কানাডার চাকরিবৃত্তান্ত: ষষ্ঠ পর্ব

কেপ ব্রেটন ইউনিভার্সিটি
ছবি: সংগৃহীত

লাইব্রেরির সহকারী পদে ইন্টারভিউয়ের শুরুটাও অনেকটা একইভাবে হল পরিচিতি পর্ব দিয়ে। কোনো কোর্সে আছি, এই সেমিস্টারে কয়টা কোর্স আছে, লাইব্রেরিতে এত দিনের অভিজ্ঞতা কেমন?

এসব প্রশ্ন শেষ করে অ্যাসিস্ট্যান্ট পদের মূল প্রশ্নের দিকে চলে গেলেন তাঁরা। তাঁদের মধ্যে দুজনের মুখ পরিচিত। রিসেপশন ডেস্কে যখন বিভিন্ন প্রয়োজনে এসেছি, সাহায্য করেছেন। আমাকে পদসংক্রান্ত বিভিন্ন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলেন—

কীভাবে প্রতিদিনের কাজ করব? এটা চাকরির পোস্টে বিস্তারিত দেওয়া ছিল। ওটা পড়া থাকায় বলতে কোনো অসুবিধা হয়নি!

আমাকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ সক্রিয় থাকতে হবে, এ ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা কেমন? বিভিন্ন আপডেট দিতে হবে নিয়মিত, সে ক্ষেত্রে সফটওয়্যারের ধারণা কেমন?
আমি কখনো ব্যবহার করিনি এটা সরাসরি না বলে এখন পর্যন্ত যা ব্যবহার করে এসেছি, ওইসবের ব্যাপারে তাঁদের জানালাম। যেমন ফিলমোরা যেটা ভিডিও এডিট করার কাজে, এডোবি লাইটরুম এখন জানলেও প্রথমে সাধারণ পেইন্ট সফটওয়্যার দিয়েই কাজ শুরু করেছিলাম। এ ছাড়া পিসকার্টও ব্যবহার করতে শিখেছি। কিন্তু পোস্টে নোভির কথা বিশেষভাবে উল্লেখ ছিল। এত কম সময়ের মধ্যে এটা করায়ত্ত করা কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। তাই তাঁদের বানিয়ে বলা বা মুগ্ধ করার কোনো প্রচেষ্টাই আমার ছিল না! এখানেই মূল সমস্যার সূত্রপাত হয়।

ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্ট ইউনিয়ন বিল্ডিং
ছবি: সংগৃহীত

তিনজন সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীর মধ্যে এক আফ্রিকান মেয়ে ছিল যাকে ‘কৃষ্ণকলি’ নাম দিয়েছি, ও বুঝতে পেরেছিল যে আমার নোভি সম্পর্কে ধারণা নেই। তাই আমি যতই অন্যান্য সফটওয়্যারের কাজের কথা বলি না কেন, ও ঘুরেফিরে বারবার আমাকে নোভি সম্পর্কে প্রশ্ন করতে লাগল! যেটা আমার কাছে  খুবই অস্বস্তিকর ছিল। যদি কেউ কোনো কাজ না পারে, সেটাতে দোষের কিছু থাকার কথা নয়, বরং পরবর্তী সময়ে সে কাজ প্রশিক্ষণের সময় শিখে নেওয়া যেত। আমি সরল স্বীকারোক্তি দেওয়া সত্ত্বেও কেন আমাকে বারবার ঘুরেফিরে একই প্রশ্ন করা হলো, সেটার উত্তর আজও অজানা! কিন্তু এ ক্ষেত্রে কৃষ্ণকন্যার অযাচিত প্রশ্নবাণে জর্জরিত হয়ে আর প্রশ্নের প্যাঁচের ফাঁদে পড়ে এক বিচিত্র অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হলাম। বাকি দুজনের সঙ্গে কথা বলে যতটা ভালো লেগেছিল, পরের জনের কথাবার্তায় তা অনেকটাই ম্লান হলো।

আরও কিছু প্রশ্ন করা হয়েছিল, যা পদসংক্রান্ত আর এর আগের পর্বগুলোতে একই প্রশ্নের উল্লেখ করেছি।

পূর্বেই ইঙ্গিত দিয়েছিলাম, যাঁরা নোভির কাজ জানেন, তাঁরা স্বভাবতই চাকরি পাওয়ার দৌড়ে আমার চেয়ে এগিয়ে গেছেন, সেটা লাইব্রেরির ইন্টারভিউ শেষে রুমের দরজা দিয়ে বের হওয়ার সময় ভাবছিলাম। তখনই সিদ্ধান্ত নিলাম রাতেই আবার অন্যান্য জবের পোস্টিং দেখে আবেদন করতে হবে।

সে সময়ের অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ‘অমানুষ’ মুভির বিখ্যাত গানের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল, ‘কী আশায় বাঁধি খেলাঘর, বেদনার বালুচরে। নিয়তি আমার ভাগ্য লয়ে যে নিশিদিন খেলা করে!!’ পর্দায় মহানায়ক উত্তম কুমার আর কণ্ঠে সব সময়ের কিশোর কুমার।

এ ক্ষেত্রে একটা মজার ঘটনা বলি

সুন্দরবনের নদীর ওপর বয়ে চলা বোটের ওপর এর দৃশ্যায়নও এককথায় সেরা! শুটিংয়ের সময় এক দিন বোটে যান্ত্রিক সমস্যা দেখা দেয়। আর এদিকে সন্ধ্যা হয়ে এলে পুরো ইউনিটকে ওখানকার একদিকের পাড়ে নৌকা ভেড়াতে হয়। তখন পাড়ের মানুষ কোনোভাবে জানতে পারে যে এই বোটে স্বয়ং মহানায়ক আছেন! শুটিং ইউনিটের কেউ হয়তো বলে দিয়েছিল ব্যাপারটা। এর সূত্র ধরে সন্ধ্যায় পুরো গ্রামের অসংখ্য মানুষ বাতি বা ল্যাম্প যা-ই ধরে নিই, এসে হাজির। সবার জন্য মুড়িমুড়কি, গুড়, চা, যে যা পারে। খাওয়াদাওয়া হয়ে যাওয়ার পর সবার বিশেষ অনুরোধে বোটের ডেকের ওপর উত্তম কুমার এসে সবাইকে দেখা দেন। শুটিংয়ের লাইটের আলোতে মহানায়ককে দেখে সবাই উচ্চস্বরে বলতে শুরু করে, ‘গুরু, গুরু!!’ সে এক অভূতপূর্ব ঘটনা। সবার হাতে হাতে আলো, চারিদিকে আলোকিত! মনে হয়েছিল পুরো গ্রাম পাড়ে এসে উপস্থিত।

পতাকা দালান
ছবি: সংগৃহীত

ফিরে আসি চাকরি-বাকরির বাজারে। হ্যাঁ, আসলেই এটা একটা বাজার, যেখানে আপনি নিজের দোকান খুলে বসেছেন। কোনো পণ্যসামগ্রী বিক্রির উদ্দেশ্যে নয়, নিজেকে যতটা পারা যায় আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপনের জন্য!

যত চিত্তাকর্ষকভাবে নিজের দোষ লুকিয়ে গুণের পসরা সাজিয়ে ক্রেতা (নিয়োগকর্তাকে) বোকা বানাতে পারবেন মানে ভালো কথায় নিজের গুণ তুলে ধরতে সমর্থ হবেন, ধরে নেবেন আপনার কেল্লা ফতে!!

ওয়ালমার্টের বেতন নিয়ে ওঠানামা সব সময়ই চলতে থাকল। এক ক্রিস্টমাসের মাসসহ (এ সময় সবচেয়ে বেশি বিকিকিনি হয়) পুরো বছরের মধ্যে বিশেষ বিশেষ সময়ে যখন কোনো উপলক্ষ থাকে, বেতনের টাকা বাড়বে। আর বাকি সময়ে, এমনকি গ্রীষ্মের ছুটিতেও কাজের ঘণ্টার হিসেবে কোনো হেরফের হয়নি। এত দিনের কাজের অভিজ্ঞতা তা-ই বলে। তবে ম্যানেজারের পছন্দের কর্মীরা বেশ স্বচ্ছন্দেই সময় কাটায়। সারা বছরই তাদের বেতনের হিসাবও ঠিক থাকে, আবার সময়মতো তারা হকের ছুটিও পেয়ে যায়! হেলেনের পর গ্রীষ্মের ছুটির সময় আমি প্রফেসর ক্যারেনের সঙ্গে কাজ করি। তাঁর অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে। ল্যাবের এসাইনমেন্টের সংশোধনের কাজ করেছি। তবে সবচেয়ে মজার অভিজ্ঞতা ছিল পরীক্ষার হলে সুপারিন্টেনডেন্টের ভূমিকায় কাজ করে। দেখা গেল আমার ক্লাসমেটরা পরীক্ষা দিচ্ছে আর আমি তাদের দেখাদেখি করতে বারণ করছি! আমি কোর্সটা আগেই হেলেনের কাছে করেছিলাম। এসব ডিউটি করার জন্যও উপরি বেতন দেওয়া হতো! ওয়ালমার্টের চাকরির পাশাপাশি প্রফেসরের সঙ্গে কাজ না করলে খরচাপাতি নিয়ে সত্যিই টানাটানি যেত।

বিভিন্ন পদে আবেদনের পর ই–মেইলে সাক্ষাৎকারের ডাক পেলাম ইন্টারন্যাশনাল অফিসে। মনে পড়ে গত পর্বের ডানিয়েলের কথা? স্টাডি পারমিটের সমস্যা নিয়ে ইউনিভার্সিটির প্রথমদিন কাটিয়েছি ওই অফিসে। সেই জায়গায় কাজ করতে পারলে নিজেকে সত্যিকারের সৌভাগ্যবান মনে হবে নিঃসন্দেহে! অন্যান্য সব ইন্টারভিউয়ের চেয়ে এটার পার্থক্য ছিল এক জায়গায়-আমি ড্যানিয়েলের সঙ্গে দেখা করি। ওকে জানাই সাক্ষাৎকারের ব্যাপারে। তিন বছর ইন্টারন্যাশনাল অফিসে কাজের সুবাদে আগেরকার ইন্টারভিউ দেখার অভিজ্ঞতা নিশ্চয়ই আছে ড্যানিয়েলের। এটা ভেবেই ধারণা নিতে ওর অফিসে হাজির হই।

লাইব্রেরির ওপরের তলার একাংশ
ছবি: সংগৃহীত

সে অবশ্য পদের বিবরণী মনোযোগ দিয়ে পড়তে বলল আর কিছু ধারণা দিল না তা বলব না। তবে ওর মতে পদের বর্ণনা ভালোভাবে পড়লেই এর মধ্যে লুকিয়ে আছে সব মুশকিলের আসান।

ইন্টারভিউয়ের দিন ভুল করে চলে গেলাম অন্য আরেক রুমে। পরে বুঝতে পেরে ফিরে এলাম অফিসে। তখন দেখি তাঁরা আমাকে খুঁজছেন! পরে কেলি আমাকে সঠিক রুমে নিয়ে গেল। তিনি ড্যানিয়েলের সহধর্মিণী, এই অফিসে নতুন জয়েন করেছেন।

ইন্টারভিউয়ের রুমে দেখা হলো ম্যানেজারের সঙ্গে ভিক্টর।

পরিচিতি পর্ব শেষে প্রথম প্রশ্ন হলো তোমার পজিশনের প্রতিদিনের কাজকর্মের একটা ধারণা দাও।

অফিসে অনেক ধরনের মানুষের সঙ্গে তোমাকে কথাবার্তা বলতে হবে। কোনো ছাত্রছাত্রী যদি রাগান্বিত হয়, সে ক্ষেত্রে তাকে কীভাবে সামাল দেবে?

অফিসে ইমিগ্রেশন পরামর্শকদের অনুপস্থিতিতে কী করবে?

কোনো ছাত্রছাত্রীর যদি জরুরি পরিসেবার প্রয়োজন হয়, কী করতে হবে?

ধরো, পরামর্শকদের কারও সাক্ষাৎকারের সময় পাওয়া যাচ্ছে না, তখন ছাত্রছাত্রীদের কী বলে বোঝাবে? বা কীভাবে ব্যবস্থা করবে?

ইমিগ্রেশনের কাজকর্ম খুব সাবধানে করতে হয়, কখনো যদি কোনো জায়গায় অসাবধানবশত ভুল হয়ে যায়, কী করবে?

উত্তর দেওয়ার ক্ষেত্রে চাকরির বিবরণী আর ডানিয়েলের বিভিন্ন সূক্ষ্ম ইঙ্গিত কাজে দিয়েছিল। যখন শেষ করে বের হয়ে আসছিলাম, মনে হয়েছিল ভিক্টর বেশ সন্তুষ্ট। তবে বলা বাহুল্য অনেক ম্যানেজারেরই মুখাবয়ব এমন ছিল, ফল হয়েছিল বিপরীত।

কাজেই ‘ফলেন পরিচয়তে’! (ক্রমশ)