বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম বালি দ্বীপে আনন্দভ্রমণ
অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির বাংলাদেশিদের সংগঠনের (কিউইউটি-বিএ) পক্ষ থেকে বেশ কিছুদিন ধরে চলছিল বার্ষিক বনভোজনের আয়োজন। স্থান ও তারিখ নির্ধারণে ফেসবুক পেজে রীতিমতো ভোটাভুটির মাধ্যমে নির্ধারিত হলো বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম বালি দ্বীপের নর্থ স্ট্রাডব্রোক। সদস্যদের পড়াশোনার ব্যস্ততায় বিদেশের মাটিতে চল্লিশের মতো সদস্য একসঙ্গে একটি পুরো দিন কাটানো যাবে, চুটিয়ে আড্ডা দেওয়া যাবে, একসঙ্গে দর্শনীয় কিছু জায়গা দেখা যাবে—এমন প্রথম অভিজ্ঞতা নিতেই রেজিস্ট্রেশন করে ফেলা হলো।
ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনায় কিছুটা ভাটা ফেলল, যখন বলা হলো সকাল সাতটায় গাড়ি ছেড়ে দেওয়া হবে! আমাদের মতো বাঙালিরা যেখানেই যাই না কেন, সকাল সাতটা মানে অনেক সকাল। তারপরও বেশির ভাগ সদস্যই নির্ধারিত সময়ে উপস্থিত হলো। ইউনিভার্সিটি থেকে গন্তব্য বেশি দূর না হলেও কেন এত সকালে রওনা দিতে হবে, তা ভাবতেই ড্রাইভার বলল ফেরিতে পার হয়ে যেতে হবে দ্বীপে, আর ফেরি প্রতি দুই ঘণ্টা পরপর হলেও ছুটির দিনে আগেই ভর্তি হয়ে যায়। সব প্রস্তুত হলেও করিতকর্মা সভাপতি হাফসা হাকিম পিয়ালের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না! কারণটা পরে আবিষ্কার হলো যে তাঁর গাড়িতে সকাল-বিকেলের নাশতা আর দুপুরের খাবারের বহর। সব গুছিয়ে সকাল ৭টা ৪০-এর মধ্যে রওনা দেওয়া সম্ভব হলো। ভাড়া করা বাস নির্ধারিত সময়ের প্রায় ৪০ মিনিট আগে পৌঁছে গেল ফেরিস্ট্যান্ড ক্লিভল্যান্ডে পৌঁছা গেল। হাতে সময় থাকায় সকালের নাশতার লাইন করা হলো। বাংলাদেশি বনভোজনের ফ্লেভারে পাউরুটি, ডিম, জুস আর জেলি দিয়ে সকালের নাশতা সেরে আবার বাসে বসা হলো। বাসের ভেতরে এখানে ফ্রেশ পানি ছানা কোনো কিছু খেতে দেওয়া হয় না।
চোখের পলকে বিশাল ফেরি ‘সি-লিঙ্ক’ ভিড়ল, বাসও তাতে উঠল। কিন্তু চালক দরজা খুলছেন না। বারবার বাইরে থেকে মাইকে আওয়াজ দিচ্ছে, ফেরি ছাড়ার আগে যাত্রীদের নিরাপত্তার স্বার্থে কারও ফেরিতে নামা যাবে না। ফেরি ছাড়ার পরপরই সবাই নেমে ফেরির ছাদে ছবি তোলায় ব্যস্ত হয়ে গেল। হবেই না বা কেন? নীল আকাশ আর সমুদ্রের সবুজ পানি মিলিয়ে তৈরি হয়েছে এক নয়নাভিরাম দৃশ্য। কিছু সদস্য আবার বারবার ছবি তুলছেন আর বলছেন, ‘অনেক দিন ফেসবুকের প্রোফাইল পিকচার চেঞ্জ করা হয় না!’ এই দলের প্রথম সারিতে অবশ্য রাজু, রাজন, ফয়সাল ও তন্ময়রা ছিল। ফেরির ক্যানটিনে বসে, ছাদে ছবি তুলে, আড্ডা দিতে দিতে প্রায় এক ঘণ্টা সময় কীভাবে শেষ হলো বুঝে ওঠা গেল না। তাতে মরিটন বে সমুদ্রভ্রমণ শেষে পাড়ে এসে পৌঁছাল বাস।
এবার আবার উদ্দেশ্য লুকআউট পয়েন্ট। অসাধারণ মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক দৃশ্যের জন্য বিখ্যাত একটি পয়েন্ট। পয়েন্টে নেমেই দুই ঘণ্টা বরাদ্দ হলো আয়োজক কমিটির পক্ষ থেকে। জায়গাটির বিশেষ আকর্ষণ হলো হেঁটে হেঁটে সৈকতের চারপাশ দিয়ে কাঠের পাতাটন ও পাহাড়ের ওপর থেকে সমুদ্র, ডলফিন, তিমি আর মাছ ধরা দেখা। ছুটির দিন হলেও নিরিবিলি পরিবেশে সমুদ্রকে উপভোগের জন্য এমন স্থান পাওয়া সত্যিই কঠিন মনে হলো। আর সবাই সবার ফোন ও ক্যামেরায় নিজের, প্রকৃতির, ডলফিন, তিমিকে ধারণে ব্যস্ত তখন। সময় নির্দিষ্ট রাখায় নিজেদের মতো করে কয়েকটা গ্রুপে ঘোরাঘুরি হলো। দলের কেউ পাহাড় দেখতে চান, কেউবা তিমি দেখায় ব্যস্ত। যাঁদের সঙ্গে ছোট শিশুরা এসেছে, তাঁরা আবার সৈকতের বালুতে খেলতে নিয়ে যেতে চান। কারণ, অনেকটা নিরাপত্তা। সমুদ্র থেকে এত উঁচু পাহাড়ে উঠে শিশুরা অনেকটা আনন্দে ‘তিড়িংবিড়িং (!) লাফানোয় ব্যস্ত হয়ে উঠছিল। এতে যেকোনো মুহূর্তে দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা ছিল। সমুদ্রের পাশ ঘেঁষে প্রায় চার কিলোমিটার হাঁটা হলেও নয়নাভিরাম দৃশ্যকে সঙ্গে নিয়ে সেটাকে কিছুই মনে হচ্ছিল না। দেখলাম পর্যটক হিসেবে অনেক বয়স্ক মানুষও এখানে এসেছেন। প্রয়োজনে বিশ্রামের জন্য মাঝেমধ্যেই কিছু বেঞ্চ রাখা আছে। আরেকটি বিষয় খুব দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে, তা হলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা। এগুলোর কারণ হিসেবে মনে হয়েছে সামাজিক সচেতনতার পাশাপাশি আইনি ঝক্কিঝামেলার ভয়। একটি ব্যানারে লাল কালিতে লেখা, সামুদ্রিক ঝিনুককে ডিস্টার্ব করা বা সংগ্রহ করার জন্য ৫০ হাজার ডলার পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে।’ ভাবা যায়! প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণে কতটা তৎপর তারা। ইতিহাস থেকে দেখা যায়, প্রথম যখন ১৮২০ সালে দলগত ভ্রমণ শুরু হয় দ্বীপটিতে, তখন সেখানে পাঁচ হাজারের বেশি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বাস ছিল।
সবাই ঘাসের ওপর বসে লাঞ্চ সেরে ফেলা হলো। মজার ব্যাপার হলো, শেষ রাতে রান্না করা খাবার হলেও বিশেষ কৌশলে তা দুপুরেও গরম ছিল। দেশের বনভোজন হলে আমরা নিশ্চয়ই চিন্তা করতাম, একজন বাবুর্চি নিয়ে বাসে রান্নার উপকরণ নিয়ে রওনা দেওয়া। এখানে সেটা সম্ভব নয়। বিভিন্ন পয়েন্ট কিছু বারবিকিউ চুলা আছে, অল্পজনের হালকা রান্নাবান্না সম্ভব। লাঞ্চ শেষে সবাই মিলে বাসসহ রওনা দিলাম সিলিন্ডার সৈকতে। আরেক চোখজুড়ানো সমুদ্রসৈকত। সৈকতে কেউ গোসল, কেউবা ছবি তোলা আবার এক গ্রুপ আমরা ব্যস্ত হয়ে গেলাম ফুটবল খেলায়। কয়েকজনে ভাগ হয়ে অনেকটা ‘যেমন পারো, তেমন খেলা’। সেখানে ধীরে ধীরে ১২ থেকে ১৪ জন প্রায় আধা ঘণ্টা খেলে একেকজন পুরোই ক্লান্ত। হবেই না বা কেন? বিভিন্ন বয়সীদের একেকজন হয়তো ৮ থেকে ১০ বছর পর ফুটবল খেলল।
এরপর প্রায় আধা ঘণ্টা বাসযোগে চলে গেলাম এমিটি পয়েন্টে। বাসে যাওয়ার পথে কিছু ক্যাঙারুর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল! এমিটি পয়েন্ট মূলত ক্যাম্পিংয়ের জন্য বিখ্যাত। যেখান থেকে মনোমুগ্ধকর পরিবেশে সূর্যোদয় বা সূর্যাস্ত দেখা যায়। যদিও বলা হয় ওখানে ডলফিন, পেলিকন ও কোয়ালা উঠে আসে, আমাদের তেমনটা চোখে পড়ল না। অনেককেই সমুদ্রে মাছ ধরা ও সার্ফ এ ব্যস্ত থাকতে দেখা গেল। আমরা অবশ্য ব্যস্ত ছিলাম চুলা জ্বালিয়ে চা বানানোতে। বিকেলের নাশতায় সমুদ্রের পাড়ে বসে গরম চায়ের অনুভূতি নিতে ব্যস্ত হয়ে গেলাম সবাই। যদিও চুলাতে বেশি গরম করা সম্ভব হলো না। তারপরও কম কিসে!
সবশেষে আবার ফেরি ধরার তাড়া। ফেরিতে সন্ধ্যায় শান্ত-স্নিগ্ধ আকাশ, সূর্যাস্তের লাল আবরণ আর সমুদ্রের নীল-সবুজ পানি মিলিয়ে অন্য রকম অনুভূতির তৈরি করেছিল। সবাই মনের মতো করে কিছু ছবি তুলে স্মৃতির পাতাকে কিছুটা সমৃদ্ধ করে নিলাম। সব মিলিয়ে সন্ধ্যা সাতটার মধ্যে আমাদের গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম। যেখানে প্রতিদিন সকাল-রাত্রি হয় নির্ধারিত রুটিনে। রুটিনের বাইরে সবাই মিলে একটি দিন আনন্দে কাটানোর সুযোগ দেওয়ার জন্য বাংলাদেশি অ্যাসোসিয়েশনকে ধন্যবাদ। বিশেষ করে যাঁরা ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে পরিশ্রম করে বনভোজনের সফলতা এনেছেন, সবাইকে কৃতজ্ঞতা।
লেখক: পিএইচডি গবেষক, কুইন্সল্যান্ড ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি, ব্রিসবেন, অস্ট্রেলিয়া