আসমা আব্বাসী খালাকে যেমন দেখেছি
তখন মাত্র মাকে হারিয়েছি। মা–হারা জীবনযাপনে অভ্যস্ত হওয়া যে কত বড় অসম্ভব ব্যাপার, পদে পদে তা অনুভব করছি। নানুর আদর-যত্নের ইতি টেনে দিলেন বিধাতা, তাই আমার মেয়ে দুটিও হারানোর ব্যথায় কাতর।
আমরা তখন আমার মায়ের বাড়ি ধানমন্ডিতে এসেছি, তাঁর হঠাৎ চলে যাওয়ার কঠিনতম খবর পেয়ে। আম্মার দোয়া অনুষ্ঠানে শরিক হয়েছিলেন আসমা খালা। তাঁর পোশাকি নাম আব্বাসী। যাওয়ার সময় আমার মেয়েদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘এত লক্ষ্মী মেয়ে তোমার। এমন মিষ্টি চেহারা আমি খুব কমই দেখেছি।’ খালার বাচনভঙ্গির উষ্ণতা আর আন্তরিক শব্দচয়নের মিশেলে প্রতিটি বাক্যই খুব সহজে শ্রোতার মন ছুঁয়ে যেত। আমার মেয়েদের মুখের হাসিও তার প্রমাণ দিল। পজিটিভ শব্দ বা প্রশংসা দিয়ে মানুষের দিনটি ভালো করে দেওয়া বা কাউকে অনুপ্রাণিত করার এক অপূর্ব গুণ ছিল আসমা খালার। কর্মক্ষেত্রে ইতিবাচক ভাইব সৃষ্টির সফলতা নিয়ে আজকের দুনিয়ায় খুব মাতামাতি হলেও সেই কবে, আমার বোধশক্তি হওয়ার পর থেকেই দেখেছি, খালা কেবল প্রশংসাই করতেন না, জানতেন কীভাবে তা সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে হয়।
আম্মার চলে যাওয়ার খবর যখন পাই, তখন আমার স্বামীর পোস্টিং ছিল চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে। আম্মার খুব শখ ছিল আসমা খালাসহ তাঁর কাজিন ও ভাইবোনদের নিয়ে চট্টগ্রামে আমাদের বাসায় বেড়াতে আসবেন। বর্ষায় যেহেতু মশার উপদ্রব বেশি থাকে, তাই ম্যালেরিয়া থেকে নিরাপদ থাকার জন্য আমরা পরামর্শ দিয়েছিলাম শীতের সময় আসার জন্য। কিন্তু বিধাতার পরিকল্পনা ছিল অন্য। ধানমন্ডিতে, নিজ আবাসস্থলে ঘুমের মধ্যেই আমাদের মা চিরবিদায় নিলেন। এর কিছুদিন পরই আমরা কুমিল্লা সেনানিবাসে চলে আসি। মা–হারানোর কষ্ট ক্ষণে ক্ষণেই মনকে ভারাক্রান্ত করে তুলত।
মা যেন ছিলেন আমার ধ্রুবতারা। তাঁকে ছাড়া জীবনের পথচলা ভয়ংকর মনে হতে লাগল। কোনো কিছু করতেও ইচ্ছা হতো না, আবার রূঢ় বাস্তবতা বরাবরই কর্তব্যের কথা স্মরণ করিয়ে দিত পলে পলে। অনেকের ভাব দেখে মনে হতো, ‘দুই সন্তানের মা হয়েও মায়ের মৃত্যুতে এত আদিখ্যেতা কেন?’...মা–হারানোর কষ্ট যে বয়সের ধার ধারে না, তা যিনি হারিয়েছেন তিনিই বুঝবেন। এই সময়ে কুমিল্লা থেকে কতবার যে আমি আসমা খালাকে ফোন করেছি। সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, সংগঠক, রেডিও ও টিভি ব্যক্তিত্ব আসমা খালা শতব্যস্ততার মধ্যেও অশেষ ধৈর্য নিয়ে, পরম মমতায় ৫০ মাইল দূরে থেকেও আমার পাশে দাঁড়িয়েছেন। সান্ত্বনা দিয়েছেন মা–হারা বোনের মেয়েকে। এই মমতা তাঁর কাছেই পাওয়া যায়, যিনি অন্যকে স্নেহের বাঁধনে জড়িয়ে রাখতে জানেন। অযথা কথার মারপ্যাঁচে অন্যকে না কাঁদিয়ে ভাবেন কথার জাদু দিয়ে কীভাবে জয় করা যায় অন্যের মন। যাঁরা খালাকে চেনেন তাঁরা জানেন তিনি কারো বিপদে কতটা সহায়ক হতে পারতেন।
খালা আমার মায়ের আপন বোন ছিলেন না, ছিলেন খালাতো বোন। তবে খালাকে আমি বেশি পেয়েছি রেডিওতে অনুষ্ঠান করতে গিয়ে। খালা তাঁর কোনো এক ইন্টারভিউয়ে বলেছিলেন, রেডিওতে কাজ করতে গিয়ে তিনি খুব স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন, রেডিও ছিল তাঁর মায়ের বাড়ির মতো। ভিজ্যুয়াল নয়, অডিওনির্ভর এ মাধ্যমটি আমারও খুব ভালো লাগত। অনেক রেডিও অনুষ্ঠানেই খালার সঙ্গে অংশগ্রহণের সৌভাগ্য হয়েছে আমার। নারীদের অনুষ্ঠানগুলোই এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। রেডিও স্টেশনে খালা ছিলেন একেবারে ভিন্ন মানুষ। তাঁর সময়জ্ঞান ছিল খুবই কঠোর। স্টুডিওতে থাকার সময়ে অনুষ্ঠানের প্রাসঙ্গিক বিষয় ছাড়া ব্যক্তিগত কোনো বিষয়ে কথাবার্তা হতো না। অন্য সবার সঙ্গে আমাকেও খালা ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করতেন। আসমা খালার আদর্শ অনুসরণ করে আমিও অনুষ্ঠানের সঞ্চালক, আসমা আব্বাসী খালাকে বাকি সবার মতো ‘আপা’ বলে সম্বোধন করতাম। এই প্রচণ্ড পেশাদারি পরিবেশের মধ্যে থেকে কীভাবে যেন খালার ওপর ভরসা জন্মায়, যেমন ভরসা অর্জন করেন একজন সফল টিম লিডার তাঁর কর্মক্ষেত্রে। এখন মনে হয়, কেবল রক্তের সম্পর্ক নয়, একজন প্রকৃত ‘লিডারের’ প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থেকেই খালাকে প্রয়োজনে ফোন করতাম আমি। আরও পরে যুক্তরাষ্ট্রে আসার পর, পেশাগত দক্ষতা বাড়ানোর কোর্সগুলো সম্পন্ন করতে গিয়ে জেনেছি ‘উপযুক্ত প্রশংসা’ কর্মক্ষেত্রে পজিটিভ পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য কতটা জরুরি। আসমা খালার এই বড় গুণটি নিশ্চয় ছিল বিধাতাপ্রদত্ত।
পরে আমাদের ঢাকায় পোস্টিং হলে আসমা খালার সঙ্গে মাঝেমধ্যে দেখা হতো। অন্য খালাদের সঙ্গে খালাকেও বাসায় নিমন্ত্রণ করেছি দু–একবার। ভেতর আর বাইরের উজ্জ্বলতা দিয়ে খালার আগমনে প্রতিটি সমাগমই হয়ে উঠত আলোকিত।
প্রবাসে পাড়ি জমানোর পর যোগাযোগ অনেকটাই বন্ধ হয়ে যায় দেশের আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে। জীবন ও জীবিকার তাগিদে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। মাঝেমধ্যে দেশে গেলেও খালার সঙ্গে তেমন একটা দেখা হয়নি। কোভিডের পর খালার বড় বোনের নাতনির বিয়েতে দেখা হয়। বিয়ের দাওয়াত পাই যুক্তরাষ্ট্রে বসেই। এই বিয়ে উপলক্ষে যে প্রিয় মুখগুলো দেখার জন্য অধীর আগ্রহে দিন গুনছিলাম, তাদের মধ্যে খালার মুখ ছিল অন্যতম। দেখাও হয়েছিল তাঁর সঙ্গে। সেই জড়িয়ে ধরা, নানা ধরনের প্রশংসা...কী যে ভালো লেগেছিল খালাকে দেখে! আমি তখন মা–বাবা দুজনকেই হারিয়েছি। মুখে সেই চিরাচরিত হাসি ঝুলিয়ে খালাকে দেখেছি বিবাহ-চত্বর ঘুরে বেড়াচ্ছেন আপন দ্যুতি ছড়িয়ে। অনেক দিন পর খালার ছোট মেয়ে লাবনীর সঙ্গেও দেখা হলো সেখানে।
গেল বছর নভেম্বরে ‘থ্যাংকস গিভিং ডে’র ছুটিতে গিয়েছিলাম দেশে। হাতে গোনা মাত্র কয়েটা দিন। মামাতো বোন কেয়া আপা আর আমি গিয়েছিলাম খালাকে দেখতে। ‘আমি কেন আর লেখালেখি করি না’—এই অনুযোগ করেছিলেন খালা।
মানুষ মানুষের জন্য, আত্মীয় আত্মীয়ের জন্য। ব্যস্ততার অজুহাতে আমরা সেই চিরাচরিত প্রথাগুলো ভুলতে বসেছি। ব্যস্ততা যেমন বেড়েছে, তেমনি প্রযুক্তির সুবাদে যোগাযোগের সব দরজা এখন আমাদের সামনে খোলা। সময় থাকতে আমরা যেন সে সুযোগকে কাজে লাগাই, যাতে পরে আফসোস করতে না হয়, ‘আহা, কেন ফোনটা করলাম না!’
আসমা আব্বাসী ৪ জুলাই চলে গেলেন পৃথিবী ছেড়ে। যেতে হবে আমাদের সবাইকে। তাঁর অমৃতসম কথার মাধ্যমে অন্যের মনে যে ভালোবাসার বীজ বপন করে গেছেন, তার মাঝেই তিনি বেঁচে থাকবেন চিরদিন।
সামিরা, লাবনী, প্রয়োজনে মা–হারানোর দুঃখ ভাগাভাগি করার জন্য সব সময় তৈরি আছি, জেনো।
*লেখক: শবনম চৌধুরী, এলিমেন্টারি স্কুল টিচার, ক্যালিফোর্নিয়া, যুক্তরাষ্ট্র