যুক্তরাষ্ট্রে দ্বৈত নাগরিকত্ব বাতিলে আসছে বিল: যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী বাংলাদেশিদের ভবিষ্যৎ কী?

ডোনাল্ড ট্রাম্পছবি: এএফপি

যুক্তরাষ্ট্রে দ্বৈত নাগরিকত্ব (ডুয়েল সিটিজেনশিপ) বাতিল করার লক্ষ্যে কঠোর একটি আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে দেশটির রিপাবলিকান পার্টি। ওহাইওর রিপাবলিকান সিনেটর বার্নি মোরেনো সম্প্রতি এ–সংক্রান্ত একটি বিল সিনেটে পেশ করেছেন, যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘এক্সক্লুসিভ সিটিজেনশিপ অ্যাক্ট অব ২০২৫’।

যদি এই বিল আইনে পরিণত হয়, তবে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্য দেশের দ্বৈত নাগরিকেরা কঠিন এক সংকটের মুখে পড়বেন। আইনটি কার্যকর হলে তাদের যেকোনো একটি দেশের নাগরিকত্ব বেছে নিতে হবে।

যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত প্রায় পাঁচ লক্ষাধিক বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্যক্তিদের (আনুমানিক) মধ্যে যাঁরা দ্বৈত নাগরিকত্ব ধারণ করেন, তাঁদের জীবনে এই আইন সরাসরি এবং সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলতে পারে।

প্রস্তাবের মূলকথা: ‘শুধু যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিই আনুগত্য’

সিনেটর মোরেনোর প্রস্তাবের মূল বক্তব্য হলো একজন মার্কিন নাগরিকের আনুগত্য শুধু যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিই নিবেদিত হওয়া উচিত। দ্বৈত নাগরিকত্ব স্বার্থের সংঘাত এবং বিভক্ত আনুগত্য (ডিভাইডেড লয়্যালিটিস) সৃষ্টি করে।  

বিলটি আইনে পরিণত হলে যা ঘটবে

• সব দ্বৈত নাগরিককে তাঁদের বিদেশি নাগরিকত্ব আনুষ্ঠানিকভাবে পরিত্যাগ করার জন্য একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা (সম্ভবত এক বছর) দেওয়া হবে।

• যদি তারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অন্য দেশের নাগরিকত্ব ত্যাগ না করেন, তবে তাঁরা স্বয়ংক্রিয়ভাবে মার্কিন নাগরিকত্ব হারাবেন।

• প্রস্তাবটি এমন এক সময়ে এল, যখন সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব বাতিল করার বিষয়ে নানা মন্তব্য করে আসছেন। সব মিলিয়ে রিপাবলিকানদের পক্ষ থেকে অভিবাসন ও নাগরিকত্ব–সংক্রান্ত আইনকে আরও কঠোর করার একটি স্পষ্ট ইঙ্গিত এটি।

প্রবাসী বাংলাদেশি-আমেরিকানদের ওপর সম্ভাব্য প্রভাব

যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত প্রায় পাঁচ লক্ষাধিক বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্যক্তিদের (আনুমানিক) মধ্যে যাঁরা দ্বৈত নাগরিকত্ব ধারণ করেন, তাঁদের জীবনে এই আইন সরাসরি এবং সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলতে পারে। যদি বিলটি আইনে পরিণত হয়, তবে বাংলাদেশি-আমেরিকান দ্বৈত নাগরিকদের নিম্নলিখিত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে—
১. আর্থিক ও সম্পত্তির অধিকার
• বাংলাদেশে বিনিয়োগ: বহু বাংলাদেশি-আমেরিকান দ্বৈত নাগরিক হিসেবে বাংলাদেশে স্থাবর সম্পত্তি, জমি বা ব্যবসা-বাণিজ্যে বিনিয়োগ করেছেন। যদি তাঁরা মার্কিন নাগরিকত্ব ধরে রাখার জন্য বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ত্যাগ করেন, তবে বাংলাদেশে তাঁদের সম্পত্তির মালিকানা ও উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে।
• ব্যাংকিং ও লেনদেন
বাংলাদেশে ব্যাংক হিসাব পরিচালনা এবং অর্থ স্থানান্তরের ক্ষেত্রে বিদেশি হিসেবে আলাদা বিধিনিষেধের সম্মুখীন হতে হবে।

২. যাতায়াত ও ভিসা জটিলতা

দ্বৈত নাগরিকেরা উভয় দেশের পাসপোর্ট ব্যবহার করেন। বাংলাদেশি বলে ‘নো ভিসা রিকোয়ারমেন্ট’ দিয়ে আমেরিকান পাসপোর্টে সহজে বাংলাদেশে যেতে পারেন বাংলাদেশিরা। বাংলাদেশের নাগরিকত্ব হারালে তাঁদের প্রতিবার ভিসা নিতে হবে।

৩. রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকার

•  নির্বাচনে অংশগ্রহণ: বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ত্যাগ করলে স্বাভাবিকভাবেই তারা বাংলাদেশের কোনো নির্বাচনে প্রার্থী হতে বা ভোট দিতে পারবেন না।
• সরকারি চাকরি: বাংলাদেশের সরকারি চাকরি বা অন‍্য সাংবিধানিক পদে নিয়োগ পাওয়ার সুযোগ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যাবে।

৪. পরিচয়গত সংকট

• সাংস্কৃতিক ও পারিবারিক বন্ধন: অনেক বাংলাদেশি-আমেরিকান নিজেদের উভয় দেশের সংস্কৃতির অংশ মনে করেন। নাগরিকত্ব ছাড়ার এই বাধ্যবাধকতা তাঁদের মধ্যে একধরনের পরিচয়গত সংকট সৃষ্টি করতে পারে এবং জন্মভূমির সঙ্গে তাঁদের আইনি ও মানসিক সংযোগকে দুর্বল করে দিতে পারে।

দূর পরবাসে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

রাজনীতিতে বিতর্ক ও আইনি চ্যালেঞ্জ

ডেমোক্রেটিক পার্টির সদস্যরা এই বিলের তীব্র বিরোধিতা করছেন। তারা এটিকে অ-আমেরিকান এবং বিভেদ সৃষ্টিকারী আইন হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তাঁদের মতে, এটি বহু সংস্কৃতির ঐতিহ্য এবং উদার গণতন্ত্র নীতির পরিপন্থী।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই প্রস্তাব মার্কিন সংবিধানের ১৪তম সংশোধনীর সঙ্গে সাংঘর্ষিক হতে পারে, যা নিশ্চয়তা দেয় যে একজন মার্কিন নাগরিক স্বেচ্ছায় ত্যাগ না করলে তাঁকে তাঁর নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। তাই এটি আইনে পরিণত হলেও আইনি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে।

তবে বিলটি এখনো সিনেটে প্রস্তাবিত অবস্থায় আছে এবং আইনে পরিণত হওয়ার আগে কংগ্রেসের উভয় কক্ষে পাস হওয়া এবং একাধিক আইনি ধাপ পেরোনো প্রয়োজন।