অবসর জীবন কীভাবে কাটাবেন
আমার সমবয়সী যাঁরা, তাঁদের সবাই এখনো সরকারি, বেসরকারি, কৃষি বা ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত। আমি একমাত্র ব্যক্তি, যে সাবেক কর্মকর্তা, তার মানে আমি আগে কর্মকর্তা ছিলাম এখন কর্মের কর্তা না, তবে আমি অতীতের চেয়ে বেশি এবং নানা ধরনের কর্মের সঙ্গে জড়িত। তারপরও আমার পরিচয় সাবেক কর্মকর্তা এবং আমি অবসর জীবনযাপনে আছি—এটাই আমার বর্তমান পরিচয় সমাজের কাছে। আমার নিজের একটি ব্যক্তিগত কর্ম পরিচয় রয়েছে, আমি তার একটু বর্ণনা করব। তার আগে একটি বিষয় পরিষ্কার হওয়া দরকার সেটা হলো, ধরুন কোনো কারণে আপনার স্বামী বা স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়ে গেছে। নতুন সঙ্গী পেয়ে গেছেন, এখন যদি সারাক্ষণ সেই পুরনো সঙ্গীর কথা ভাবেন, তাহলে কী হবে জানেন? বর্তমান সঙ্গী এবং আপনি কেউ সুখ-শান্তিতে থাকতে পারবেন না। অতীতকে সামনে না টেনে তাকে তার জায়গায় রাখুন, নতুনকে বরণ করুন এবং বর্তমানের সঙ্গে সময় দিন, দেখবেন ভালো লাগছে।
যাই হোক, আমি প্রায় প্রতিদিনই সকাল ৬টা থেকে ১০টা পর্যন্ত লিখি (কখনো বাংলা, কখনো সুইডিশ এবং কখনো ইংরেজিতে) নানা বিষয়ের ওপর। তারপর নিজেকে রেডি করি। ঘরের কাজকর্ম করি। বাইরের কাজ থাকলে সেগুলো করি। হাঁটতে ইচ্ছে হলে সেটা করি। গান গাইতে ইচ্ছে হলে সেটা করি। শহরে যেতে মন চাইলে সেটা করি বা কারও সঙ্গে দেখা করতে মন চাইলে সেটা করি। কোনো কোনো দিন ছেলের খেলাধুলার সঙ্গে সময় কাটাই। তারপর বাড়িতে এসে রান্না করি। ঘরের কাজ করি। সন্ধ্যায় মারিয়ার (আমার স্ত্রী) সঙ্গে সময় কাটাই। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে সকালের লেখাগুলো একটু এডিট করি। পুরো দিনে সংসারের সব কাজই কিন্তু করি। তারপর টেলিফোনে বেশ সময় দিতে হয় দেশ–বিদেশের অনেক কাজে। নিজ এবং অন্যের পরিবারের কিছু কিছু ব্যক্তির অর্থনৈতিক এবং ব্যক্তিগত সমস্যার সমাধানেও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে যথাসাধ্য চেষ্টা করি। সর্বপোরি পুরো দিনে স্রষ্টার সঙ্গে একটি ভালো সম্পর্ক যাতে ধরে রাখতে পারি, তার জন্যও যথাসাধ্য চেষ্টা করি—কারণ, আমি এখন অবসর জীবনে, আমি সাবেক কর্মকর্তা আমার এখন প্রচুর সময়। তাই আমি এতসব করার পরও মনে হয় দিনটা বুঝি মাটি হয়ে গেল! হা-হুতাশ না করে হঠাৎ যখন দেখি মারিয়ার একটু ছুটি হলো, আর হুট করে শেষে কোথাও বেড়াতে চলে গেলাম, নতুন এবং পুরনের মিলনায়তনে নিজেদেরকে শতভাগ উৎসর্গ করে দিই— তারপরও মনে হয় দিনটা আরও ক্রিয়েটিভ হতে পারত, কারণ আমি এখন সাবেক কর্মকর্তা, আমি অবসরে, আমার প্রচুর সময়, আমারই তো কাজ করার সময় এখন।
হঠাৎ সেদিন একজন সিনিয়র বড় ভাইয়ের সঙ্গে টেলিফোনে কথা হলো। ভদ্রলোক বাংলাদেশের একজন সাবেক কর্মকর্তা, তিনি তার অবসর জীবনের কিছু কথা শেয়ার করলেন; শুরু করলেন চাকরির জীবন দিয়ে, যেমন চাকরিতে থাকাকালীন বদলির কথা বললেন। এক মন্ত্রণালয় থেকে অন্য মন্ত্রণালয়ে, এক সংস্থা থেকে অন্য সংস্থায়, জেলা থেকে রাজধানীতে ও রাজধানী থেকে জেলায় অনেকবার বদলি হয়েছেন। ঢাকায় এক সংস্থা বা মন্ত্রণালয় থেকে অন্য সংস্থা বা মন্ত্রণালয়ে স্থানান্তর প্রক্রিয়া ছিল নির্বিঘ্ন, মসৃণ।
এর পরে আবার শুরু করলেন, আমি এ পর্যন্ত মোট তিনবার কর্ম অবসরান্তে অফিস থেকে বিদায় নিয়েছি। তিনবারের অভিজ্ঞতা তিন ধরনের। একটির সঙ্গে অন্যটির কোনো মিল নেই। প্রথম বিদায় নিয়েছি ক্যাবিনেট ডিভিশন থেকে ২০১৫ সালে দুই বছর চুক্তিভিত্তিক চাকরি করার পর। এর বেশ কিছু আগে ২০১০ সালের কোনো এক বিকেলে কথাচ্ছলে আমার একজন প্রিয় ব্যক্তি মনে করিয়ে দিল যে আমার অবসর গ্রহণের সময় ঘনিয়ে আসছে। আর মাত্র পাঁচ বছর পর এই দিনে আমি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করব। কথাটি কেন যেন আমার বুকে বাজল। এর আগে আমি কখনো অবসর গ্রহণের কথা চিন্তা করিনি। এত দিন মনের গভীরে হয়তো আমি নিজেকে তরুণ কর্মকর্তা হিসেবে ভেবেছি। অবসর গ্রহণের সময় অবচেতন মনে অনেক পিছিয়ে রেখেছি। আজ প্রিয় বন্ধুর কথায় বড় একটা ঝাঁকি খেলাম। দূরে-বহুদূরে কোথাও যেন বিদায়ের সুর ধ্বনিত হতে লাগল। চিরচেনা মন্ত্রণালয়, সচিবালয়কে আগের মতো আপন মনে হলো না। বুঝলাম, ধীরে ধীরে এ জায়গা ছেড়ে আমাকে ব্যক্তিগত জীবনে প্রবেশ করতে হবে। কোনো সরকারি সমর্থন থাকবে না। নিজ উদ্যোগে জীবনযাপনের জন্য সব কিছু গুছিয়ে নিতে হবে। এবং সে জন্য এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে। কথাটি বলা কিংবা ব্যাপারটি চিন্তা করা যত সহজ, কাজটি তত সহজ নয়। অর্থবহ প্রস্তুতির জন্য যে অর্থ-সম্পদের প্রয়োজন হয়, তা আমার ছিল না। আমি পরিমিত খরচে বিশ্বাস করি, এ ব্যাপারে আমার কিছু পারদর্শিতা রয়েছে। প্রভিডেন্ট ফান্ডে আমার সঞ্চিত টাকার পরিমাণ অন্য অনেকের তুলনায় বেশি বই কম নয়। প্রায় ২৫ লাখ টাকা। পেনশন পুরো বিক্রি করে পেলাম ২৫ লাখ টাকার মতো। সব মিলিয়ে প্রায় ৫০ লাখ টাকা নিয়ে আমি সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করলাম। এ টাকা দিয়ে আমাকে বাড়ি বানাতে হবে, গাড়ি কিনতে হবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছোট মেয়ের পড়ার খরচ চালাতে হবে। আমার ছেলে তখন চাকরিতে যোগদান করেছে মাত্র; আয়-উপার্জন নেহাত সীমিত। টাকা-পয়সা নিয়ে বিপদে না পড়লেও এত কম অর্থ-সম্পদ নিয়ে কীভাবে সংসার চালাব সে উদ্বেগ অশান্ত রূপ নিয়ে মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।
ভদ্রলোক আরও অনেক কিছু বলতেন কিন্তু আমার আবার বিপদ, অন্য একটি টেলিফোন ঢুকে গেল। একজন মুক্তিযোদ্ধা যার কিডনিতে পাথর জমা হয়েছে তাঁকে একটু সাহায্য করতে হবে। দেশে কিছু সমাজসেবী বন্ধু আছেন, তাঁরা তাঁদের কর্মের পাশে সাধারণ মানুষের কথা ভাবেন। তো এক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডাক্তার বন্ধুকে জানালাম ঘটনাটি। বন্ধু খুব দ্রুততার সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা ভাইয়ের চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দিলেন। যাই হোক, আমি সত্যিই ভাগ্যবান, সবার আগে অবসরে যেতে পেরে যা খুশি ঠিক তাই করতে পারি। যদিও কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা নেই বা বিলাসবহুল বাড়ি–গাড়িও নেই। তারপরও কেন যেন মনে হয় অনেকের চেয়ে ভালোই তো আছি, আলহামদুলিল্লাহ।
এবার আসি যে কারণে লেখা সেই বিষয়ে। সুইডেনের কিছু বন্ধু বান্ধবীর অবসর জীবন ঘনিয়ে এসেছে। তাদের মনে বিষণ্নতা, কী হবে চাকরি ছাড়ার পর, কী করবে, কীভাবে সময় পার করবে ইত্যাদি ইত্যাদি। যেন ঠিক বাংলাদেশের বড় ভাইয়ের মতো বিষণ্নতা। আমি যেহেতু সবার আগে সাবেক কর্মকর্তা হয়েছি, সে ক্ষেত্রে তারা আমার থেকে কিছু শুনতে এবং জানতে চায়। অনেকের সঙ্গে ইদানীং বিষয়টি নিয়ে কথা হয়েছে, ভাবলাম বাংলাদেশেও তো অনেকে রয়েছেন, তাঁরাও একদিন সাবেক কর্মকর্তা হবেন, তাই শেয়ার করলাম আমার শেয়ার ভ্যালুর কনসেপ্ট থেকে ফেয়ার ভ্যালু—যা আমার অবসর জীবনের স্মৃতিচারণা। তবে যে কথাটি ওপরে বলেছি, সেটা হলো বর্তমানকে নিয়ে ভাবুন, বেশি পিছু না তাকিয়ে।
আসলে জীবনের অবসর সেদিনই হবে যেদিন চিরনিদ্রায় ঘুমিয়ে যাব। তার আগ পর্যন্ত অবসর বলে কিছু নেই তবে সাবেক কর্মকর্তা আমার পরিচয়, আমি এখন ফাইজারের ডাইরেক্টর না, আমি উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের কখনো একজন শিক্ষক আবার কখনো একজন শিক্ষার্থী। আমার চাকরির জীবনটা ছিল চাকরি করা আর আমার এখনকার ‘অবসর’ জীবনটা হচ্ছে —জীবনের উপভোগ, জীবনের জন্য (enjoy life, to life )।
**দূর পরবাস–এ লেখা, গল্প, ভ্রমণ অভিজ্ঞতা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস [email protected]