মাস্ক ছাড়া প্রথম দিন

ফাইল ছবি

২০২০ প্রথম দিকে মাস্ক ব্যবহার শুরু করি। কারণ হিসেবে নিজে তো বটেই, অন্যদেরও করোনা থেকে রক্ষা করা। মাস্ক ব্যবহারের শুরুর দিকে কত যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছে। ফিতার টানে কান লাল হয়ে গেছে, কান কেটে যাওয়া যাওয়া ভাব হয়েছে, মুখ চেপে ধরেছে, কথা বলায় বিঘ্ন ঘটেছে, আকস্মিক হাঁচিতে স্বস্তি হয়নি, কাজের সময় মাস্ক ওপরে উঠে চোখ ঢেকে গেছে অথবা নিচে নেমে নাক বেরিয়ে গেছে, মাস্কের ববলিন উঠে মুখ চুলকানির ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে ইত্যাদি।

যেহেতু দক্ষিণ আফ্রিকায় থাকি, তাই নানা আতঙ্কে থাকতে হয়। দোকানে কখন যে চোর–ডাকাত হাজিরা দেয়, তা নিয়ে ভাবনার অন্ত নেই। এর মধ্যে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। মাস্ক ব্যবহারের সুযোগ নিয়ে মুখ ঢেকে যে কেউ আসতেই পারে দোকানে। কী আর করা, এভাবেই চলতে হয়েছে। এমন চলতে চলতে অভ্যাসের দাস হয়ে গেলাম। কারণ, মানুষ তো অভ্যাসেরই দাস।

আস্তে আস্তে মাস্ক একটা স্বাভাবিক পোশাকে রূপান্তরিত হলো। দুই থেকে আড়াই বছর ধরে পরিচিত বা অপরিচিত সবার মুখে মাস্ক ব্যবহার দেখতে দেখতে সহনীয় হয়ে গেল।

কিন্তু গত সপ্তাহে ঘোষণা এল, মাস্ক ব্যবহার আর বাধ্যতামূলক নয়। মানুষ যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। শুরু হলো উন্মুক্ত মুখের ব্যবহার। অনেকের চেহারা পাল্টে গেল। মাস্ক ব্যবহার অবস্থায় মানুষের চেহারার সঙ্গে যেভাবে পরিচিত হয়েছিলাম, সেই পরিচিত মুখ একেবারে বদলে গেল। সুতরাং, অনেককেই চিনতে কষ্ট হচ্ছে।

আমার নিজের মুখের গঠনও হয়তো কিছুটা বদলে গেছে। কোনো কোনো কাস্টমার আমাকে খোঁজ করে। আমার কাছেই জিজ্ঞাসা করে, ‘আরেক ভাই ছিল এখানে, তিনি কোথায়?’ আরেক ভাই বলতে আমাকে বুঝিয়েছেন।

করোনা শুরু থেকে আজ পর্যন্ত সকাল ৬টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত মুখে মাস্ক রাখতে বাধ্য হয়েছি। অবশ্য মাঝে খাবারের জন্য আধা ঘণ্টার ছুটি আছে, তখন মাস্ক খোলার সুযোগ ছিল। লম্বা সময়ে মাস্ক ব্যবহারে ব্যবহারকৃত স্থানে একটু ফ্যাকাশে ভাব লক্ষ করেছি। নাকটা বেশ চ্যাপটা হয়েছে, ঠোঁট উঁচু মনে হচ্ছে, দুই কানে ফিতায় কালো দাগ পড়েছে।

আমার ক্ষেত্রে না হলেও কিছু লোককে দেখছি, সামনের একটি বা দুটি দাঁত নেই, আগে এমন ছিল না। এদেশে অনেকে কারণে–অকারণে দুই–একটা দাঁত তুলে ফোকলা হাসি দিয়ে আনন্দ পায়। তারা অবশ্য দাঁতের মর্যাদা অনেকে দেয় না। কাজে কাজেই বিনা কারণে সুস্থ–সবল দাঁতগুলো তুলতে বিন্দুমাত্র পিলে চমকে ওঠে না।

অনেক দিন পর যখন মাস্ক ছাড়া ডিউটিতে এলাম, তখন যেন কেমন-কেমন লাগছিল। যদিও নিজের মুখ নিজে দেখতে পাচ্ছিলাম না, তবে যেন কী নেই মনে হচ্ছিল। হৃদয়ে সেটা অনুভূত হচ্ছিল।

দক্ষিণ আফ্রিকায় গত সপ্তাহে মাস্ক ব্যবহারের বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করে নেওয়া হলেও আমি অতি সাবধানী মানুষ হওয়ায় মাস্ক ব্যবহার করে যাচ্ছিলাম। আমার মাস্ক আমি ব্যবহার করব, আমার মাস্ক আমার নাক-মুখ ঢেকে রাখবে, তা দেখে অনেকের গা গরম হতে থাকে। দোকানে যত কাস্টমার আসে, তার অর্ধেকের কাছেই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে।

প্রশ্ন আর কটাক্ষের ঝালাপালাতে যখন অতিষ্ঠ, তখন এত দিন যত্নে রাখা মাস্ক ফেলে দিলাম ডাস্টবিনে। কারণ, কাউকে বোঝাতে পারিনি যে মাস্ক শুধু করোনার কারণেই ব্যবহার করা হয় না।

ঠিক আছে, অবশেষে তাদের দাবিই মেনে নিলাম। পরলাম না আর মাস্ক। আমার মাস্কবিহীনে তোমরা তো সুখী হও। তোমাদের সুখের মধ্যে আমার চাওয়া যেন একটু উঁকি দেয়, আর তা হলো— ধুলাবালু স্থানে এবং জনব্যস্ত এলাকায় মাস্ক হোক সঙ্গী, করোনা যেন আর কোনো দিন শাসন না করে এই পৃথিবী।

*লেখক: মাহফুজার রহমান, কেপটাউন, দক্ষিণ আফ্রিকা