‘জহির রায়হান অনুসন্ধান ও ভালোবাসা’ যেন ইতিহাসের দায়মোচন

‘জহির রায়হান: অনুসন্ধান ও ভালোবাসা’ বইয়ের ভূমিকায় প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান লিখেছেন, ‘জহির রায়হান বাংলার সেই বিরল কথা শিল্পী, চলচ্চিত্রকার ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মী, যিনি মানুষের মুক্তির প্রেরণায় তাঁর সৃজনশীল হাত এবং প্রবল পদাতিক সত্তা একই সঙ্গে সক্রিয় রেখেছেন। সাহিত্যজীবনের শুরুতেই “ওদের জানিয়ে দাও” কবিতার মধ্য দিয়ে তিনি সাম্রাজ্যবাদী-উপনিবেশবাদী শক্তিকে জানাতে চেয়েছেন—তিনি তাদের বিরুদ্ধে, গণমানুষের পক্ষে কথা বলতে এসেছেন।’

জহির রায়হানকে ‘অমর একুশের মানসসন্তান’ বলে অভিহিত করেছেন মতিউর রহমান। ‘একুশের গল্প’, ‘আরেক ফাল্গুন’ কিংবা ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ উপন্যাস অথবা ‘জীবন থেকে নেয়া’ চলচ্চিত্র পরিচালনার মধ্য দিয়ে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের চেতনাকে বেঁধেছেন অমর ধ্রুবপদে। তাঁর মতে, ‘একুশের গল্প’ এবং ‘আর কত দিন’ উপন্যাসের তপু তো আসলে জহির রায়হানই।

জহির রায়হান এ দেশের চলচ্চিত্র আন্দোলনের চিরস্মরণীয় নাম। তিনি একাধারে বাংলা ও উর্দু চলচ্চিত্র এবং ইংরেজি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করছেন। ১৯৬১ সালে ‘কখনো আসেনি’ দিয়ে তাঁর চলচ্চিত্রযাত্রা, তা ক্রমে ইতিহাস সৃষ্টি করে ‘সোনার কাজল’, ‘কাঁচের দেয়াল’, ‘সংগম’, ‘বাহানা’, ‘বেহুলা’, ‘জ্বলতে সুরজ কে নিচে’, ‘জীবন থেকে নেয়া’, ‘স্টপ জেনোসাইড’, ‘আ স্টেট ইজ বর্ন’-এর মতো সাড়াজাগানো, পুরস্কৃত এবং বাঁকবদলকারী চলচ্চিত্রকর্মের সূত্রে। ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ ও ‘লেট দেয়ার বিল লাইট’ নামে দুটি চলচ্চিত্রের কাজ যদিও তিনি সমাপ্ত করতে পারেননি, তবু তাঁর অসমাপ্ত কর্মের অঙ্গীকার আজকের নবীন চলচ্চিত্রকর্মীরা ধারণ করে চলেছেন তাঁদের যাবতীয় দায়বদ্ধ চলচ্চিত্র-তৎপরতায়।

‘জহির রায়হান: অনুসন্ধান ও ভালোবাসা’ বইয়ের প্রথম পর্বের একগুচ্ছ লেখার মধ্যে দিয়ে ঘৃণ্য ঘাতকের বিরুদ্ধে জহির রায়হানের আমৃত্যু সত্যটি পাঠকের অনুধাবনে আসবে। বইটি প্রামাণ্য করার জন্য সম্পাদক সাংবাদিক জুলফিকার আলী মানিকের ‘মুক্তিযুদ্ধের শেষ রণাঙ্গন মিরপুর: জহির রায়হান অন্তর্ধান রহস্যভেদ’ বইয়ের সাহায্য নিয়েছেন। স্মৃতিচারণা, মূল্যায়ন ও আলোচনায় যেমন বিভিন্ন প্রজন্মের লেখক-শিল্পী-চলচ্চিত্রকারদের জহির-স্মৃতি ও মূল্যায়ন উঠে এসেছে, তেমনি তাঁর পরিবারের সদস্যের লেখা ফুটিয়ে তুলেছে নিবিড় এক জহির রায়হানকে, যিনি নিজের পরিবার ছাপিয়ে গোটা মানবজাতিকে মনে করতেন তাঁর প্রিয় পরিবার। এ ছাড়া জহির রায়হানের গল্প, প্রবন্ধ, চিঠি, আলাপন এবং আলোকচিত্রাবলির সংযোজনের মধ্য দিয়ে বইটি হয়ে উঠেছে এক প্রামাণ্য দলিল।

কর্মসূত্রে জহির রায়হানকে চিনতেন কথাসাহিত্যিক রাবেয়া খাতুন। ‘জহিরকে যখন জানতাম’ শিরোনাম রাবেয়া খাতুনের লেখাটা জহির রায়হানকে চিনতে সাহায্য করে। জহির রায়হানের সঙ্গে প্রথম পরিচয়ের কথা বলতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘বয়সে খুবই তরুণ। ছোটখাটো শরীর। সাদা সাপটা চেহারা। ঝকঝকে চোখ। প্রথম দৃষ্টিতে সে-ই কেড়ে নেয় অন্যপক্ষের আকর্ষণ।’ তিনি জানাচ্ছেন, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ছিল জহির রায়হানের প্রিয়। জহির বলতেন, ‘এমন দেখার চোখ আমি কবে পাব।’ কখনো কোনো লেখার মধ্যে ভীষণ ভেঙে পড়ে বলতেন, ‘আচ্ছা, যা বলতে চাই, পারি না কেন? ষোলো আনাই পারব, এমন অলৌকিক আশা নিজের কাছে দাবি করা এখনই অন্যায় হবে। কিন্তু যেটুকু চাই, তার কিছু তো পাব। মনের মধ্যে কথা টগবগ করছে, কলমের মুখ বোবা। অসহ্য।’

একবার একজন জহিরকে দেখিয়ে বলেছিল, ‘ওই বসে আছে দেমাগের দেমাগি রাইটার।’ সেটা শুনে প্রচণ্ড মন খারাপ করেছিলেন জহির এবং পরবর্তী সময়ে রাবেয়া খাতুনকে বলেছিলেন, ‘একটি দল আমাকে একেবারে অপাঙ্‌ক্তেয় করে রাখতে চাইছে। জানেন, মাঝেমধ্যে মনে হয় দেই সবকিছু ছেড়ে। হঠাৎ একদিন সাহিত্য ধরেছি। হঠাৎ একদিন ছেড়ে দেব। যাবে ল্যাঠা চুকে। সাধের ঝঞ্ঝাট আর ভালো লাগে না।...অন্যদের কথা জানিনে, আমার জন্য এটা খুব কষ্টের। অহংকার জিনিসটা কেউ জন্মসূত্রে পায়। কারও জীবনে আরোপিতভাবে আসে। কাউকে আবার শিখতেও হয় প্রয়োজনে। আমি তো এর কোনোটাতেই পড়িনি। আমার সৃষ্টির যখন আমার দৃষ্টিকেই পীড়া দেয়, তখন অন্যখান থেকে এসব শুনতে হলে বড় ভেঙে পড়ি।’

জহির বিশ্বাস করতেন না গল্প লেখার কাঁচামাল নেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিষছোবলে আংশিক ক্ষয়ে যাওয়া ঢাকার মনমানস, দাঙ্গা, দেশভাগ, মহাজনি মহাজের সমস্যা, ঐতিহ্য, মূল্যবোধ বাঁচিয়ে একশ্রেণির মানুষের তীব্র সংগ্রাম। খরায় শক্ত নিষ্ফলা মাটি, ঝঞ্ঝা-বন্যার ধোয়া প্রকৃতি, রহস্যে ভয়াল পাতাল, বোধবুদ্ধিহীন নির্বাক শিশু, নিবিড় তন্দ্রার তৈরি পরাবাস্তবের অলৌকিক স্বপ্ন। খুঁজলে কোথায় গল্প নেই। জহির বলতেন, মালমসলা চারদিকে ছড়ানো। নেওয়ার মতো সক্ষম হাতের অভাব। মজবুত নির্মাণ তাই সম্ভব হচ্ছে না। জহির বলতেন, রবীন্দ্রনাথ যুগোত্তীর্ণ তাঁর অসাধারণ প্রতিভার গুণে। আমরা তাঁর কাছাকাছি রেঞ্জের মানুষ নই।

জহির রায়হান স্ত্রী সুমিতা দেবীকে ‘মিঠু-বিপুলের মা’ সম্বোধন করে এক দীর্ঘ চিঠি লেখেন। তাঁর ভাষায়, ‘এটা কোনো পরমপত্র নয়। উপদেশলিপি নয়। হতাশার আগুনে দগ্ধ একটি মানুষের করুণ আকুতিও নয়। এটা হলো দীর্ঘ বছর ধরে ঘটে যাওয়া একটি অসাধারণ বিয়োগান্ত নাটকের সাধারণ যবনিকা পতন।’ এ চিঠিতে উঠে এসেছে জহির রায়হানের বাস্তব জীবনের রূঢ় সব অভিজ্ঞতা এবং আকাঙ্ক্ষার কথা। জহির লিখেছিলেন, ‘আমি দেখেছি, নিদারুণ যন্ত্রণায় ভুগে ভুগে, প্রতিদিন, প্রতি রাতে, প্রতিক্ষণে দেখেছি। লম্পট যারা, অসাধু যারা, মিথ্যেবাদী যারা, চরিত্রহীন আর মুখোশধারী যারা, তারা জিতে গেল। সমাজ তাদের বাহবা দিল। তারা বিজয়ী বলেই হয়তো, মানুষের দল তাদের পক্ষই নিল। আমার কথা কেউ শুনল না, আমার ব্যথা কেউ বুঝতে চেষ্টা করল না। আমার সততার কেউ কোনো মূল্য দিল না।’

জহির রায়হান আরও লিখেছিলেন—
‘কখনো মনে হতো আমরা বড় সুখী
কখনো মনে হতো আমরা বড় দুঃখী
কখনো মনে হতো আমরা বড় শান্ত
কখনো মনে হতো আমরা বড় অশান্ত
.............................................
এ জীবনের কাছ থেকে আমরা কী চেয়েছিলাম।
কী পেয়েছি।
কী পাইনি।
তার হিসাব-নিকাশ করে আর লাভ নেই।
........................................
আমরা সবাই এক একটা পাগল।’

‘জহির রায়হান: অনুসন্ধান ও ভালোবাসা’ বইয়ে জহির রায়হানের রচনা থেকে তুলে দেওয়া হয়েছে চমৎকার চারটি লেখা। ‘পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ’ প্রবন্ধে জহির লিখেছেন: ‘পাকিস্তানের গত তেইশ বছরের ইতিহাসের সবচেয়ে উল্লেখ্যযোগ্য দিক হল, পাকিস্তান কখনো জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা শাসিত হয়নি।...পাকিস্তানের এই মৃত্যুর জন্য শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর দলও দায়ী নয়।’ ‘অক্টোবর বিপ্লব ও সোভিয়েত চলচ্চিত্র’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘আধুনিক সভ্যতার সবচেয়ে স্মরণীয় অবদান হচ্ছে দুটো।

একটি সিনেমার জন্ম। অপরটি সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্ম। দুটোই বিপ্লব। একটা চারুকলার ক্ষেত্রে। অন্যটা সমাজব্যবস্থার ক্ষেত্রে।’ এই প্রবন্ধ দুটিতে জহিরের ভাবনার ছাপ অত্যন্ত স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। পরিশিষ্টে আছে জহিরের সমসাময়িক আরও চারজন বিশিষ্ট ব্যক্তির স্মৃতিচারণা; আর আছে কিছু অমূল্য আলোকচিত্র।

‘জহির রায়হান: অনুসন্ধান ও ভালোবাসা’ বইয়ের সম্পাদক মতিউর রহমানের কথা দিয়ে লেখাটা শেষ করতে চাই। আমাদের জাতীয় জীবনে যখন দ্বিধা-সংশয়ের শেষ নেই, যখন সাংস্কৃতিক অঙ্গনে বিরাজ করছে অরুচি আর জীবনবিমুখতা, তখন জীবনের একটু আগুনের জন্য জহির রায়হানের কাছেই বারবার ফিরে যেতে হয় আমাদের। জহির রায়হানদের কখনোই মৃত্যু ঘটে না; ‘একুশের গল্প’-এর তপুর মতো জহির রায়হানরা ‘সময়ের প্রয়োজনে’ যুগে যুগে ফিরে ফিরে আসেন বাংলার লাখো-কোটি শহীদের বেশে।