ক্যানসাসে বাংলাদেশি ছাত্রদের নবীনবরণ অনুষ্ঠিত

নবীন শিক্ষার্থীদের একাংশ
ছবি: তোফায়েল আহমেদ তুহিন

নিশ্চিত পরিণতি নির্ধারিত থাকা সত্ত্বেও মানুষ অনবরত চেষ্টা করে সময়কে পরাজিত করার। এ চেষ্টার সম্ভাব্য একটি কারণ মনোহরি এ দুনিয়ার যাত্রাকে দীর্ঘায়িত করা। আর প্রত্যাশিত এ দীর্ঘায়িত যাত্রার মধ্যে মানুষ আগলে রাখে সুপ্ত ভালোবাসা, ভোগ আর অপ্রাপ্তির লম্বা তালিকা। যা হোক, আজকের আলাপ সম্পূর্ণভাবে সময়কে ঘিরে নয়। আবার সময় থেকে বিচ্ছিন্নও নয়। কারণ, বছর ঘুরে আবার অক্টোবর এল। গ্রীষ্ম শেষে শীত এসেছে। নানা কিসিমের ফুল ফুটেছে শহরে, সচল হয়েছে প্রকৃতির মধ্যে প্রায় লুকিয়ে থাকা বাড়িগুলো। নতুন সব সবুজ পাতার পসরা সাজিয়ে নিষ্ঠুর দুনিয়ায় বেঁচে থাকার এলান দিয়েছে সবুজ গাছগুলো। শুরু হয়েছে নতুন শিক্ষাবর্ষ আর বিরামহীন ব্যস্ততা। তবে সবচেয়ে বড় খবর, শহরে এসেছেন নবীন শিক্ষার্থীরা। সঙ্গে বয়ে নিয়ে এসেছেন একগাদা তাজা বাহারি গল্পের বস্তা, হাসিমুখ আর ক্রমাগত উচ্ছ্বাস। এই উচ্ছ্বাস আর গল্পের মধ্যে বাড়ি থেকে হাজারো মাইল দূরে থাকা বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের অনেকে নিজস্ব চিত্রপটে খুঁজে পান অত্যন্ত যত্ন সহকারে সংরক্ষিত অতীতের নানা স্মৃতির প্রতিচ্ছবি। খুঁজে পান সম্মিলিত এক অতীতের গল্প। সম্মিলিত অতীতের অর্থই সম্ভাব্য সম্মিলিত আগামী।

সম্ভাব্য এ সম্মিলিত আগামীকে মিহি করার নিমিত্তে ক্যানসাস স্টেট ইউনিভার্সিটিতে অধ্যয়নরত বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের সংগঠন বাংলাদেশি স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসআই) তত্ত্বাবধানে আয়োজিত হয়েছিল নবীনবরণ অনুষ্ঠান। বিএসআই বরাবরই যত্নবান বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের বিশেষ করে নবাগত শিক্ষার্থীদের নানা সংকট সমাধানে। সাম্প্রতিক সময়ে বিএসআই সেজেছে নতুন সাজে। নতুন শিক্ষাবর্ষে নতুন নেতৃত্ব দায়িত্ব গ্রহণ করেছে নতুন সব পরিকল্পনা নিয়ে। নবাগত এ কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী সানজিদা আক্তার রিমা। সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন তোফায়েল আহমেদ তুহিন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত রসায়ন বিভাগের সাবেক ছাত্র ছিলেন তুহিন। রিমা ও তুহিন অত্যন্ত উদ্যমী। সবকিছু গুছিয়ে নেওয়ার অদ্ভুত ক্ষমতা আছে তাঁদের।

প্রতিবছরের মতো এ শিক্ষাবর্ষেও এসেছেন একঝাঁক শিক্ষার্থী। এই শিক্ষার্থীদের বরণের অনুষ্ঠানের নির্ধারিত দিন ছিল গত শনিবার। সকাল থেকে আকাশ মেঘে ঢাকা থাকলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আকাশ থেকে মেঘ সরে গিয়ে সূর্যের আলোয় আলোকিত হয়েছিল চারদিক। সপ্তাহব্যাপী আয়োজনের কাজ সচল থাকলেও শনিবার দুপুর শেষে চাঞ্চল্য শুরু হয় আয়োজনের চূড়ান্ত পর্বের। একদল মানুষ নিরলসভাবে শ্রম দিয়েছেন অনুষ্ঠানস্থল সাজানো থেকে শুরু করে আপ্যায়ন ও নতুন শিক্ষার্থীদের উপহার প্রস্তুতের জন্য। সম্মিলিত আগামীর অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়েছিল সবার সমবেত চেষ্টায়। নবীনবরণ অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন ক্যানসাস স্টেট ইউনিভার্সিটির বেশ কয়েকজন সম্মানিত অধ্যাপক। কথার ফাঁকে সবাই সেরে নিয়েছেন রাতের খাবার।

নবীনবরণ অনুষ্ঠান শেষে বাংলাদেশি কমিউনিটির একাংশ
ছবি: তোফায়েল আহমেদ তুহিন

মার্কিন দেশের জীবনযাত্রার মূল স্রোত থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন ক্যানসাস রাজ্যের ম্যানহাটন শহরে আমাদের বসবাস। ছোট্ট এই শহরের গোড়াপত্তন হয়েছে ক্যানসাস স্টেট ইউনিভার্সিটি ঘিরে। ভালো লাগা, ভালোবাসার সঙ্গে হরেকরকমের তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে আমাদের সম্মিলিত বসবাস। দিনব্যাপী ল্যাব, ক্লাস কিংবা প্রফেসরের সঙ্গে ‘তিক্ত-মিঠা’ বৈঠক শেষে অনেকে একত্রিত হন চা কিংবা কফির আড্ডায়, রাতের খাবারে। গ্রীষ্মের দুপুর থেকে সূর্যাস্ত অবধি নির্জন নীল আকাশের নিচে নিরালা পানির মাছ শিকারের সঙ্গে নিয়মিত চলে ব্যাডমিন্টন, ফুটবল ও ক্রিকেটের মহড়া। এভাবেই সারা দিনের ক্লান্তি পরাজিত করে রাতের আঁধারে আমাদের চোখগুলো বন্ধ হয় আগামী দিনের চমৎকার সকালের স্বপ্ন নিয়ে। দিন শেষে বারবার নানা উপায়ে বেঁচে থাকার নিরলস প্রচেষ্টায় আমরা সবাই নিয়োজিত। এটি অনেকটা সময়কে হারিয়ে বেঁচে থেকে মানবীয় কল্পনা আর ইচ্ছাগুলো বাস্তব দর্শনে অবিরাম প্রচেষ্টা। তাই এ রুক্ষ সফরকালে প্রতিটি আগমন উচ্ছ্বসিত করে আমাদের। বিস্তৃত করে কল্পনাকে। সংগঠিত করে স্তিমিত হয়ে যাওয়া ইচ্ছাগুলোকে। অন্যদিকে প্রতিটি বিদায় বিচ্ছেদ উসকে দেয়, উন্মুক্ত করে লুকিয়ে রাখা যন্ত্রণা। আহত করে প্রায় অসংগঠিত আমাদের যাত্রাকে। তবে আমাদের বেঁচে থাকতে হয় নানা কারণ অবলম্বন করে। তাই আগত সম্মিলিত ভবিষ্যতের অর্থ বিচ্ছেদ জেনেও রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর ‘চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়—বিচ্ছেদ নয়’ মেনে নিয়েছি আমরা সবাই। সম্মিলিতভাবে মেনে নিয়েছি বেঁচে থাকার ভাঙাচোরা পথ মেরামত করার নিয়মিত প্রচেষ্টাকে। এ প্রচেষ্টায় শামিল থাকুক নবীনেরা, শামিল থাকুক যারা আমাদের ছেড়ে বাস্তবতার খাতিরে জীবন গড়েছে অন্য কোথাও।