দূরের তুরস্ক, কাছের তুরস্ক–২

পরিবারের সঙ্গে লেখক
ছবি: সংগৃহীত

৩.

আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল সকাল আটটায়। বউ–ছেলে ঘুমাচ্ছে। ভাবলাম, তুরস্ক সফরের বর্ণনাটা লিখে ফেলি। সঙ্গে সঙ্গে না লিখলে অনেক কিছু ভুলে যাওয়ার শঙ্কা থাকে। লিখতে গিয়ে মনে হলো, ল্যাপটপ ছেলের রুমে। তার রুমে গেলে যদি তার ঘুম ভেঙে যায়! খুব আস্তে, বেড়ালের মতো নিঃশব্দে ঢুকলাম। ল্যাপটপ হাতে নিতেই ছেলে খ্যাঁক করে উঠল, বাবা, তুমি ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছ, ঘুমিয়েছি ভোর রাত চারটায়। এত রাতে ঘুমাও কেন? উল্টা আমি ঝাড়ি দিলাম। ঘুম আসে না, কী করব! ইতিমধ্যে ছেলের মা–ও জেগে গেছে। সে তার ছেলের পক্ষ নিয়ে বলল, তোমার যন্ত্রণায় ছেলেটা ঘুমাতেও পারছে না। তাদের পাল্লা ভারি দেখে, কথা বাড়ালাম না। চুপচাপ ল্যাপটপ নিয়ে লিখতে শুরু করলাম। তুরস্ক কাহিনি। বউ-ছেলে ঘুমিয়ে পড়ল। আজ ভেবেছিলাম রেস্তরাঁয় গিয়ে ইংলিশ ব্রেকফাস্ট খাব (কোথাও বাঙালি কিংবা ভারতীয় খাবার দেখিনি, একটা পেয়েছিলাম কিন্তু মালিক তুরস্কের, একিন হলো না)। কিন্তু বউ–ছেলে উঠতে উঠতে বেলা ১১টা। এখানে ১২টা থেকে দুপুরের খাবার শুরু হয়। বউ রুটি দিল আর ডিম পোজ দুইটা। কোনো রুটি! ওই যে ১৮ টাকায় টার্কিশ রুটি কিনেছিলাম। দুইজনে নিমিষেই শেষ করে ফেললাম বিশাল রুটিটি। বউকে বললাম, তুমি তো রুটি দেখেই ছেঁক করে উঠেছিলে, এ রুটি কে খাবে! এখন তো দেখছি তুমিই খেয়েছ বেশি। সে মুচকি হেসে বলল, দেখে ভেবেছিলাম, অনেক শক্ত রুটি, খাওয়া যাবে না কিন্তু আসলে তো তা না।

জাহাজে সমুদ্র দেখা
ছবি: সংগৃহীত

আমাদের নাস্তা শেষ হতে না হতেই ছেলে বেরিয়ে গেল, সমুদ্রসৈকতের উদ্দেশ্যে। বললাম, একটু অপেক্ষা কর, একসঙ্গেই বের হই। কিন্তু না, তার সময় নেই। সে বিচ টাওয়েল নিয়ে বেরিয়ে গেল। আমি মোবাইল নিয়ে গেলাম পাশের বাগানে। ভিডিও রেকর্ড করতে। ইউটিউব চ্যানেলের জন্য। আমার দর্শকদের কেউ কেউ অনুরোধ করেছেন, তুরস্কের চাকরির সুযোগ নিয়ে একটা ভিডিও বানাই। রেকর্ডিং শেষ করে রুমে ফিরলাম। বউকে বললাম, চলো, সৈকতে যাই। গোসল করব। হেঁটে হেঁটে সৈকতে গেলাম। সৈকতে অনেক মানুষ। দুয়েকজন লোক আমাদের দিকে এগিয়ে এল। তাদের একজন মুস্তফা। সে ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে বলল, তুরস্কেরই লোক, ছোট মেয়ের নাম ফাতেমা। আমি বললাম, আমার বোনের নামও ফাতেমা। সে হেসে বলল, ইসলামি কিছু নাম আছে খুব কমন।

আমরা বাংলাদেশি লোকেরা সাদা চামড়ার লোকদের সঙ্গে কথা বলে, যেরকম একটু বুক ফুলাই, সে–ও আমাদের সঙ্গে সামান্য ইংরেজি বলে, তার বউয়ের সামনে নিজেকে বাহাদুর বানাল। আমার বউ পানিতে নেমে হয়ে গেল পুরাই কিশোরী, সাঁতার কাটে আর বলে, ফটো তুলো, ফটো তুলো। আমি ক্যামেরাম্যানের ভূমিকায়। কিছুক্ষণ সাঁতার কাটার পর সে উঠে এলো সৈকতে। এক নারী কয়েকটা কামিজ নিয়ে দৌড়ে এলো তার কাছে। ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে বলল, ভালো কাপড়, কিনবা? বউ একটা জামা দেখিয়ে বলল, এটা কত? ৩৬ ইউরো। মেজাজ খারাপ হয়ে গেল আমার। ভেবেছিলাম, ফুটপাতের জিনিস, কত আর হবে, পাঁচ–সাত শ টাকা। সে দাম হাঁকছে ৪ হাজার টাকা। খুবই সাধারণ একটা জামা। তাকে বললাম, লাগবে না, যাও। এখন সমুদ্রে নামার পালা আমার। বউ কাপড়চোপড়, টাকা পয়সা পাহারা দেবে, ছবি তুলবে, আমি সাঁতরাব। সৈকত থেকে পানিতে নামলাম। অসাধারণ সৈকত। চারদিক বালুময়। ঢেউ এসে আলত করে ছুঁয়ে যায় পা। মোলায়েম বাতাস ধুয়ে নেয় শরীর। আজ এখানকার তাপমাত্রা ২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস কিন্তু সৈকতের তাপমাত্রা মনে হচ্ছে ২০ । পানিতে খুব আরাম-আরাম ভাব। না ঠান্ডা, না গরম। অনেক বছর পর আমি সমুদ্রে গোসল করতে নেমেছি। ইতোমধ্যে সৈকতে গিয়েছি অনেকবার কিন্তু গোসল করা হয়নি। বৈরী পরিবেশ কিংবা অত্যধিক ঠান্ডার কারণে। আন্তালিয়ার সিডে সমুদ্রসৈকতে সাঁতার কাটতে দারুণ লাগছে। ওপড়ে মস্ত আকাশ, উড়ছে বেলুন, আশপাশে শিশু-কিশোরের উচ্ছ্বাস, স্পিডবোট নিমিষেই হারিয়ে যায় চোখ থেকে, সৈকতে সাদা-সাদা ছাতা দাঁড়িয়ে আছে মেঘ হয়ে। অর্ধনগ্ন মানুষেরা শুয়ে আছে বালুর শরীরে, রোদের তাপ নেয়, কেউ গেলে নেশার পানীয়। অদ্ভুত, বড়ই অদ্ভুত। এই অদ্ভুত ভাললাগা এই সময়ে, দূর লাল সবুজের এক মানুষ এসে ডুব দেয় সুলতানদের দেশে, কামাল আতাতুর্ক তুমি কি দেখতে পাও! বউ ক্লিক-ক্লিক ছবি তুলছে, আর বকা দিচ্ছে নগ্ন মানুষদের, একদম হায়াশরম নাই, নামেই মুসলিম। আমি বললাম, এসব নগ্ন মানুষেরা তো তুরস্কের লোক না, ৯৯% ইউরোপের লোক। ওহ, তাই তো! এখন বকা ফেরত নাও। বউ হাসে।  

ছবি: সংগৃহীত

আবার কিছুক্ষণ সাঁতার কেটে ওপড়ে উঠলাম। বউকে বললাম, চলো, হোটেলে ফিরে যাই। ছেলের কাছে চাবি নেই। সে রুমে ঢুকতে পারবে না। হাঁটতে থাকলাম খালি পায়ে। কিন্তু সৈকতের ওপরের দিককার বালু, যেখানে জলের স্পর্শ নেই, সেই বালু প্রচণ্ড গরম, পা রাখা যায় না, হাতে থাকা স্যান্ডেল পরলাম। রাস্তার পাশে কিছুক্ষণ পরপর পা ধোয়া, গোসল ও কাপড় পাল্টানোর সুন্দর ব্যবস্থা। এগুলো ব্যবহার করতে টাকা লাগে না। হাতমুখ ধুলাম। তারপর ছুটলাম হোটেলের দিকে। হাঁটতে হাঁটতে শরীরে থাকা ভেজা কাপড় শুকিয়ে গেল। আমি দ্রুত এপার্টমেন্টে ফিরতে চাই, ছেলের কাছে চাবি নাই, সে যদি দাঁড়িয়ে থাকে! তার যদি বাথরুম পায়! কিন্তু বউয়ের কোনো তাড়া নেই। পথে দোকান দেখলেই ঢুকে যায়, এটা কেনে, সেটা কেনে। বউকে ঝাড়ি দিলেও তার লাগে না। সমস্যা হচ্ছে, ছেলের কাছে মোবাইল আছে কিন্তু মোবাইলে নেটওয়ার্ক নেই। চাইলেই যোগাযোগ করতে পারবে না। আমরা তার হটস্পট ব্যবহার করি। টাকা বাঁচে। কিছু বাজার সদাই করে হোটেলে ফিরলাম। পকেট থেকে চাবি বের করে রুমে ঢুকতে যাব, অমনি দেখি ভেতর থেকে দরজা খুলে গেল। ভেতরে দাঁড়ানো আমার ছেলে অনুভব। কীরে, তুই রুমে ঢুকলি কী করে ! তোর কাছে তো চাবি নেই! সে হেসে বলল- এপার্টমেন্টে এসে দেখি দরজা খোলা। এক সাদা মহিলা রুম ক্লিন করছে, ব্যাস ঢুকে গেলাম। তারপর সে দিনের ফিরিস্তি দিতে শুরু করল। কোথায় কী করেছে। বলল, দুইটা সিকিউরিটি তাকে ফলো করছিল। সে দাঁড়ায়। সে তাদের বলল, তোমরা আমাকে ফলো করছ কেন? তোমাকে একটু চেক করতে হবে। কেন! কেন! তুমি সৈকতের যে এলাকায় ছিলে, সেখান থেকে ৩০০০ লিরা (তুরস্কের মুদ্রা ) খোয়া গেছে। তা আমাকে সন্দেহ হচ্ছে কেন? কারণ, যার লিরা হারানো গেছে, সে বলেছে, তার সন্দেহ ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের জার্সি পরা এক বালককে। তোমার পরনেও ম্যানচেস্টারের জার্সি। এই জার্সি তো অনেকেই পরে। তুমি মাইন্ড না করলে, তোমাকে একটু চেক করব। করো, করো। চেক করে ওরা যখন বুঝল, ভুল মানুষকে টার্গেট করেছে তারা, দুঃখিত বলে দ্রুতই কেটে পরল। অতঃপর হঠাৎ সে শুনতে পেল আজানের শব্দ। খুঁজে-খুঁজে বের করে ফেলল মসজিদ। নামাজ পরল। তারপর মোবাইল বের করে বলল, বাবা, মসজিদের ভিডিও নিয়ে এসছি, দেখবা? দেখি তো। ভিডিও দেখাল, খুব সুন্দর মসজিদ তো। আমি বললাম। ছেলে খুশি হয়ে বলল, কাল তোমাকে ওখানে নিয়ে যাবনে। আচ্ছা। আর শোন, সব সময় স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করবা, যাতে কেউ তোমাকে খারাপ না ভাবে। সন্দেহ না করে। আরে! আমি তো স্বাভাবিকই ছিলাম। আমি আর কথা বাড়ালাম না। আমি জানি, আমার ছেলে রহস্য পছন্দ করে। গ্যাংস্টারদের ছবি দেখে। কিশোর বয়সে কত কিছুই হতে ইচ্ছে করে মানুষের। গোসল করে ভাত খেলাম টেংরা মাছ আর ডাল দিয়ে। মাছ লন্ডন থেকে রান্না করে আনা। ভাত ও ডাল রান্না হয়েছে এপার্টমেন্টেই। ডাল রান্না করেছি আমি। বউ বলল, ডাল মজা হয়েছে। আসলে এখানকার প্রায় সবকিছুই ভাল কিন্তু অনেক দোকান খুঁজে ভালো চাল পেলাম না। সব দোকানেই শুধু এক জাতের চাল। ভাত রান্না করলে কেমন যেন ফুলে-ফেঁপে ওঠে। তবে দেখতে শোভনীয় না হলেও, খেতে ততটা খারাপ না। বিশেষ করে ডালের সঙ্গে, সহজেই পেটে চালান হয়ে যায়। তারপরও ভাত তো! এটা না হলে তো আমাদের চলে না। একটা ব্যাপার ভেবে খারাপ লাগছে। পৃথিবীর যেখানেই গিয়েছি, বাংলাদেশের মানুষ পেয়েছি। দূরদেশে নিজেদের মানুষ পেলে, খুশিখুশি লাগে। এখানে তেমন কাউকে পেলাম না। কেউ কী নেই! নাকি আমার খোঁজায় ভুল হচ্ছে। দুপুরে খেয়ে বিছানায় গড়াগড়ি দিলাম। বিকেলে বারান্দায় বসে কেক, কফি খেলাম তিনজনে বসে। বাতাস ধুয়ে নেয় শরীর। পাশেই লাল-লাল ফুল ফুটে আছে। চারদিকে শান্ত পরিবেশ, মুগ্ধ করা বিকেল। আহা। কফি খেয়ে বেরিয়ে পরলাম Devlet Agorasi দেখতে, তার পাশেই Apollon Temple। গ্রিক সভ্যতার দুর্লভ নির্দেশন। আগরার অর্থ হচ্ছে বাজার। হোটেল থেকে আগরাসির দূরত্ব ১০ মিনিট। ট্যাক্সিতে। ভাড়া ৮ ইউরো, প্রায়

১০০০ টাকা। একজন দোকানদার আমাদের ট্যাক্সি ডেকে দিলেন। তুরস্কের লোক ভদ্র, সাহায্যপরায়ণ। আর যদি বোঝেন, আপনি মুসলিম, তাহলে আরও বেশি আন্তরিক হন। আগরাসি পৌঁছে চোখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। কী দারুণ সভ্যতা। হাজার হাজার বছর আগের কী দারুণ নির্মাণ। সেখানে অনেক পর্যটকের ভিড়। ঢুকতে পয়সা লাগে না। আমরা ছবি তুললাম। সামনে কিছুটা এগুতেই শুনলাম আজান হচ্ছে। মাগরিবের। ছেলেকে বললাম, চল, নামাজ পড়ে আসি। চলো। আমরা মসজিদ খুঁজতে লাগলাম। একটা মার্কেটের মধ্য দিয়ে। অদ্ভুত সুন্দর সেই মার্কেট। ছবির মতো। আলোকোজ্জ্বল। কিন্তু মসজিদ পেতেপেতে নামাজের সময়ই পেরিয়ে গেল। আমরা মুসাফির, রুমে ফিরে কসুরের নামাজ পরলেও চলবে। মার্কেটের পাশেই সমুদ্র। শান্ত তার জল। চারদিকে বাতি জ্বলছে। পাড়ে বাঁধা অসংখ্য ছোটছোট ডিঙি। সন্ধ্যায় ওদের বিশ্রামের পালা। দিনে সরব থাকে। আমরা ঘুরেঘুরে সব দেখতে থাকলাম। মুগ্ধ হয়ে। এখানে আইসক্রিমের দোকানগুলোতে শিশুদের ভিড়। আইসক্রিম বিক্রেতারা বিভিন্ন ধরনের কমেডি করে। মুগ্ধ হয় সবাই। এক দোকানে দেখি কী একটা বিক্রি করছে। সেটা খেলে নাক-মুখ দিয়ে ধোঁয়া বের হয়। ছেলে বলল, সেটা সে খাবে। এক বক্স ৫ ইউরো। সেখানে অনেক লোকের ভিড়। ছেলে সে খাবার কিনল। বিক্রেতারা খাবার দেবার সময় ধোঁয়ায় ভরিয়ে দিল ছেলের মুখ। খুব চমৎকার সেই দৃশ্য। আনন্দময়। আসলে খাবার তেমন কিছু না, প্রন কেকারসে ধোঁয়া সংযুক্ত করেছে তারা। খেলে নাক-মুখ দিয়ে ধোঁয়া বের হয়। পাশেই এক লোক দেখি। শামুক বিক্রি করে। এক শামুকের মাংস, লেবুর রস মিশিয়ে দিলে, দাম দাঁড়াবে ৫ ইউরো। মানে ৬০০ টাকা। এক শামুক ৬০০! ছেলেকে বললাম, শামুক খাবি? ফ্রান্সে তো শামুক খেতে চেয়েছিলি। না বাবা, খাব না। মনেমনে বললাম, আমাদের দেশে যে খাবার হাঁস খায়, সেটা কিনে খাব? তা–ও ৬০০ টাকায়! একটু হাঁটতেই সামনে দেখি এক দোকান। মানুষের প্রচণ্ড ভিড়। কারণ কী! এগিয়ে দেখি, এখানে ১ ইউরোতে এক আইটেম পাওয়া যায়। কোনো কোনো আইটেম ৫–১০ ইউরোও আছে। বউ, ছেলে দ্রুতই ঢুকে গেল সেখানে। ছেলে কিনল ৪ ইউরো দিয়ে দুইটা আংটি, আর বউ কিনল কয়েকটা গিফট আইটেম, সে তার প্রিয়জনদের দেবে। দোকান থেকে বেরিয়ে ছেলে বলল, বাবা, রাতের খাবার এখানেই সেরে ফেলব কিনা ? চলো খেয়ে ফেলি। এক রেস্তোরাঁয় দেখি বড়বড় রুটি সেঁকছে। তাতে মাংস ঢুকিয়ে রুল বানিয়ে দেয় ওরা। ছেলে নিল, গরুর মাংস, আমরা মোরগের। রেস্তরাঁর বাইরে পাতা চেয়ারে বসে খেতেখেতে দেখি দুটো কুকুর যত্রতত্র ঘুরছে, আমাদের দেশের কুকুরের মতো, বেওয়ারিশ। সাধারণ এই দৃশ্য ইউরোপে দেখা যায় না। ইউরোপের কুকুর আসলেই ভাগ্যবান। তারা মালিকের বাড়িতে থাকে পরম যত্নে। এখানে ব্যতিক্রম। রাতের খাবর সেরে ট্যাক্সির লাইনে দাঁড়ালাম। এখানে প্রচুর পর্যটক। সাদা মানুষই বেশি। এপার্টমেন্টের সামনে এসে ট্যাক্সি থামলাম। এই ট্যাক্সিওয়ালা গাড়ি চালিয়েছে ঝড়ের বেগে। তাকে আস্তে চালাতে বলেছিলাম, সে শুনেনি। তাকে ১০ ইউরো ভাড়া দিতেই সে তার একটা কার্ড দিল, যাতে পরবর্তীতে আবার ডাকি। মনেমনে বললাম, তোকে আবার ডাকব, মরতে? ট্যাক্সি থেকে নেমেই বউ ঢুকে গেল ব্যাগের দোকানে। ছেলেও বলল, সে অনেকগুলো বেল্ট কিনবে। এগুলো ব্র্যান্ডের বেল্ট। নকল ব্র্যান্ড। ৫ পাউন্ড দিয়ে কিনে ১৫ পাউন্ডে বিক্রি করবে। তার বন্ধুদের কাছে। ইতোমধ্যে সে নাকি ১৮০ পাউন্ডের অর্ডারও পেয়ে গেছে। বন্ধু–বান্ধবীদের কাছে থেকে। ওরে বাবা, এ তো বিরাট ব্যবসায়ী দেখছি। বউ–ছেলে বেল্ট, ব্যাগ কিনল। অনেক টাকা গেল পকেট থেকে। এপার্টমেন্টে ফিরে ছেলেকে বললাম, লাভের কত অংশ দিবি আমাকে? জিরো পারসেন্ট। ছেলে হাসে। যাক, আমার লাভ লাগবে না। আসলটা ফেরত দিয়ে দিবা। বাবা, তুমি কোনো টাকা পাবা না। কেন! কেন! এবার কিন্তু তুমি ঈদ সালামি দাও নাই। মনে করো এইটাই ঈদ সালামি। ওরে আমার ব্যবসায়ী! এখন আমার সঙ্গেও ব্যবসা ! ছেলে হাসে। ছেলের মা ছেলের পক্ষ নিয়ে বলে, এই, তুই এক টাকাও দিবি না। শেষ পর্যন্ত ধরা খাইলাম আমি! অবশ্য কিছুকিছু ধরা মধুরও হয়। হয় না!

৪.
পরদিন ঘুম থেকে উঠলাম সকাল আটটায়। বউ, ছেলে তখনো ঘুমাচ্ছে। উঠে তুরস্ক সফরের বর্ণনা লিখতে শুরু করলাম। বউ উঠল ৯টায়। নাস্তা খেলাম টটিলা, ডিম কফি। আজ শুক্রবার। মসজিদে নামাজ পড়তে যাব। ছেলেকে ঘুম থেকে উঠালাম। খুব অলস প্রকৃতির। ধাক্কাতে ধাক্কাতে রেডি করালাম। ট্যাক্সি নিলাম ৮-১০ মিনিটের পথ। আবহাওয়া বেশ উতপ্ত। পথে লোকজন কম। আমাদের দেশে জুম্মার নামাজের সময় যে রকম অসংখ্য টুপিওয়ালা লোক রাস্তায় দেখা যায়, সে রকম দেখা গেল না। ট্যাক্সিওয়ালা মসজিদের সামনে থামল। ট্যাক্সিওয়ালাকে বললাম, রান্নার জন্য মোরগের মাংস কিনব, দোকান কোথায়? সে একটা দোকানের লোকেশন বলল। চমৎকার মসজিদ। খোলামেলা। চারদিকে গাছ। কেউ কেউ গাছের নিচে জায়নামাজ বিছিয়েছেন নামাজ পড়তে। আমরা ভেতরে প্রবেশ করলাম। আমার কাছে মসজিদটা নতুন কিন্তু ছেলের কাছে না। সে গতকাল এসে নামাজ পড়ে গেছে। মসজিদের জুতা রাখার জায়গাটা খুব সুন্দর। ভেতরে বসলাম। ওয়াজ করছেন ইমাম সাহেব, সম্ভবত টার্কিশ ভাষায় কিন্তু সে ভাষা আমাদের কাছে বোধগম্য নয়। অবাক হয়ে খেয়াল করলাম, ৯৫% মানুষের মাথায় টুপি নেই এবং প্রায় সবাই টি শার্ট বা গেঞ্জি পরিহিত। ইমাম সাহেবও শার্ট ইন করে, বেল্ট মেরে এসেছেন। তবে সাংস্কৃতিক পার্থক্য থাকলেও, সুরা কিংবা নামাজে কোনো পার্থক্য নেই। মসজিদ থেকে বেরুতে বেরুতে দেখলাম দুটো ফুটফুটে বালক থালা হাতে দাঁড়িয়ে আছে। এই ধনী দেশেও ভিক্ষুক!
মসজিদ থেকে বেরিয়ে মোরগের মাংস খুঁজতে লাগলাম। বউয়ের কড়া নির্দেশ, মাংস নিয়ে বাড়ি ফিরবা। হোটেলের আশপাশের অনেক দোকানে মাংস খুঁজেছি, কোথাও মাংস নেই। ট্যাক্সিচালকেরা কথামত সেই দোকানের কাছাকাছি হতেই দেখি, সেটা কোনো সুপার স্টোর না, ফ্রাই চিকেনের রেস্তোরাঁ। কী আর করা, ছেলে বলল, সে চুল কাটবে।
তোর চুল তো লম্বা হয়নি।
তাও কেটে ফেলি। চুল কাটায় তুরস্কের নাম আছে।
ঠিক আছে।
রোদ ও গরম মাথায় নিয়ে হাঁটতে লাগলাম। ১০ মিনিট পর সেলুন পেলাম। টিপটপ সেলুন। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। তবে একটু অপেক্ষা করতে হবে। আমাদের আগে আরও দুইজন আছেন। অপেক্ষা করতে খারাপ লাগছে না। ঠান্ডা রুমে গান বাজছে। সেলুনের মালিক ভালো ইংরেজি বলতে পারেন। তাকে বললাম, কোথায় মুরগির মাংস পাওয়া যাবে। সে বলল, সেলুন থেকে বেরিয়ে বাম দিকে যাবা, মিনিক দশেক হাঁটার পর একটা সুপার স্টোর পাবা, ওখানে সব পাবা।
আশ্চর্য হয়ে ভেবেছি, এই দেশের অনেক দোকানি ‘চিকেন’ শব্দের অর্থ বোঝে না। আমাদের দেশে ‘চিকেন’ বললে, লেখাপড়া না জানা অনেক লোকও বুঝে যায়। যাক, সুপার স্টোরে গিয়ে চিকেন পাওয়া গেল। সঙ্গে কিনলাম আরও অনেক কিছু। তারপর ট্যাক্সি চড়ে হোটেলে। রুমে ফিরে রুই মাছ আর মুরগির মাংস দিয়ে ভাত খেলাম। এ মাংস লন্ডন থেকে রান্না করে আনা। খেয়ে দিলাম আরামের ঘুম। ঘুম থেকে উঠে দেখি বউ-ছেলে শপিং করতে চলে গেছে। ছেলের মাথায় শুধু ব্যবসা। তুরস্ক থেকে কিনে, লন্ডনে নিয়ে বিক্রি করবে, বন্ধুদের কাছে। রোজ আমাকে হিসাব দেখায়, বাবা, ৫০ পাউন্ড লাভ, ১০০ পাউন্ড লাভ। কিন্তু আমার টাকায় যে এসব কিনছে, এ টাকা ফেরত দেওয়া দরকার, এ নিয়ে তার কোনো কথা নেই। আমিও এই উদীয়মান কিশোর ব্যবসায়ীর স্বপ্ন দেখে পুলকিত হচ্ছি। অবশ্য আমি তার ব্যবসায় খুব একটা আশাবাদী না। কারণ, ইতিপূর্বে সে আমাকে বলেছিল, ১৮০ পাউন্ড দিতে। তা দিয়ে সে একটা ট্র্যাকস্যুট কিনবে, বিক্রি করবে ৩০০ পাউন্ডে। নিজে লাভ রেখে, আমার মূলধন ফেরত দেবে। তাকে আমি ১৮০ পাউন্ড দিলাম। সে ট্র্যাকস্যুট কিনল। কিন্তু বিক্রির কোনো নামগন্ধ পেলাম না। একদিন দেখি, সে ওই ট্র্যাকস্যুট পরে হাঁটছে। ব্যাপার কী! বিক্রি করবি না?
সে একটা হাসি দিল। বলল, দেখলাম জিনিসটা খুব সুন্দর, তাই নিজেই পরে ফেললাম।
ব্যবসা এখানেই শেষ। আমার মূলধনও। এখন আবার শুরু হয়েছে নতুন ভাবে। আল্লাহই জানেন এবার আমার মূলধনের কী হয়।
বউ-ছেলে অনেক কিছু কিনে রুমে ফিরল। আমি বললাম, তোমরা তো অনেক কিছুই কিনলা, আমি তো একটা সুতাও কিনলাম না।
বউ বলল, কিন না কেন! তোমাকে কে আটকাইছে!
সন্ধ্যার পর বেরুলাম, একা। ভালই লাগছে। স্বাধীন, স্বাধীন। মাঝেমধ্যে একা থাকা ভালোই। নিজেকে উপভোগ করা যায়। প্রতিদিন হোটেল থেকে বেরিয়ে বাম দিকে যাই। বামে অনেক দোকান। আজ ভাবলাম উল্টা দিকে যাই। গেলাম। সেখানে পেয়ে গেলাম সাধ্যের মধ্যে দুইটা পলো শার্ট আর একটা নীল রঙের শার্ট। কিনে ফেললাম। রিসোর্টে ঢুকেই দেখি, ছেলে সুইমিংপুলে ডুব দিচ্ছে। কিরে, এই সন্ধ্যায় গোসল?
বাবা, তুমিও আসো।
ঠিক আছে, আসতেছি।
রুমে বাজার রেখে সুইমিংপুলে এলাম। বিকেল বলে কোনো ভিড় নেই। শুধু আফ্রিকান এক পরিবার। বাপ-ছেলে সাঁতার কাটলাম। বল নিয়ে খেললাম। খুব ভাললাগছে এই বলে যে সে সাঁতরাতে পারে, আগে পারত না। রুমে ফিরে গোসল করলাম। আবার লিখতে বসলাম। নামাজ পড়লাম। আর ছেলেকে বলল, আজ তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়তে হবে। কাল সকালে আমাদের নৌকাভ্রমণ। বাস নিতে আসবে সকাল ৯টায়। সেটা কোনোভাবেই মিস করা যাবে না। তারপরও ঘুমাতে ঘুমাতে সেই বারোটাই।
চলবে....

**দূর পরবাসে লেখা পাঠাতে পারবেন আপনিও। ঠিকানা [email protected]