমাদের পাড়ার আশপাশে যে বাকি ছয়টি পাড়া ছিল, তার একেকটি ছিল তাঁদের দখলে। আর আমার সেসব দাদা আমাকে সব সময়ই শালা বলে সম্বোধন করতেন। দেখা হলেই কান ধরে বলে উঠতেন, ‘শালা, দুলাভাই বল, নাহলে কান ছাড়ব না।’ আমি বলতাম, আমার তো বোন নেই। ‘বোন নেই তো কী হয়েছে, আগে দুলাভাই বল, তারপর অন্য কথা।’ তারপর দুলাভাই বলে তাঁদের কাছ থেকে ছাড়া পেতাম। এ ছাড়া দেখা হলে বলতেন, ‘দুলাভাই বল, তাহলে চকলেট পাবি’ এবং দুলাভাই বললে সত্যি সত্যি তাঁরা চকলেট দিতেন। দাদাদের কেউ আমাকে নাম ধরে ডেকেছেন বলে মনে পড়ে না। আমি হয়ে গিয়েছিলাম গণশালা। আহা, কী মধুর সেই ডাক, কত দিন শুনি না?

গ্রামের অকৃত্রিম আনন্দের উৎস

পাড়ার দাদিরা এবং দাদার বউয়েরা (তাঁদেরও আমি দাদি বলে সম্বোধন করতাম) আমাকে সম্বোধন করতেন ‘মিনসে’ বলে। দেখা হলেই বলতেন, ‘কি রে মিনসে? বউ নিবি না?’ শুনে আমার কালো কান খয়েরি বর্ণ ধারণ করত। কান খয়েরি হওয়ার আরও একটা কারণ ছিল। সেটা হলো, আমার এই সব গ্রাম্য দাদিরা একজনের থেকে একজন ছিলেন অপরূপা সুন্দরী। শৈশবে আমার খেলার এবং সব অপকর্মের সাথি ছিল আমার ফুফাত ভাই আনোয়ার। আমরা দুজনে মিলে পাড়ায় একপ্রকার ত্রাস সৃষ্টি করেছিলাম। আবার উল্টো দিক থেকে দেখলে, আমরা দুজন ছিলাম সবচেয়ে আদরেরও। আমরা কী কী অপকর্ম করেছিলাম, সেগুলো ভদ্রসমাজে শেয়ার করতে চাচ্ছি না। শুধু একটা শাস্তির বর্ণনা দিলে বোঝা যাবে আমরা তাঁদের কী পরিমাণ বিরক্ত করতাম। একবার সেজ বড় আব্বার তিন ব্যাটার বউ আমাদের দুজনকে খড়ের পালার মধ্যে ঠেসে ধরে রান্নার পাতিলের কালো তলা আমাদের সারা মুখে ঘষে আমাদের দুজনকে মা কালীর পুরুষ ভার্সন বানিয়ে দিয়েছিলেন। গ্রামের বাড়ি ছেড়ে চলে আসার পর আমার আর খুব বেশি গ্রামে যাওয়া হয়নি। কিন্তু যে কয়েকবারই গিয়েছি, দাদিদের একই প্রশ্ন ছিল বরাবর, ‘কি রে মিনসে, এখন তো বড় হয়ে গেছিস, এখনো বউ নিতে ভয় পাস নাকি?’ দুর্ভাগ্যবশত, বউ নেওয়ার পর আর গ্রামে যাওয়া হয়নি, যেতে পারলে বলতাম, ‘বউ হিসেবে তোমরাই ভালো ছিলে, ঢের ভালো!’

গ্রামের চায়ের দোকানের বারোয়ারি আড্ডা

গ্রামের প্রায় সব বাড়ির বাইরেই খানকা বাড়ি বলে একটা আলাদা ঘর থাকে, যেখানে বাইরের লোকজন বা আত্মীয়রা এলে তাঁদের মধ্যে পুরুষদের সেখানে অভ্যর্থনা জানানো হয়। তা ছাড়া রাস্তা দিয়ে যেসব মানুষ আসা-যাওয়া করেন, তাঁরা বিনা নোটিশে সেখানে বিশ্রাম নেন। যাঁরা একটু অভাবি, তাঁদের আলাদা ঘর না থাকলেও একটা ঘরের এক কোণ ফাঁকা রেখে সেটাকে খানকা ঘর হিসেবে ব্যবহার করেন। সকালে-বিকেলে বাড়ির এবং পাড়ার মুরব্বি পুরুষেরা সেখানে বসে খোশগল্প করেন আর পাড়ার কার বাড়ির কী অবস্থা, সেটা নিয়ে আলাপ-আলোচনা করেন। বিশেষ করে মাতব্বরের বাড়ির খানকাঘরে প্রতিদিনই সকালে ও বিকেলে পাড়ার সব মুরব্বি একত্র হয়ে পাড়ার বিভিন্ন সমস্যা ও তার সমাধান নিয়ে আলাপ-আলোচনা করেন। এ ছাড়া বিভিন্ন সমস্যা ও ঝগড়া-বিবাদ মেটানোর জন্য নির্ধারিত দিনের বৈঠক তো আছেই। সকালে-বিকেলে আড্ডার ফাঁকে যদি কেউ রাস্তা দিয়ে আসা-যাওয়া করেন, তাহলে মুরব্বিরা আগবাড়িয়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করবেন, ‘কে যায় গো?’ তারপর তিনি কাছে এলে ‘ও, তুমি অমুকের ব্যাটা না? আচ্ছা, ও তো আমার অমুকের অমুক হয়, আবার সে আমার অমুক আত্মীয়ের আত্মীয়।’ এভাবে সেই লোক চির-অপরিচিত হলেও তাঁর সঙ্গে একটা আত্মীয়তার বন্ধন খুঁজে বের করবেনই। ব্যাপারটা আমাকে খুব ছোটবেলা থেকেই মুগ্ধ করত। তাঁরা কত মানুষকে চেনেন, কত কিছু জানেন। আমি কাউকেই চিনি না, কিছু জানিও না।

গ্রামের মানুষের অকৃত্রিম আতিথেয়তা

প্রতিটি পাড়াতে মাতব্বরের নেতৃত্বে সমাজ বলে একটা সংগঠন ছিল, যারা পাড়ার সব ভালো-মন্দ দিক দেখত। প্রতি ঈদের দিন বিকেলে পাড়ার তেমাথায় (তিন রাস্তার মোড়) শিরনি বিলি করা হতো। এই ব্যাপারও খুবই আনন্দের এবং ধনী-গরিব সবাইকে এক কাতারে নিয়ে আসার একটা ভালো মাধ্যম ছিল।

পাড়ার সব বাড়ি থেকে গামলাতে (টিনের তৈরি বড় আকারের বাটি) করে খিচুড়ি (শিরনি) নিয়ে আসা হতো, তারপর সেগুলো আরও বড় একটি পাত্রে নিয়ে ধনী-গরিব সবার রান্না এক করে দেওয়া হতো, যাতে কোনোভাবেই বোঝা না যায় কোনটা কোন বাড়ির রান্না। তারপর প্রতি বাড়ির বাচ্চাকাচ্চাকে গোল একটা বৃত্তের আকারে বসিয়ে বিলি করা হতো। সাধারণত গরিব মানুষদের অনেক ছেলেপিলে থাকে, তাই তাঁরা অন্যের সমান শিরনি নিয়ে এলেও ফেরার পথে নিয়ে যেতেন অনেক বেশি শিরনি। এতে তাঁদের সপ্তাহখানেকের অন্নের সংকুলান হয়ে যেত। কিছুদিন আগেও আমাদের বর্তমানের শহরতলির এই গ্রামে পাড়ায় পাড়ায় শিরনি বিলির ব্যাপারটা ছিল, এখন আর নেই। কোরবানির ঈদের সময় তো ব্যাপারটা আরও ভালো ছিল। গরিব মানুষেরা সাধারণত সারা বছর মাংস কিনে খেতে পারেন না এবং তাঁরা কোরবানিও দিতে পারেন না। কোরবানির ঈদে সবার বাড়ির কোরবানির গরু-ছাগল-ভেড়া-মহিষ—সবই গৃহপালিত, যেগুলোর একেকটা পরিবারের একেকটি সদস্য ছিল এত দিন, সেগুলো একত্র করা হতো তেমাথাতে। তারপর পাড়ার মসজিদের হুজুর এসে একে একে সেগুলো জবেহ করে চলে গেলে গ্রামের গরিব মানুষেরা কাজে লেগে যেতেন। প্রতিবেশী হিসেবে তাঁদের ভাগের বাইরে মজুরি হিসেবে তাঁরাও আরও কিছুটা মাংস ও টাকা পেতেন। যেটা তাঁদের খাবার হিসেবে চলত বেশ কয়েক দিন।

গ্রামের মানুষের অকৃত্রিম আতিথেয়তা

গ্রামের ছেলেমেয়েদের মধ্যে আরও একটা ব্যাপার প্রচলিত ছিল, সেটাকে পরবর্তী জীবনে এসে বন্ধুত্ব বলে জানলাম। গ্রামে একেবারে ঘটা করে এক মেয়ের সঙ্গে অন্য আরেকটি মেয়ের বন্ধুত্ব করিয়ে দেওয়া হতো, যেটাকে গ্রামের ভাষায় ‘সই’ পাতানো বলা হতো। আবার ঠিক একইভাবে এক ছেলেকে অন্য আর একটি ছেলের সঙ্গে বন্ধুত্ব করিয়ে দেওয়া হতো, যেটাকে ‘মিতা’ পাতানো বলা হতো। তবে সাধারণভাবে একই নামের ছেলে হলে, মানে দুজনের নাম একই হলে তাঁদের মধ্যে এমনিতেই নাকি মিতা পাতানো হয়ে যেত। আমার মায়েরও একজন সই ছিলেন। আমি জীবনে তাঁকে শুধু একবারই দেখেছি। আমরা গ্রাম ছেড়ে শহরতলিতে চলে আসার পর আর তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রাখা সম্ভব হয়নি। আমার আব্বার অবশ্য তেমন আলাদা করে কোনো মিতা ছিল না। এর বাইরে আরও একটা সম্পর্ক ছিল, ধর্মের ভাই, ধর্মের বোন। আমার দাদির এমন একজন ধর্মের ভাই ছিলেন। তাঁর কথা এখনো আমার মনে আছে।

ভদ্রলোক প্রথম যেদিন আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন, সেই দিন দুর্ভাগ্যবশত আমাকে আর ফুফাত ভাই আনোয়ারকে মাঠে খেলতে দেখে আমাদের বাসার ঠিকানা জিজ্ঞেস করেছিলেন। আমি আর আনোয়ার বললাম, ‘আরে, ওইটা তো আমাদেরই বাড়ি, আসেন আমাদের সঙ্গে।’ এরপর আমি আর আনোয়ার খেতের মধ্য দিয়ে সোজা আমাদের বাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করলাম। তিনিও সাইকেল কাঁধে নিয়ে আমাদের পিছু পিছু আসা শুরু করলেন। বাড়িতে আসার পর তাঁর ফরসা চেহারা একেবারে ঘেমেনেয়ে লাল টুকটুকে হয়ে গিয়েছিল। আর সেই দিন দাদি আমাদের ওপর অনেক রাগ করেছিলেন। ‘তোরা শয়তান, পাজির দল, আমার ভাইটাকে রাস্তা দিয়ে না নিয়ে এসে খেতের মধ্য দিয়ে সারা রাস্তা সাইকেল কাঁধে করে নিয়ে এসেছিস।’ তাঁর ছেলেমেয়ের বিয়েতে দাদি যেতেন, আবার আমার চাচা-ফুফুর বিয়েতে তিনি অনেকবার এসেছেন।

গ্রামের মানুষদের এই নিঃস্বার্থ সম্পর্কের বিষয়টি আমার মনে একটা দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলেছিল, যেটা এখনো প্রকটভাবে বিদ্যমান। আমি খুব সহজেই মানুষকে বিশ্বাস করি, যদিও ঠকেছি অনেকবার। তবে আমার জীবনের যত অর্জন, সবই এসব পূর্বপরিচয় না থাকা মানুষের উপকারের ফসল বলে আমি মনে করি। আমি এক জীবনে এত মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি যে আমি যদি কৃতজ্ঞতা শিকার করতে যাই, তাহলে আমাকে আরও কয়েকবার এই পৃথিবীতে আসতে হবে। এসব সহজ-সরল মানুষ আমার মুখের ওপরই আমার সবকিছুর ভালো-মন্দ বলে দিতেন, কোনো রাখঢাক করতেন না। তবে সত্যি কথা বলতে গেলে, তাঁদের সবারই এমন আচরণের কারণ, তাঁরা গ্রামে তাঁদের শৈশব-কৈশোর কাটিয়েছেন। তাই তাঁদের আচরণের মূলে আছে সেই গ্রামের মানুষের সহজ-সরল জীবনযাপনের পদ্ধতি। এর বাইরে খুব সামান্য মানুষের কাছ থেকেই মুখোশধারী আচরণ পেয়েছি, যাঁদের কথা আমি কখনোই মনে রাখতে চাই না। তবে ইদানীং শহুরে শিক্ষিত প্রজন্মকে দেখে আমার খুব খারাপ লাগে। তাদের বন্ধুত্ব, গলায়-গলায় ভাব, আচার-আচরণে মাখামাখি—সবই লোকদেখানো। তাদের না আছে নিজের উৎস সম্পর্কে জ্ঞান, না আছে দেশের ইতিহাস সম্পর্কে সামান্য জানাশোনা; তারা না করে বড়দের শ্রদ্ধা, না করে ছোটদের স্নেহ; না এরা নিজেদের মা-বোনকে সম্মান দেয়, না অপরিচিত বয়োজ্যেষ্ঠদের। কী এক অলীক নেশায় তারা ছুটে চলেছে জীবনের পথে, যার শেষ কোথায়, নিজেরাই জানে না। আমি বলছি না যে এর ব্যতিক্রম নেই, কিন্তু সেগুলো ব্যতিক্রমই, উদাহরণ নয়। আসলে তাদের দোষ দিয়েই-বা কী লাভ। খুব ছোটবেলা থেকেই ক্লাসে ভালো ফল করার, অন্যের চেয়ে নিজেকে শ্রেষ্ঠ করে তোলার প্রতিযোগিতায় তাদের মা-বাবা তাদের এই পর্যায়ে নামিয়ে এনেছে। এখন তো আর তারা শত চেষ্টা করেও সেটা থেকে বের হতে পারে না। তাই আসুন, আমরা আমাদের আগামী প্রজন্মকে স্মার্ট এবং অলরাউন্ডার বানানোর পাশাপাশি কিছুটা মানুষ বানানোর শিক্ষাটাও দিই।