সুইডেনের জয়িতাদের গল্প!
গত ৩০ সেপ্টেম্বর সাপ্তাহিক ছুটির দিন থাকায় এখানকার অধিবাসীদের একটু বেলা করেই ঘুম থেকে ওঠেন। কিন্তু সুইডেনের বন্দরনগরী ও দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর গোথেনবার্গের প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য এই শনিবারটা অন্য রকম। সেখানে এদিন অনুষ্ঠিত হয় শুধু বাংলাদেশি মেয়েদের জন্য প্রথমাবারের মতো আয়োজিত জয়িতা ব্যাডমিন্টন চ্যাম্পিয়নশিপ ২০২৩। অংশগ্রহণকারী খেলোয়াড় ও আয়োজকদের যে রাতে ঘুমই হয়নি উত্তেজনায়। দর্শকেরাও অনেকে আগ্রহভরে প্রস্তুত হচ্ছেন দিনটি উদ্যাপনের জন্য। দুই দিন আগেই জানা যায়, আয়োজনে প্রধান অতিথি হিসেবে সস্ত্রীক উপস্থিত থাকছেন সুইডেনে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মেহ্দি হাসান। এতে আয়োজনের প্রসারটা আরও বড় আকার ধারণ করে।
কিছুটা ভূমিকা দিয়ে রাখা দরকার, কেমন করে জয়িতার যাত্রা শুরু হলো। উত্তর মেরুর নিকটবর্তী দেশগুলোর একটি সুইডেন, নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া আর ১২ মাসে তেরপার্বণের দেশ থেকে আসা প্রবাসীদের জন্য এখানকার আবহাওয়া খুব একটা সুখকর নয়। বছরের অনেকটাজুড়ে কনকনে শীত, তুষারপাত ও সূর্যের দেখা না পাওয়া অনেকেরই বিষণ্নতার কারণ। এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার একটা উপায় নানা ধরনের সামাজিক আয়োজনে নিজেকে যুক্ত রাখা। বিদেশে থাকলেও সামাজিক এ আয়োজনগুলো অনেকাংশেই নিজ নিজ দেশের মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। গোথেনবার্গ শহরের হাজারখানেক বাংলাদেশিরা তাই জড়িয়ে থাকে ঘরোয়া আড্ডা, বন্ধুরা মিলে ঘুরতে যাওয়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন উৎসবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বা ক্রীড়া প্রতিযোগিতায়। অন্যসব বিষয়ে স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশগুলোর নারী-পুরুষের সমতা মোটামুটি বজায় থাকলেও খেলাধুলার ক্ষেত্রে প্রবাসী বাংলাদেশি নারীদের অংশগ্রহণ একেবারেই অপ্রতুল। সুইডেনের এ ছোট্ট গ্রীষ্মকালে তাই ছেলেদের ক্রিকেট-ফুটবল বিভিন্ন টুর্নামেন্টের আয়োজন থাকলেও মেয়েদের জন্য আয়োজন তেমনটা নেই বললেই চলে। গ্রীষ্মের সূর্যের তেজ কমতে থাকা আগস্টের শেষে তাই কজনের মাথায় আসে, মেয়েদের জন্য কোনো খেলার আয়োজন হলে মন্দ হয় না। ব্যাডমিন্টন টুর্নামেন্টই সব থেকে গ্রহণযোগ্য মনে হলো আমাদের। তখনই এশিয়া কাপ ও বিশ্বকাপ ক্রিকেটের মাঝামাঝি একটা সময় ঠিক করে এ উচ্চাকাঙ্ক্ষী কাজ বাস্তবায়নের পরিকল্পনা শুরু হয়।
উচ্চাকাঙ্ক্ষী কেন বলা হলো তারও একটা ব্যাখ্যা প্রয়োজন। যেহেতু মাত্র এক মাসের মতো সময়েই টুর্নামেন্ট নামানোর প্রস্তাব হয়, বিদেশের সপ্তাহজুড়ে নয়টা-পাঁচটা কাজ শেষে নিজ হাতে ঘরের সব কাজ শেষ করে সপ্তাহান্তের দুটো দিন হিসাব করলে হাতে সময় শুধু ৮-১০ দিন। এর মধ্যে অন্য সব আয়োজন বাদ দিলে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ও বড় চ্যালেঞ্জ খেলোয়াড় জোগাড় করা। বাংলাদেশে যেহেতু প্রথাগতভাবে মেয়েদের খেলাধুলায় অংশগ্রহণ কম, তাই মেয়েদের খেলায় রাজি করানো, ঘর ও বাচ্চা সামলে তাঁদের প্রস্তুতির জন্য সময় বের করা মোটামুটি এক অসাধ্য ব্যাপার। কিন্তু এ অসাধ্য সাধন করতে শুরুতেই এগিয়ে এলেন ১০–১২ জন। তাঁদের নিয়েই শুরু হলো প্রস্তুতি।
ইউরোপের অন্যান্য দেশের মতো সুইডেনের ভালো ব্যাপার হলো এখানে খেলাধুলা বা সুস্বাস্থ্যের জন্য নগরগুলো অনেক মনোযোগী। শহরের বিভিন্ন এলাকায় আউটডোর ও ইনডোরে খেলার ব্যবস্থা থাক।
যে কেউ অনলাইনে তা বুকিং দিতে পারে নির্দিষ্ট ওয়েবসাইট থেকে। আবার বিভিন্ন কোম্পানিগুলো তাদের চাকরিজীবীদের জন্য এসব খেলাধুলায় অংশগ্রহণের জন্য একধরণের প্রণোদনা দিয়ে থাকে, খেলাধুলার জন্য খরচ করা টাকার একাংশ ফেরত দিয়ে। কোম্পানির এ সুবিধা নিয়েই বেশির ভাগ সময় বুকিং দেওয়া হতো কোর্টগুলো। প্রতি শুক্রবার সন্ধ্যা ও শনিবার দুপুরে চলল খেলার প্রস্তুতি টুর্নামেন্টের আগপর্যন্ত। এর মধ্যেই আয়োজকদের অনুপ্রেরণায় রাজি হয়ে গেল আরও বেশ কয়েকজন। শেষ পর্যন্ত ২২ খেলোয়াড় পাওয়া গেল প্রবাসী বাংলাদেশি নারীদের মধ্যে! সত্যি বলতে তাঁরা সবাই শুরু থেকেই জয়ী, প্রবাসের এ ব্যস্ত জীবনের মধ্যে নিজের জন্য এটুকু সময় বের করার যুদ্ধে, প্রথা ভেঙে এগিয়ে আসার যুদ্ধে। টুর্নামেন্টের নামও তাই ঠিক হলো ‘জয়িতা ব্যাডমিন্টন চ্যাম্পিয়নশিপ।’
টুর্নামেন্টের দিন সকাল ১০টায় শহরের ‘জিবিএফ হালেন’ এ সম্মিলিত খেলোয়াড় ও দর্শকেরা জাতীয় সংগীত গেয়ে আয়োজন শুরু করেন, আবেগটাও তাই তখন বাঁধভাঙা। প্রথমে একক প্রতিযোগিতার সেমিফাইনাল পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয় এরপর মধ্যাহ্নভোজের বিরতির পর দ্বৈত প্রতিযোগিতার সেমিফাইনাল।
রাষ্ট্রদূত আমাদের সঙ্গে যোগ দেন বেলা দুটোয় এবং একক ও দ্বৈতের ফাইনাল ম্যাচ দুটো দর্শকদের সঙ্গে উপস্থিত থেকে উপভোগ করেন। এক মাসের অনুশীলনে খেলোয়াড়দের অনেকেরই ব্যাপক উন্নতি হয়, তাই টানটান উত্তেজনার মধ্যেই বেশির ভাগ ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। এককে বিজয়ী হন নাজনীন ইসলাম রনি এবং রানার-আপ বিদিতা জামান; দ্বৈতে বিজয়ী মুনতাহা তাবাসসুম তরু ও বিদিতা জামান এবং রানার-আপ নিপা সুলতানা কণা ও হিমিকা রিসাদ। টুর্নামেন্টে বিজয়ীদের হাতে ট্রফি তুলে দেন রাষ্ট্রদূত এবং সেই সঙ্গে অংশগ্রহণকারী সব জয়িতাকেই মেডেল পরিয়ে দেন তাঁর স্ত্রী, অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি সানজিদা খানম। আয়োজদের পক্ষ থেকে স্মারক হিসেবে প্রধান অতিথি ও বিশেষ অতিথির হাতে তুলে দেওয়া হয় দুই বাংলাদেশি স্থপতির আঁকা একটি ছবি। শেষে এক সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে রাষ্ট্রদূত নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশের অবস্থান, বাংলাদেশি নারীদের অগ্রযাত্রায় ও বাংলাদেশি প্রবাসীদের সব ভালো উদ্যোগে পাশে থাকার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
ভবিষ্যতে এ টুর্নামেন্টের আর বড় পরিসরে আয়োজনে আশা করছি। সমগ্র সুইডেন, এমনকি ইউরোপ থেকেও বাংলাদেশি মেয়েরা যাতে অংশগ্রহণ করতে পারে, সে চেষ্টা থাকবে। নেপোলিয়নে যেমন বলেছিলেন তুমি আমাকে শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাকে শিক্ষিত জাতি দেব, আজ অনেকটা বছর পর এসে বুঝতে পারি নেতৃত্ব বিকাশে খেলাধুলার ভূমিকার কথা, নেপোলিয়ন এ কথা জানলে হয়তো মায়েদের খেলাধুলার ব্যাপারেও এতটাই জোর দিতেন। বাংলাদেশের মেয়েরা যাতে দেশে-বিদেশে খেলাধুলার সুযোগ পান, তেমনটা আশা থাকবে।