চুক্তিতে বিয়ে

অলঙ্করণ: মাসুক হেলাল

তৃণার সকাল থেকে ভীষণ মেজাজ খারাপ। সাড়ে চারটা বছর জীবনের ওপর দিয়ে ঝড় তো কম গেল না। তবু টিকে আছে মাথা উঁচু করে শুধু অভ্র আর তটিনির জন্য। ওরা ওর সন্তান। তৃণা একজন একা (সিঙ্গেল) মা।

আমেরিকাতে পড়াশোনা করতে এসেছিল ও। ইচ্ছা ছিল পড়াশোনা শেষ হতেই দেশে ফিরে যাবে। মা-বাবা, বন্ধুবান্ধব ছেড়ে হাজারো মাইল দূরে থাকাটা একটা শাস্তি। শিহাবের সঙ্গে পরিচয় ওই বিশ্ববিদ্যালয়েই। একই বয়সী ওরা। কাছাকাছি আসতে সময় লাগেনি। কিন্তু শিহাব সব সময় বলত, ‘তৃণা, আমি এ দেশেই থেকে যেতে চাই।’ তৃণার তাতে ঘোর আপত্তি। ও চলে যেতে চায় চেনা পরিবেশে, টংয়ের দোকানে চা আর ছোট ছোট পেঁয়াজু, সঙ্গে বন্ধুদের দিনভর আড্ডা আর সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে মায়ের কাছে ইলিশ খিচুড়ির আবদার, বৈশাখে শাড়ি-চুড়ি আর রমনা বটমূলের গান—আরও কত কত আনন্দ। ফাইনালের আগে আগে শিহাবকে তৃণা কঠিনভাবে বলে দিল, কোনোভাবেই ও শিহাবকে বিয়ে করতে পারবে না। এ দেশে ও থাকবে না। তারপর পড়াশোনায় মন দিল। শিহাবের ফোন ব্লক করে দিল। আগে দেশে গিয়ে চাকরি করে জীবন গোছাবে, তারপর বিয়ে করবে ও।

একরাতে ঝুম বৃষ্টি নামল। বৃষ্টি তৃণার ভীষণ পছন্দ। ঘুমের মধ্যেও শব্দ শুনল ও বৃষ্টির। সকালে ক্লাসে যাওয়ার জন্য বের হয়ে দেখল, শিহাব বাইরে বসা, কাকভেজা, চোখ লাল। ওকে দেখে একটু হেসে বলল, ‘তৃণা, তোকে না পাওয়ার কষ্টটা ধুয়ে ফেলতে চেয়েছি রে। পারছি না। কী করি, একটু বলে দিবি?’ এই বৃষ্টিভেজা সকাল, প্রিয়জনের করুণ চেহারা তৃণার সবকিছু ওলটপালট করে দিল। ও বলল, ‘শিহাব, তেকে ছেড়ে যাব না রে। পারব না। তুই এমন কেন করলি?’ বিয়ে করল এ দেশেই ওরা।

জীবনসংগ্রামের শুরুটা প্রচণ্ড কষ্ট হয়েছে ওদের। চাকরি পাওয়ার আগেই অভ্র আসছে ওদের জীবনে, জেনে গেল ওরা। কী কষ্ট তৃণার তখন। কিচ্ছু খেতে পারে না, সবকিছুতে গন্ধ, বকুল ফুলের গন্ধ নেওয়ার জন্য মন কেমন কেমন করে। মায়ের হাতের রান্না ভাত-ডাল খেতে ইচ্ছা করে, কিন্তু কী করবে ও। কাছে কেউ নেই। কোনোমতে ফাইনাল পরীক্ষা শেষ করতেই অভ্র এল ওদের জীবনে আর এর এক বছর পর তটিনি। সংগ্রামী তৃণা দমে গেল না। ধীরে ধীরে জীবন গুছিয়ে নিল, কাজ পেল, সংসার গোছাল। ২০টা বছর কীভাবে কেটে গেল, ও যেন নিজেই জানে না।

তারপর যখন চিন্তা করছে ছেলেমেয়ে একটু একটু করে সফলভাবে জীবন গুছিয়ে নিলেই এ পৃথিবীর কষ্টের পাট চুকিয়ে সন্তানদের জীবনের সুখ দেখে ছোট্ট জীবন শান্তিময়ভাবেই শেষ করবে, তখনই দেখল বদলে গেছে শিহাব। ওর জীবনে তৃণার ভালোবাসার প্রয়োজন ফুরিয়েছে। দুই সন্তানের হাত ধরে কিছু কাপড় নিয়ে যেদিন অনেক প্রিয় ভালোবাসাময় ঘর ছেড়েছিল তৃণা, সেদিনই ওর মনে হয়েছে, জীবনে সব আনন্দ এক নিমেষে মুছে গেছে। আনন্দ ওর জীবনে আর কোনো দিন আসবে না।

ধীরে ধীরে সময় পার হয়েছে সাড়ে চার বছর। দুঃখের দিনগুলো মনে হয়ে পেছনে ফেলে এসেছে ও, সৃষ্টিকর্তা সব দুঃখের স্মৃতি মুছে দিচ্ছেন, বাচ্চাদের ছোটখাটো অর্জনে তৃণা দেখল, জীবনে আবার আনন্দ ফিরে আসছে। ভালো লাগছে সবকিছু। কোনো দুঃখই বোধ হয় চিরস্থায়ী হয় না। এমন সময় আশপাশের বহু মানুষ তৃণা অনেক বোঝাল নতুনভাবে সঙ্গী হিসেবে কাউকে বেছে নিতে, জীবনে সঙ্গীর প্রয়োজনীয়তা আছে। তৃণা কঠিনভাবেই না করল সবাইকে। সন্তানদের নিয়ে ওর জীবন পরিপূর্ণ আবার।

লেখক

অভ্র ইদানীং একটু-আধটু ঝামেলা শুরু করেছে, সারা জীবনের শান্ত বাচ্চা এখন ফ্রি ওয়েতে মোটরসাইকেল চালাবে বলে বায়না ধরেছে। কত কত অ্যাকসিডেন্ট হয় এসবে, তৃণা অনেক বোঝাতে চেষ্টা করছে ওকে; কিন্তু অভ্রর এক কথা, ‘মা তুমি এগুলো বুঝবে না। আমি এখন বড় হয়েছি। আমাকে আমার মতো চিন্তা করতে দাও। তুমি তোমার কথা চিন্তা করা শুরু করো।’ তৃণা বলল, ‘বাবা তোমার আর তটিনির জন্য আমার সারা জীবন চিন্তা করতে হবে। কারণ, মায়ের সন্তানের জন্য ভালোবাসা এবং ভালো চাওয়া কোনো দিন শেষ হয়ে যায় না।’ অভ্র তর্ক করেই চলেছে। চিরকালের শান্ত তৃণা মাথা ঠান্ডা রাখতে পারছে না আর যেন। বকা দিলেও অভ্র কিছুতেই ভালোভাবে নিচ্ছে না।

তৃণা রাগ করে নিজের রুমে চলে এল, এত তর্ক ভালো লাগছে না ওর। ওই মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল কন্ট্রাক্ট ম্যারেজের (চুক্তিতে বিয়ে)। মানে শুভ্র, যে কিনা অনেক দিন ধরে ওর পেছনে পেছনে ঘুরছে ওকে বলবে, ‘আমি শুধু এক বছরের জন্য তোমাকে বিয়ে করব। বাচ্চাদের কাছ থেকে এক বছর দূরে থাকলে বুঝবে মা কাছে না থাকার কত বিড়ম্বনা।’ এক বছর ঢাকাতেই থাকবে ও। বাচ্চারা যখন হাড়ে হাড়ে বুঝবে মায়ের প্রয়োজনীয়তা, তখনই ফিরে আসবে ও। বিয়েটা হবে এক বছরের জন্য।

পরদিন শুভ্র ফোন করে বলল, ‘কেমন আছো আমার স্বপ্নে দেখা…তার আগেই তৃণা হড়বড় করে বলল বিয়ে করবেন, শুধু এক বছরের জন্য?’ সব শুনে শুভ্র বলল, ‘ভিক্ষার চাল কাড়া-আকাড়া তৃণা, আমি এই বিয়েতে রাজি। তোমার যদি মন বসে যায় এই সংসারে, তাহলে ক্ষতি কী বলো? আর এক বছর পর তুমি চলে যেতে চাইলেও আমি আটকাব না। শুধু জানি, খুব শান্তিময় একটা বছর আমার কাটবে। যেকোনো শর্তেই তোমাকে আমি চাই।’

তৃণা বিয়ে করে চলে এল ঢাকাতে। শুভ্র মানুষ হিসেবে ভীষণ কেয়ারিং, কিন্তু বাচ্চাদের নিয়ে সেই প্রিয় প্রিমিয়াম সুইটসে গিয়ে চটপটি বা কাচ্চি খাওয়ার মতো আনন্দ কোথায় হারিয়ে গেছে। তৃণা কিছুতেই মন বসাতে পারছে না। কোথায় অভ্র আর তটিনি? কোথায় সেই আনন্দমুখর ছুটির দিন? বুকে কী কষ্ট জমাট বেঁধে আছে।

এমন সময় অভ্রর গলা শুনল ও। ‘আম্মু, ওঠো আম্মু। তুমি রাগ করে না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছ আম্মু। আমি হাংরি মা। কি খাব আজকে আমরা?’ কাঁচা ঘুম থেকে জেগে উঠে এত আনন্দ বোধ হয় আর জীবনে কোনো দিন লাগেনি তৃণার। তারপর কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ শব্দটা চিন্তা করে ও খুব হাসল। অভ্র অবাক হয়ে বলল, ‘মা, এত হাসছ কেন? আমার কথা তো তোমার সঙ্গে শেষ হয়নি।’ তৃণা বলল, ‘আগে কিছু খাই চল আব্বু। খেতে খেতে কথা বলি? মা-ও তো খুব হাংরি।’