জাপানে ঈদ পুনর্মিলনী ও বাংলা নববর্ষ উদ্যাপন
বাংলাদেশি প্রবাসীর সংখ্যাটা দিন দিন হুহু বেড়েই চলেছে। পৃথিবীর এমন কোন দেশ হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে প্রবাসী বাংলাদেশি নেই! জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে প্রবাস জীবন বেছে নেওয়া আমরা সবাই দেশ, স্বজন, পরিবার এবং বন্ধুবান্ধব থেকে যোজন যোজন দূরে অবস্থান করি। প্রবাসে আমরা প্রত্যেকেই ভিন্ন ভিন্ন জায়গা, সমাজ কিংবা ভিন্ন ভিন্ন দেশ থেকে এলেও ধর্মীয় কিংবা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের বেলায় থাকে অভিন্ন আচার ও কর্মযজ্ঞ। ঈদ এবং বাংলা নববর্ষ আমাদের তেমনি একটি ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক আচার, যা এই প্রবাসে বসবাসরত বাঙালিদের একটি জায়গায় সমবেত হওয়ার সুযোগ করে দেয়। ঈদ এবং বাংলা নববর্ষ দুটোই এ প্রবাসে আমাদের কাছে একসঙ্গেই ধরা দিয়েছে। তার ফলে কানাজাওয়া বাঙালি পরিবার একতাবদ্ধ হয়ে ঈদ আর নববর্ষের আনন্দে মেতেছিল দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে।
১০ এপ্রিল ২০২৪ আমাদের ঈদুল ফিতর অনুষ্ঠিত হয়। জাপানে এই দিনটি কর্মদিবস হওয়ায় অনেকেই ঈদের নামাজ পড়ে নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে চলে গিয়েছেন। আবার কেউ কেউ ব্যক্তিগত ছুটি নিয়ে পরিবার আর বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে সময় কাটিয়েছেন। তবে প্রবাসী বাঙালিদের মূল আনন্দ-উদ্যাপনটা হয়ে থাকে সপ্তাহান্তে, ছুটির দিনে। এই দিনে সবাই একত্র হয়ে সম্মিলিতভাবে ঈদ পুনর্মিলনী এবং বর্ষবরণের মতো অনুষ্ঠান করতে পারে। আমরা কানাজাওয়া বাঙালি পরিবারের শতাধিক সদস্য নিয়ে ১৩ এপ্রিল, শনিবার ছুটির দিনে ঈদ পুনর্মিলনী এবং বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করি। করোনা মহামারির কারণে বিগত বছরগুলোতে বড় ধরনের কোনো আয়োজন সম্ভব হয়নি। তাই দীর্ঘ বিরতির পর এমন আয়োজনে সবার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল সত্যিই চোখে পড়ার মতো। আমরা কানাজাওয়া বাঙালি পরিবার এমন আয়োজনের জন্য যেন অনেক দিন থেকেই মুখিয়ে ছিলাম।
ঈদ পুনর্মিলনী এবং বর্ষবরণ অনুষ্ঠানটি সফলভাবে সম্পন্ন করার জন্য আমরা কয়েকটি কমিটি গঠন করি। এর মধ্যে ঈদ পুনর্মিলনী ডিসকাশন, রান্নার দায়িত্ব বণ্টন, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিচালন এবং নাটক মঞ্চস্থ কমিটি উল্লেখযোগ্য। প্রতিটি কমিটির কমিটি মেম্বাররা তাঁদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব সুন্দরভাবে পালন করে একটি সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন অনুষ্ঠান আয়োজনে সবাই ছিলেন বদ্ধপরিকর। ফলে আমরা কানাজাওয়া বাঙালি পরিবার দীর্ঘদিন পর একটি আনন্দমুখর ঈদ পুনর্মিলনী এবং বর্ষবরণের অনুষ্ঠান উপভোগ করতে পেরেছি।
ঈদ পুনর্মিলনী এবং বর্ষবরণের অনুষ্ঠানটি আমরা Ishikawa International Students House, কানাজাওয়াতে এ আয়োজন করেছি। Ishikawa International Students House–এর সুবৃহৎ কনফারেন্স রুম এবং প্রশস্ত লবি, যা প্রায় এক শ অংশগ্রহণকারীর জন্য পর্যাপ্ত স্পেস থাকায় বাচ্চাদের খেলাধুলাসহ অবাধ বিচরণ এবং বড়দের বাধাহীন আলাপে-আড্ডায় কোনো ধরনের অসুবিধায় পড়তে হয়নি। সকাল ১০টায় শুরু হওয়া অনুষ্ঠানের কার্যক্রম বিরতিহীনভাবে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা অবধি চলমান ছিল।
পবিত্র কোরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে শুরু হওয়া অনুষ্ঠানের পূর্বনির্ধারিত বিভিন্ন ইভেন্ট একের পর এক চলতে থাকে। প্রথমেই ছিল নবাগতদের ফুলের তোড়া দিয়ে বরণ করা এবং তাঁদের পরিচয় পর্ব। নবাগতদের সবাই আমাদের কানাজাওয়া বাঙালি পরিবারের সদস্য, তারপরও আনুষ্ঠানিকভাবে প্রত্যেককেই ফুল দিয়ে বরণ করে নেওয়া হয়েছে। পরিবার-পরিজন ছেড়ে বিদেশে পড়তে বা কাজ করতে আসা আমরা প্রত্যেকেই কমবেশি একাকিত্বের সম্মুখীন হই। বিদেশে বাঙালি পরিবারের এমন একটি প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে আমরা যখন নিজেদের আনন্দ-বেদনা, সুখ-দুঃখ, কিংবা ছোট-বড় অর্জনগুলো একে অন্যের সঙ্গে শেয়ার করতে পারি, তখন আর সেই একাকিত্বতা আর থাকে না। এভাবেই ‘কানাজাওয়া বাঙালি পরিবার’ প্রত্যেকের সমন্বয়ে প্রত্যেকের পরিবারের বাইরেও আরেকটি পরিবার হয়ে ওঠে। এই পরিবার জাপানের কানাজাওয়া সিটির একটি বৃহৎ যৌথ পরিবার, যার সদস্যসংখ্যা শতাধিক।
নবাগতদের বরণ এবং পরিচয় পর্বের পর শুরু হয় দুপুরের খাবারের আয়োজন। আমরা যে সুশৃঙ্খল, একে অন্যের প্রতি আন্তরিক, তা আবারও বুঝিয়ে দিয়েছি সুশৃঙ্খলভাবে লাইন ধরে একজনের পর আরেকজন খাবার নিয়ে। ক্ষুধায় পেট চোঁ চোঁ করলেও লাইন ধরে একের পর এক খাবার গ্রহণ করে ধৈর্য আর সুশৃঙ্খলতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন কানাজাওয়া বাঙালি পরিবারের সদস্যরা। খাবারের ফাঁকে ফাঁকে গল্প আর আড্ডা চলতে থাকে সমানতালে। জীবন-জীবিকা, রাজনীতি-অর্থনীতি, চাকরি-ব্যবসা কোনো কিছুই বাদ যায়নি গল্পে আর আড্ডায়।
দুপুরের সুস্বাদু খাবারের পর আবার ফিরে গেলাম মূল অনুষ্ঠানে। আমাদের আগে থেকেই একটা পরিকল্পনা ছিল যে দুপুরের খাবারের পর একটু ঝিমুনি আসবে, চোখজুড়ে নেমে আসতে চাইবে ঘুম। তাই এমন কিছু দিয়ে বৈকালিক প্রোগ্রাম শুরু করতে হবে, যাতে সবাই একসঙ্গে মেতে ওঠে এবং ঘুমকে তুড়ি মেরে দূরে সরিয়ে দেয়! বাস্তবে হয়েছেও তা–ই। দুপুরের খাবারের পর শুরু হয় আকর্ষণীয় গান এবং কবিতার আসর। কবিতার ছন্দে আর গানের মূর্ছনায় সবাই যখন বিভোর, ঠিক তখনই অনুষ্ঠানের মূল আকর্ষণ ‘নাটিকা’ নিয়ে হাজির হয়েছেন একদল তরুণ এবং গুণী পরিচালক, প্রযোজক এবং অভিনেতা-অভিনেত্রীরা। তাঁদের সাবলীল অভিনয়ে মঞ্চস্থ হয়েছে নাটিকা ‘টিকটিক, রিল, ভাইরাল-অস্থির জীবন’। বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে নাটিকাটি ছিল একেবারে যথোপযুক্ত। টিকটিক, রিল, ভাইরাল–পরবর্তী মানুষের জীবন যে আজ অস্থিরতায় ভরপুর, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
ঘণ্টাব্যাপী চলতে থাকা কবিতা, গান আর নাটিকার মঞ্চায়ন শেষে শুরু হয় কুইজ প্রতিযোগিতা। এই পর্বে পুরুষ এবং নারীদের থেকে আলাদা আলাদাভাবে প্রতিযোগী নির্বাচন করা হয়েছে। অনেকটা ইত্যাদির আদলে প্রতিযোগী নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়েছে। প্রথমে মেয়েদের গ্রুপ থেকে চারজন প্রতিযোগী নির্বাচন করে তাঁদের মঞ্চে আসার আহ্বান জানানো হয়। তাঁদের প্রত্যেকের সামনে পাঁচটি করে বেলুন রাখা হয় এবং মুখে ফুঁ দিয়ে ফোলাতে বলা হয়। সময় ছিল দুই মিনিট। এই দুই মিনিটের মধ্যে যিনি সর্বোচ্চসংখ্যক বেলুন ফোলাতে পেরেছেন, তিনি হয়েছেন প্রথম। এভাবে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় নির্বাচন করা হয় এবং তাঁদের মধ্যে পুরস্কার বিতরণ করা হয়।
তারপর ছিল ছেলেদের জন্য কুইজ। ছেলেদের মধ্য থেকেও একই প্রক্রিয়ায় প্রতিযোগী নির্বাচন করে মঞ্চে আসার আহ্বান জানানো হয়। মঞ্চে আসার পর চার প্রতিযোগীর প্রত্যেকের সামনে চারটি করে ক্যানডি রাখা হয়। এক মিনিটের মধ্যে যিনি সর্বোচ্চসংখ্যক ক্যানডি সম্পূর্ণরূপে খেতে পেরেছেন, তিনি হয়েছেন প্রথম বিজয়ী। এভাবে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় বিজয়ী নির্ধারণ করে তাঁদের মধ্যে পুরস্কার বিতরণ করা হয়।
সবশেষে ছিল আকর্ষণীয় এবং জনপ্রিয় বিংগো খেলার আয়োজন। সবার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে বিংগো খেলায় অনেকটা প্রতিযোগিতার মনোভাব চলে আসে। এ খেলায় পুরস্কার পাওয়া প্রথম তিনজনকে প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় নির্ধারণ করে বিশেষ পুরস্কারে পুরস্কৃত করা হয়। কিন্তু কেউ পুরস্কার থেকে বঞ্চিত হননি, সবার জন্যই পুরস্কার ছিল। খেলা শেষে সবাই পুরস্কার নিয়ে খুশিমনে বাড়ি ফিরেছেন।
আনন্দ আর উল্লাসে কখন যে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে গেল আমরা কেউ টেরই পাইনি। এত লম্বা সময় ধরে অনুষ্ঠান চলার পরও বাচ্চারা কিংবা বড়রা, কাউকেই ক্লান্ত হতে দেখিনি। তার একটি কারণও ছিল। আয়োজকদের সুব্যবস্থাপনা, ভাবিদের নিপুণ রন্ধনশৈলীর ফলে সুস্বাদু খাবারের আয়োজন, কবিতা, ধাঁধা, কৌতুক, নাটক আর গানের মূর্ছনায় বিমোহিত আমরা সবাই এতটাই উৎফুল্ল ছিলাম যে আমরা ক্লান্ত হওয়ার সুযোগ পাইনি। উপস্থিত সবার সমস্বরে একটাই আবদার ছিল, ‘এমন আয়োজন আরও বেশি বেশি চাই।’ আমরা আয়োজকেরাও সবার সমবেত অবদানের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করি, ভবিষ্যতে আরও বেশি বেশি এমন পরিচ্ছন্ন এবং আনন্দময় আয়োজনে বদ্ধপরিকর।
ঈদ পুনর্মিলনী এবং বর্ষবরণ অনুষ্ঠানটি কানাজাওয়া বাঙালি পরিবারের বিশাল এক মিলনমেলায় পরিণত হয়েছিল। সময় শেষ হয়ে গেলেও কেউই যেন বিদায় নিতে চাচ্ছিল না। আর তাই তো, হলের গেট বন্ধ হয়ে গেলেও গেটের বাইরে অনেককেই আলাপে-আড্ডায় মেতে থাকতে দেখা গেছে দীর্ঘ সময়। এ যেন কেউ কাউকে যেতে দিতে চায় না, তবু যেতে হয়। চারদিক অন্ধকার ঘনিয়ে আসার আগেই মন না চাইলেও আবারও জমকালো অনুষ্ঠানের আয়োজন করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করে আমরা একে অন্যের কাছ থেকে বিদায় নিই।
*লেখক: তৌফিক আহমেদ, কানাজাওয়া, জাপান
*দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]