শরতের এই মায়াবিক্ষণে: জীবনের এক নতুন অধ্যায়

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

পিকাডেলি সার্কাস, লন্ডনের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত এক ব্যস্ত চত্বর, যেখানে দিনের আলোর মতো মানুষের ভিড় কখনো কমে না। একসময় এ স্থানটি শুধু পথচারীদের গন্তব্যস্থল ছিল, কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিকতার ছোঁয়া পেয়েছে, ওপর দিয়ে হাঁটার রাস্তা এবং নিচে টিউব রেলস্টেশন গড়ে উঠেছে। বহু চলচ্চিত্রে এই স্থানটি ব্যবহৃত হয়েছে, যেমন মিস্টার বিনের সেই বিখ্যাত দৃশ্য যেখানে তিনি পিকাডেলি সার্কাসে ঢুকে বিভ্রান্ত হয়ে যান, কীভাবে বের হতে হবে, তা বুঝতে পারেন না। আমাদের জীবনও অনেক সময় এমনই হয়ে পড়ে—অজানা পথের মধ্যে হারিয়ে যাই। তবে লক্ষ্য যদি স্থির থাকে, তাহলে বিপদের মধ্যেও দিশা খুঁজে পাওয়া যায়। যেমন ব্যর্থতাকে জয় করে সঠিক পরিকল্পনা দিয়ে নতুন পথ খুঁজে পাওয়া যায়।

এই পরিকল্পনা ঠিক যেমন রান্নায় খিচুড়ি করার মতোই—সহজ, কিন্তু সুস্বাদু। বাংলাদেশে খিচুড়ি একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় খাবার, যা অনেক উপায়ে তৈরি করা যায়। আমি যদিও ডাল-ভাত পছন্দ করি, মাঝেমধ্যে সবজি আর মাংস দিয়ে খিচুড়ি রান্না করি। বিভিন্ন ধরনের ডাল আর মসলা ব্যবহার করে খিচুড়ির স্বাদে বৈচিত্র্য আনা সম্ভব। তবে, বিশ্বের অন্য কোনো দেশে আমাদের মতো খিচুড়ি রান্না হয় কি না, তা আমার জানা নেই। কিছু দেশ যেমন স্পেনের পায়েইয়া আর ইতালির রিসুতো খাবারের ক্ষেত্রে আমাদের দেশের সঙ্গে কিছুটা মিল রয়েছে। পায়েইয়া ও রিসুতো দুটি খাবারই মজাদার কিন্তু তাদের মধ্যে মসলার ব্যবহারে বিশাল পার্থক্য রয়েছে।

আজকের দিনে, পায়েইয়া আর রিসুতো নিয়ে কথা বলা বেশ প্রাসঙ্গিক। আমাদের প্রাইমারি স্কুলের লাঞ্চ মেনুতেও হয়তো এ ধরনের খাবার যুক্ত করা যেতে পারে। পায়েইয়া স্পেনের জাতীয় খাবার বলা চলে, বিশেষ করে ভ্যালেন্সিয়ায় এটি বেশ জনপ্রিয়। বিরিয়ানির মতো নানা ধরনের মসলা দিয়ে এটি তৈরি করা হয়। আমি সামারকালে বাইরে পায়েইয়া রান্না করি, সুইডেনের গ্রামাঞ্চলের নীরব প্রকৃতির মধ্যে, যেখানে প্রতিবেশীরা জড়ো হয়ে আড্ডায় মেতে ওঠে। অন্যদিকে, রিসুতো খিচুড়ির মতো হলেও এতে ডাল বা হলুদের ব্যবহার নেই। আজ রিসুতো রান্নার সময় আমার ছোটবেলার অনেক স্মৃতি ফিরে এলো। মাশরুম, এসপারাগাস, আর স্টেক দিয়ে তৈরি করা রিসুতোর স্বাদ অতুলনীয়। ইতালিতে বহুবার রিসুতো খেয়েছি, কিন্তু নিজের হাতে রান্না করা রিসুতো যেন আরও মধুর।

আমার রান্নায় এ বৈচিত্র্য শুধু শখ নয়, এটি বৈশ্বিক সংযোগের প্রতিফলন। গ্লোবালাইজেশনের যুগে মাল্টিকালচারাল সংমিশ্রণ একটি স্বাভাবিক ঘটনা। তাই নিজের দেশের খাবার ও সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসার পাশাপাশি অন্য সংস্কৃতির খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গেও মানিয়ে চলা গুরুত্বপূর্ণ। একজন বিশ্বনাগরিক হতে হলে শুধু নিজের ভাষা জানাই যথেষ্ট নয়, যে দেশে বসবাস করছেন তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি বোঝাও সমান জরুরি। যখন আপনি কারও নিজস্ব ভাষায় কথা বলেন, সেই মানুষটি ঠিক তেমনই খুশি হয়, যেমন আপনি হন আপনার ভাষায় কিছু শুনলে। এতে শুধু সম্পর্কের গভীরতা বাড়ে না, বরং আন্তঃসম্পর্কের বন্ধনও দৃঢ় হয়।

বর্তমানে, আমি আমার কমিউনিটির সঙ্গে সংযোগ স্থাপনে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছি। আমার বিশ্বাস, সমাজে যদি আমরা সমন্বয় করতে পারি, তাহলে একসময় সবাই তা থেকে শিখবে। আর এই শিক্ষা ছড়িয়ে পড়বে সমগ্র সমাজে।

শরৎ যেন এ বছর একেবারে উজ্জ্বল হয়ে হাজির হয়েছে ইউরোপের নর্ডিক দেশগুলোতে। যাঁরা শখের বাগান করেছেন, তাঁদের এখন ফসল তোলার সময়। উইকেন্ডে সুইডেনের প্রতিটি গ্রামে শাকসবজি বেচাকেনার মেলা বসছে। এমনই এক আনন্দময় শরতে আমি আমার ছোট্ট বাগানে বাংলাদেশি শাকসবজির চাষ শুরু করেছি, যা এখন সবাইকে আকর্ষণ করছে। আমার গ্রাম কুংস্যাঙ্গেনের (Kungsängen) ওরোকের্স লডা গোর্ড (råkers lada gård) আজ এক জমজমাট বাজারে পরিণত হয়েছে। সেই মেলার ভিড়ে হাজির হবে দুজন বিশেষ মানুষ—আন্দ্রেস আর মারিয়া।

দুজনের গল্প যেন সিনেমার মতো—বহুদিন পর আবার তাদের দেখা হয়েছে, একে অপরের জীবনে নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা করতে। পুরনো সম্পর্কের চাপা অনুভূতিগুলো আবার জীবন্ত হয়ে উঠছে। স্টকহোমের গামলা স্টানের খোয়া-পাথরের সরু গলিতে, যেখানে সময় থেমে থাকে, সেখানে তাদের হঠাৎ দেখা হয়ে গেছে। যেন দশ বছরের ব্যবধান মুহূর্তে মুছে গেছে, আর নতুন করে তাদের জীবন শুরু হতে যাচ্ছে।

আজ আমি তাদের দুজনকেই আমার কুংস্যাঙ্গেনের বাড়িতে আমন্ত্রণ জানিয়েছি। আমার ‘লিটল বাংলাদেশ’ নামের এই স্বর্গতুল্য স্থানে, যেখানে বাংলাদেশের লাউ, কুমড়া, পুঁইশাক আর মরিচের সুবাস ছড়িয়ে পড়ে। এই নীরব গ্রামে আজ বাঙালি স্টাইলে খিচুড়ির আয়োজন হবে, সুইডেনের হিমেল বাতাসে গরম ধোঁয়া আর মসলার সুবাস মিলেমিশে এক স্বর্গীয় পরিবেশ তৈরি করবে।

তবে এটি শুধুই একটি সাধারণ ভোজন নয়। এটি হবে এক নতুন জীবনের সূচনা—আন্দ্রেস আর মারিয়ার জন্য, যারা এত দিনের একাকীত্ব আর চাপা অনুভূতি পেছনে ফেলে নতুন করে একসঙ্গে পথচলা শুরু করবে। শরতের এই মায়াবী পরিবেশে, তাদের গল্পের এক নতুন অধ্যায় রচিত হবে, যা শুরু হবে আমার ‘লিটল বাংলাদেশ’ থেকে।

*লেখক: রহমান মৃধা, সুইডেন

*দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]