পিঠাপুলি আর বিজয়ানন্দের একদিন
আসুন এই হিমেল হাওয়ায়, একটুখানি বসি,
পিঠাপুলি আর বিজয়ানন্দে মনের সুখে ভাসি!
শীতের হিমেল হাওয়া, চারদিকে সাদা তুষারে আচ্ছন্ন। এমন দিনে পিঠাপুলির অভাব সহজেই অনুমেয়। এই ডিসেম্বর আমাদের বেদনার, আমাদের আনন্দে আত্মহারা হওয়ার। যেমন ১৪ ডিসেম্বর বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করার আর তেমনিই ১৬ ডিসেম্বর বাঙালি জাতিকে বিজয় এনে দেওয়ায় আনন্দে আত্মহারা হওয়ার।
বাংলাদেশের মানুষ যেভাবে বিজয় দিবসকে, স্বাধীনতা দিবসকে অনুভব করেন, আমরা প্রবাসীরা এর চেয়ে কোনো অংশেই কম করি না, ক্ষেত্রবিশেষে হয়তো একটু বেশিই অনুভব করি মনে হয়। কারণ, দূরের জিনিস টানে বেশি। আবার স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করাই যে বড় কথা, তারও নজির আমাদের আছে। যার জন্যই আবারও ২৪–এর জুলাই-আগস্টে রক্ত ঝরেছে, নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্নে। এ ক্ষেত্রে প্রবাসীদের সংগ্রামও অনলাইন-অফলাইন অ্যাকটিভিজম প্রতিনিয়ত অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে আপামর জনসাধারণকে।
যাহোক, আমরা প্রবাসীরা বাইরের প্রতিটি শহরে চেষ্টা করি একেকটা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বাংলাদেশ গড়ে তুলতে। যা সম্ভব হয় একান্ত কিছু দেশপ্রেমিক মানুষের কল্যাণে। যাঁরা নিজের প্রচণ্ড কর্মব্যস্ততার মধ্যেও বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, সংস্কৃতিকে ধারণ, লালন ও পালন করে চলেছেন প্রতিনিয়ত এবং বিস্তৃত করে চলেছেন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে।
এখন ডিসেম্বরের মাঝামাঝি, বছরের শেষ দিনগুলো খুবই ব্যস্ততাময়। এরপরই পশ্চিমা দেশগুলোতে লম্বা ছুটি শুরু হবে। কি স্কুল, কি অফিস—সবখানে। তখন অনেকেই ঘুরবেন এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশে, ছুটে চলবেন প্রিয়জনের খোঁজে বা সারা বছরের ক্লান্তি দূর করার জন্য নিরিবিলি কোনো এক মনোরম ও মনোমুগ্ধকর স্থানে।
এরই মধ্যে সবকিছু সামনে রেখে সম্প্রতি অন্টারিওর লন্ডনে বাংলাদেশ কমিউনিটির হয়ে গেল বিজয় দিবস ও পিঠা উৎসব-২০২৪–এর এক বর্ণিল আয়োজন। যেখানে লন্ডন অন্টারিওতে বসবাসরত এখনো হাঁটতে না পারা আদরের সোনামণি থেকে বয়োজ্যেষ্ঠ পর্যন্ত সবারই অংশগ্রহণ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। কারও কারও লাল-সবুজ পোশাক যেমন দেশের জাতীয় পতাকাকে মনে করিয়ে দিল, আবার তেমনি ছোট ছোট সোনামণির গালেও ছিল ট্যাটু দিয়ে আঁকা বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার ছাপ।
আমাদের অনুষ্ঠানটি দুটি ভাগে ভাগ করা হয়, যার প্রথমাংশে থাকে পিঠাপুলির উৎসবে মেতে ওঠা, আর দ্বিতীয়াংশে থাকে মনোজ্ঞ এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
পৌষ মাস (ডিসেম্বর) আমাদের বিজয়ের আনন্দে আর পিঠাপুলির উৎসবে মেতে ওঠার মাস। তাই ‘পৌষ মোদের ডাক দিয়েছে, ছুটে ছুটে মেলায় যেতে’ স্লোগান সামনে রেখে মেলায় একসঙ্গে একাধিক খাবারের দোকান থাকে। এই দোকানগুলোতে থাকে নানা ধরনের পিঠাপুলি, যেমন ভাপা পিঠা, মুগ পাকন, নকশি পিঠা, পাটিসাপটা পিঠা, মুখে স্বাদ লেগে থাকার মতো বাংলার ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি, নোনতা খাবার, মোরগ পোলাও, তেহারি, কাচ্চি বিরিয়ানি, বিরিয়ানি, আখনি (সিলেটি ঐতিহ্যবাহী খাবার), চটপটি, ফুচকা, ঝালমুড়ি এবং বিভিন্ন ধরনের আচার। শীতের সন্ধ্যায় একটু উষ্ণতা দেওয়ার জন্য থাকে চায়ের টংদোকান।
আমাদের এই আয়োজনে বিদেশের মাটিতে বসে প্রাণের বাংলাদেশকে খুঁজে পাওয়া যায়, যা সব শ্রেণির দর্শকের উপস্থিতি মেলাকে প্রাঞ্জল করে তোলে। মেলাটি শুধু পিঠা আর বিজয় উদ্যাপনের জন্যই নয়, এর মাধ্যমে যদি কেউ কেউ দাতব্য কোনো সংগঠনের জন্য কাজ করেন বা কেউ উৎসাহ পেয়ে থাকেন, তখন এর গুরুত্ব বেড়ে যায় আরও অনেক গুণ, যেমন মাণির এলেবেলে থেকে লভ্যাংশ দেওয়া হয় বাংলাদেশে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষা নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান, ‘ছায়াতল বাংলাদেশ’–এ। যেখানে বঞ্চিত শিশুরা সব ধরনের সুযোগ–সুবিধা পায়। তা ছাড়া এর মাধ্যমে বাংলাদেশি শিশুদের মধ্যে দেশপ্রেম জাগ্রত করা বা সৃজনশীলতা বৃদ্ধি করার জন্য অঙ্কনের ব্যবস্থা করা হয়।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানটি শুরু হয় আমাদের স্কুলপড়ুয়া শিশুদের সম্মেলিত কণ্ঠে ভুপেন হাজারিকার ‘আমরা করব জয়’ গানটির মধ্য দিয়ে। এরপর একে একে দেশাত্মবোধক সংগীত, ‘সেই রেললাইনের ধারে মেঠো পথটার পারে দাঁড়িয়ে’. যা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে যাওয়া সন্তানের জন্য প্রতীক্ষারত এক মায়ের আকুতিকে তুলে ধরে; ‘ও আমার বাংলা মা তোর আকুল করা রূপের সুধায় হৃদয় আমার যায় জুড়িয়ে’; জেমসের ‘মা’ গানসহ বেশ কিছু মা, মাটি ও দেশ–সম্পর্কিত গান পরিবেশনা করেন বিদেশের মাটিতে বসে দেশের জন্য সংগীতচর্চা করতে থাকা একদল সংগীতপ্রেমী। এই পর্বটি শেষ হয় বাংলাদেশ ও কানাডার জাতীয় দলীয় সংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে।
অবশেষে নানা কর্মযজ্ঞের পর আয়োজকেরা শিশুদের পারফর্ম করার জন্য প্রস্তুত করতে তাদের অভিভাবকদের ও শিক্ষকের সময় ও স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের জন্য, কিছু তরুণ উদ্যমী স্বেচ্ছাসেবক যাঁরা অনুষ্ঠানের অনেক আগে থেকেই নিরলস কাজ করে এসেছেন এবং সর্বোপরি অনুষ্ঠানটির পৃষ্ঠপোষকদের ও প্রাণপ্রিয় দর্শকদের বিশেষ ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আগামী দিনে আবার দেখা হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়।
লেখক: নূর আলম, পোস্টডক্টরাল রিসার্চ ফেলো, ম্যাকমাস্টার বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা ও আয়োজক কমিটির অন্যতম সদস্য
**দূর পরবাসে লেখা, ভিডিও, ছবি, ভ্রমণকাহিনি, গল্প ও নানা আয়োজনের কথা পাঠান [email protected]এ