অন্টারিও বাংলাদেশ কমিউনিটির বসন্ত মেলা

আঁকাআঁকিতে ব্যস্ত একটি শিশু
ছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশে মেলা যেমন একটি উৎসব বা পার্বণিক উদ্যোগ, যা সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের জন্য একটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বন্ধন সৃষ্টি করে, ঠিক তেমনি প্রবাসেও একই ভূমিকা পালন করে। তবে প্রবাসে এর ভিন্ন একটি মাত্রা আছে। বাইরের সংস্কৃতির ভিড়ে যেখানে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতিগুলো গুরুত্বহীন হয়ে যায়, সেখানেই বৈশাখী, পিঠা বা বসন্ত মেলাগুলো হয়ে উঠে বাঙালির সংস্কৃতিগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার অনন্য প্রয়াস। এ সবের মাধ্যমে প্রবাসে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যেও নিজস্ব সংস্কৃতিগুলোকে বহমান রাখার প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকে। যেমন ছোটদের বাংলায় ছড়া আবৃত্তি, যেমন খুশি তেমন সাজ ও বাংলাদেশের ইতিহাস–ঐতিহ্য নিয়ে ছবি আঁকাসহ বিভিন্ন আয়োজনের মধ্য দিয়ে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মগুলো অনুপ্রেরণা পেয়ে থাকে।

যেমন খুশি তেমন সাজোতে একটি শিশু
ছবি: সংগৃহীত

সম্প্রতি তেমনই একটি মেলা হয়ে গেল আমাদের বাংলাদেশ কমিউনিটি, লন্ডন, অন্টারিও–এর উদ্যোগে। কমিউনিটির লোকজনের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ, শিশুদের জন্য ছড়া আবৃত্তি, আঁকা, যেমন খুশি তেমন সাজ আয়োজনে বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও আবহমান গ্রাম বাংলার নানাবিধ মনোমুগ্ধকর চিত্র ফুটে ওঠে।

বাংলাদেশিদের কোনো অনুষ্ঠানে বাঙালি খাবার থাকাটা অপরিহার্য। ভাপা পিঠা, চিতই পিঠা, পাটি সাপটা, ফুসকা, ঝালমুড়ি, বিরিয়ানি, নানা পদের মিষ্টি থেকে পান-সুপারির দোকানগুলো ছিল দর্শকদের আকর্ষণীয় খাদ্য তালিকায়। মেলায় অংশ নেওয়া বিভিন্ন দোকানগুলোর মধ্যে সালমার দেশি কিচেন, টেস্ট অব সিলেট, বুকস আর আস, বিসমিল্লাহ বাজার, মসলিন ট্রেডিশন শাড়ি, কুটুর মুটুর ও হেনা আর্ট অ্যান্ড পেইন্টিং ছিল অন্যতম।

মেলায় কথা হয় ‘বুকস আর আস’ দোকানে দাঁড়িয়ে থাকা শিশু নাশিতার সঙ্গে। নাশিতা দাঁড়িয়ে আছে বইয়ের পসরা সাজিয়ে। ছোট নাশিতা এখন পর্যন্ত যেসব বই পড়েছে, সেসব বই নিয়ে এসেছে নামমাত্র মূল্যে মেলায় বিক্রির জন্য। আর যে টাকা পাওয়া যাবে, তা দান করে দিবে দাতব্য সংস্থায়। তার বইয়ের সংগ্রহ দেখে বোঝা যায়, বইপোকা নাশিতা।

বক্তব্য দেন শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক আলীর সহধর্মিণী সুরাইয়া ওয়াহিদ আলী
ছবি: সংগৃহীত

মেলার সামাজিকতার গুরুত্বটা বেশি টানে বাচ্চাদের। কারণ, একসঙ্গে অনেকগুলো খেলার সঙ্গী খুঁজে পায় আর যারা শহরে নতুন আসে তাদের। কারণ, বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে মিশতে পারে, একে অপরের সঙ্গে বন্ধুত্ব তৈরি হয়, যা অন্য রকম ভালো লাগা কাজ করে। এসব আমাদের সামাজিক জীবনে একাকিত্ব দূর করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

আমাদের এ আয়োজনের শেষ দিকে এসে সম্মাননা জানানো হয় শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক মীর মাসউদ আলীকে, যিনি একজন প্রখ্যাত পরিসংখ্যানবিদ ও শিক্ষাবিদ ছিলেন। তাঁর পক্ষে সম্মাননা গ্রহণ করেন সহধর্মিণী সুরাইয়া ওয়াহিদ আলী। অধ্যাপক ড. আলী বাংলাদেশের পটুয়াখালী জেলায় জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৬১ সালে টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি সম্পন্ন করেন। এরপর ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটিতে গণিত বিভাগে অনুষদ সদস্য হিসেবে যোগদান করেন। তিনি ১৯৬৬ সালে পূর্ণ অধ্যাপক পদ লাভ করেন। ড. আলী ওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটিতে পরিসংখ্যানে স্নাতক ও স্নাতক প্রোগ্রাম তৈরি করেন এবং পরিসংখ্যান ও অ্যাকচুয়ারিয়াল সায়েন্স বিভাগ তৈরিতে অবদান রাখেন। ৩৩ বছরের চাকরির পর তিনি প্রফেসর ইমিরেটাস থেকে অবসর গ্রহণ করেন। পরে ২০০৯ সালে নিউমোনিয়ার সঙ্গে দীর্ঘ যুদ্ধের পর ৮০ বছর বয়সে মারা যান। তিনি একাধারে শিক্ষাবিদ, একই সঙ্গে সমাজসেবক ছিলেন। তিনি লন্ডন মুসলিম মসজিদের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন ছিলেন, যা অন্টারিওতে প্রথম ও কানাডার দ্বিতীয় মসজিদ হিসেবে স্বীকৃত। তিনি কাঠামোর প্রকৌশল নকশা সমন্বয়, বিভিন্ন উৎস (স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক) থেকে তহবিল সংগ্রহের পাশাপাশি মসজিদ নির্মাণের জন্য অন্যদের সহায়তায় কর্মী-বাহিনীর ব্যবস্থা করার ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখেন। জাতিধর্ম–নির্বিশেষে সমাজের মানুষকে বিভিন্নভাবে সাহায্য করেন। তিনি সর্বদা তাঁর কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে মূলত বাংলাদেশকেই প্রতিনিধিত্ব করেছেন।

‘বুকস আর আস’ দোকানে নাশিতা
ছবি: সংগৃহীত

এই মেলায় মীর মাসউদ আলীকে সম্মাননা দেওয়ার আরও প্রাসঙ্গিক কারণ আছে। তিনি লন্ডন, অন্টারিও বাংলাদেশি প্রবাসী প্রারম্ভিকদের মধ্যে অন্যতম, যেটি শুরু হয় ১৯৬০ সাল থেকে। এক–দুজন করে আসতে আসতে যা এখন প্রায় হাজারের বেশি বাংলাদেশি মানুষেও ভালো লাগা, ভালোবাসার শহরে পরিণত হয়েছে। তাঁর জীবদ্দশায় তিনি তৎকালীন সম্প্রদায়ের সক্রিয় সদস্য ছিলেন। তিনি সর্বদা সাহায্যকারী ছিলেন। লন্ডনে বাংলাদেশি বসতি স্থাপনের জন্য অনেককে তাঁদের যাত্রাপথের দিকনির্দেশনা দিয়েছেন।

অনেক ব্যস্ততার মধ্যেও কমিউনিটির কিছু মানুষ থাকেন সব সময়, সব জায়গায়, যাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রমের বিনিময়ে এমন অনুষ্ঠানগুলো আয়োজন করা সম্ভব হয়। তাঁদের মধ্যে অন্যতম সালমা তালুকদার। সালমা তালুকদার অন্যান্য আয়োজকবৃন্দসহ, বেশ কিছু তরুণ উদ্যমী স্বেচ্ছাসেবকের একান্ত প্রচেষ্টায় বসন্ত মেলা ১৪২৯ সফলভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব হয়েছে।

একটি শিশুর চিত্রাঙ্কন
ছবি: সংগৃহীত

তাই বলতে হয়, প্রবাসের এই মেলা শুধুই একটি মেলা নয়। সম্মাননা দেওয়ার মাধ্যমে যেমন গুরুত্বপূর্ণ বাংলাদেশি ব্যক্তিদের, তেমনই নতুন প্রজন্মের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়, অন্যদের সমাজসেবামূলক কাজের অনুপ্রেরণা দেওয়া হয়। একই সঙ্গে বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতিকে ধারণ ও বহন করা হয়।


লেখক: নূর আলম, পোস্টডক্টরাল রিসার্চ ফেলো, ইউনিভার্সিটি অব নিউব্রানসউইক, কানাডা

যেমন খুশি তেমন সাজোতে অংশগ্রহণকারী
ছবি: সংগৃহীত