আমার ছেলেবেলার ঈদ আনন্দ

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

যেহেতু বাংলাদেশেরই কোনো এক অজপাড়াগাঁয়ে আমার জন্ম, তাই ছোটবেলার ঈদ আনন্দও হতো গ্রামবাংলার সেই সময়কার আর্থসামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে। রোজা পালনকারীদের জন্যে এই মাস মহান আল্লাহর কাছে ক্ষমা ও করুণা প্রার্থনার মাস। এ মাস শেষ হলেই বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের ঘরে ঘরে ঈদ আসে খুশির বার্তা নিয়ে। বয়ে নিয়ে আসে অনাবিল আনন্দের সওগাত। পরিবার–পরিজন, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব মিলে সবাই দু–এক দিনের জন্য হলেও নির্মল আনন্দে মেতে ওঠেন। আজকাল বাংলাদেশের নারী–পুরুষ, ছেলে–বুড়ো ও শিশুরা কীভাবে ঈদ উদ্‌যাপন করেন, তা সঠিক জানি না। আমাদের কালে আমরা কেমন করে ঈদের খুশিতে ফেটে পড়তাম, তা আজও মনে হলে সুখ পাই। পাই অপরিসীম আনন্দ। স্মৃতির পাতা থেকে আমাদের ছোটবেলাকার ঈদের কিছু কথা, কিছু ভাবনা, কিছু অনুভূতি ও উপলব্ধির কথা আজ আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করব।

শেষ রোজার দিন সবার সঙ্গে জামাতে মাগরিবের নামাজ পড়ার জন্য মসজিদে যেতাম। নামাজ শেষে পশ্চিম দিগন্তের দিকে তাকিয়ে অধীর আগ্রহে খুঁজতে থাকতাম ঈদের এক ফালি বাঁকা চাঁদ। এক চিলতে চিকন চাঁদ, যেন এই দেখি। এই নেই। ক্ষণিকের জন্য নজরে পড়ত। আবার মুহূর্তে মিলিয়েও যেত। আবার খুঁজে পেলে আঙুল ঘুরিয়ে চিৎকার করে অন্যদের দেখাতাম। কেউ দেখতে পেতেন। কেউ না। খুশিতে নাচতে নাচতে এক দৌড়ে চলে আসতাম বাড়িতে। ঘরে এসে আম্মাকে বলতাম, জানো মা, আজ সবার আগে আমিই চাঁদ দেখেছি। কাল ঈদ। মা হেসে হেসে বলতেন, ‘তাই নাকি? তুই যে চাঁদ দেখেছিস, কাউকে তার সাক্ষী রেখেছিস? আর চাঁদ দেখে থাকলে কাল থেকে নয়, খুশির ঈদ এখন থেকেই শুরু হয়ে গেছে।’

বাড়ির বাইরে চলত বিশাল ঈদগাহ কমিটির মিটিং। ঈদগাহের মালিকানা ও ব্যবস্থাপনা ছিল আশপাশের পাঁচ গ্রামের পাঁচ পঞ্চায়েতের যৌথ ব্যাপার। আব্বা ছিলেন এর মোতোয়ালি।

এ বিষয়ে বন্ধু মাহবুবের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে কয়েকটি প্রাসঙ্গিক কথা মনে পড়ল। আপনাদের সুবিধার জন্য সেগুলো আমি জায়গায় জায়গায় যোগ করে দিয়েছি। আমাদের ঈদের প্রস্তুতি, উৎসব দিনের বেশ আগেই শুরু হয়ে যেত। আজ যত দূর মনে পড়ে, এ তোড়জোড় আরম্ভ হতো রোজার শেষ দিকে। হাতে মেন্দি পরা দিয়ে। আমরা যখন গ্রামের বাড়িতে বড় হচ্ছি, তখন আমাদের কোনো বোন কিংবা চাচাতো বোনও ছিল না। তারা যখন দুনিয়ার আলো দেখেছে, তখন আমরা পড়ালেখার উদ্দেশে বাড়িছাড়া। মেন্দি জিনিসটি সাজগোজের বিষয় এবং একটি মেয়েলি ব্যাপার। স্বভাবতই এতে তাদেরই উৎসাহ বেশি থাকার কথা। মাঝেমধ্যে ওই সময় যখন বড় ফুফু নাইয়র আসতেন, তখন ফুফাতো বোনদের নিয়ে মেন্দি উৎসব খুব জমত।

ফুফু এবং কাজের মেয়েলোকেরা আদর করে, অতি যত্নে আমাদের হাতে মেন্দি পরিয়ে দিতেন। আমি একটু অধৈর্য ছিলাম। কতক্ষণ পরপর আঙুল দিয়ে মেন্দি পাতার ‘পেস্ট’ সরিয়ে দেখতাম—হাত লাল হচ্ছে কি না। এতে আমার হাতের মেন্দি ল্যাপটে-চ্যাপটে যেত। মেন্দির লাল কারুকার্য পরিষ্কার হয়ে হাতে ফুটে উঠত না। হাত ধোয়ার পর অন্যদের সঙ্গে যখন মিলিয়ে দেখতাম, তখন মন খারাপ লাগত। আমাদের বাড়িতে মেন্দি লাগানো যে শুধু মেয়েদের বা ছোটদের ব্যাপার ছিল, তাই নয়। আব্বা ও চাচাদেরও দেখতাম বাঁ হাতের কড়ে আঙুলের মাথায় এবং ওই হাতের তালুতে পূর্ণচন্দ্র আকারে মেন্দি পরতেন। আমাদের দুই হাতের তালুতে বেশ বিস্তৃত কারুকাজসহ মেন্দি লাগানো হতো। কখনো কখনো আমরা দুই হাতের তালুতে চ্যাপ্টা করে মেন্দির পেস্ট লাগিয়ে দিতাম। সে কাজ আমরা নিজেরাই করতে পারতাম। একে বলতাম জোড়-মেন্দি।

সবশেষে আপনাদের কাছে আমার প্রশ্ন, যেদিন বাংলাদেশের সব মানুষ প্রতিদিনই ঈদ করবে, সেদিন কি আমার ছেলেবেলার সেই ঈদ, সেই স্মৃতি, সেই আনন্দ থাকবে, নাকি উন্নয়নে হাওয়ায় হারিয়ে যাবে? কথাগুলো লিখতে গিয়ে বুঝতে পারছি আবেগে চোখ দুটো ভিজে আসছে।

এবার ফিল্মে আসি ঈদের দিনের কথায়। সন্ধ্যায় ঈদের চাঁদ দেখার সঙ্গে সঙ্গে রান্নাঘরে নানা জাতের পিঠা ও মিঠাই বানানো শুরু হয়ে যেত। আম্মা ঘুমোনোর আগেই কিছু খেয়ে নিতাম। তারপর বিছানায় চলে যেতাম ঠিকই, কিন্তু ঈদের খুশিতে আম উত্তেজনায় চোখে ঘুম আসতেই চাইত না। ফজরের আজানের আগেই উঠে যেতাম। একান্নবর্তী পরিবার। আমরা সমবয়সী ভাইয়েরা, পাশের বাড়ি এবং গ্রামের অন্য ছেলেদের সঙ্গে গোসল করতে বাড়ির সামলে পুকুরে চলে যেতাম। গোসল সেরে জামাকাপড় পরে নিতান। কাপড়গুলো আগেই ধুয়ে, শুকিয়ে, ভাঁজ করে বালিশের নিচে মাখতাম। অন্তত তিন-চার দিন আগে। তখন বাড়িতে লোহার একটি ইস্তিরি ছিল। কিন্তু ওটা ছুঁয়ে দেখা আমাদের এখতিয়ারের বাইরেই ছিল। পরিষ্কার জামাকাপড় পরে যখন ঘরে ফিরে আসতাম, তখনো চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। এখানে একটি কথা বলে রাখি, ঈদের দিন নতুন জামাকাপড় পরার কথা জানতাম, তবে আমাদের ভাগ্যে তা জুটত না। কদাচিৎ নতুন কাপড় পেলেও এমন ঈদের কথা আমার মনেই পড়ছে না। তাতে কি, এতে মোটেও মন খারাপ লাগত না। বলতে গেলে বাড়ির এবং গ্রামের সব ছেলেমেয়ের অবস্থাই ছিল তথৈবচ। একা একা যখন সেই সব ঘটনা এবং স্মৃতিতর্পণ করি তখন মনে মনে হাসি। সূর্য ওঠার আগপর্যন্ত সবাই জটলা বেঁধে বিছানায় বসে গল্পগুজব করতাম। হাসিঠাট্টায় উন্মত্ত থাকতাম।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

পুব আকাশে আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে আমরা ছেলেরা সব দল বেঁধে বাড়ির মুরব্বিদের যে যেখানে পেতাম, পা ছুঁয়ে সালাম করতাম। বাবা, চাচা, মা, চাচিদের পর সবশেষে যেতাম দাদির ঘরে। দাদি পিঠা ও মিষ্টিদ্রেব্যর ভান্ড হাতে নিয়ে। সালাম করার পর তিনি আদর করে সবার হাতে তুলে দিতেন মিষ্টিজাতীয় খাবার। খেতে খেতে নেচে নেচে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়তাম। তারপর একে একে গ্রামের এ-ঘর ও-ঘর সব বাড়ি ঘুরে বেড়াতাম। মুরব্বিদের সালাম করতাম আর বখরা পেতাম বিভিন্ন জাতের ঘরে বানানো পিঠা। দু–এক ঘরে খাওয়ার পরেই পেট ভরে যেত। শেষের দিকে সাধলেও আর খাবার হাতে নিতাম না। সালাম করে খুশি মনেই খালি হাতে চলে আসতাম। খেতে খেতে ক্রমান্বয়ে আমাদের কাছে মিটি/পিঠার প্রান্তিক উপযোগিতা কমতে কমতে যে শূন্যের নিচে নেমে আসত, সেটা বুঝেছি বড় হয়ে অনেক পরে, বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থশাস্ত্রের তত্ত্বকথা পড়তে গিয়ে। তবে কদাচিৎ কেউ একটা দুটো সিকি আধুলি হাতে তুলে দিলে মনে হতো যেন ‘সাত রাজার ধন মানিক’ পেয়ে গেছি।

গ্রাম ঘোরা হলে বাড়িতে ফিরতাম। এসে দেখতাম কাছারি ঘরের উঠোনে লাইন ধরে ফকির-মিসকিন দাঁড়িয়ে আছেন। ফেতরা নেওয়ার জন্য। তাঁরা একে একে এগিয়ে আসছেন। আব্বা বারান্দায় একটি পুরোনো কাঠের চেয়ারে বসে কাউকে সিকি, কাউকে আধুলি, আবার কারও হাতে টাকার নোট গুঁজে দিচ্ছেন। ফেতরাপ্রত্যাশীরা চলে গেলে আমি বাবার আশপাশে ঘুর ঘুর করতাম। ভাবতাম, একটা সিকি আধুলি তো আমাকেও দিতে পারেন। কিন্তু দেন না কেন? তিনি যে ফেতরার পয়সা আমাকে দিতে পারেন না, সেটা তখন জানলে তার ওপর আমার এমন রাগ-অভিমান হতো না।

তারপর সবার সঙ্গে নামাজের জন্য ঈদগাহে যেতাম। নামাজ শেষে ঈদগাহের চারদিকে দেখতে পেতাম সাদা টুপি মাথায় শুধু মানুষ আর মানুষ। ফুটছেন এলোপাতাড়ি। তার মাঝে দুটো চিত্র স্পষ্ট আনার নজরে পড়ত। কোরবানির ঈদ হলে একদল লোক দেখতে পেতাম ঘোরাঘুরি করছেন। তাঁদের গায়ে ময়লা নোংরা ছেঁড়া কাপড়। মাথায় গামছা বাঁধা। এক হাতে বাঁশের লাঠি (কাঁধে করে চামড়া বয়ে দেওয়ার জন্য)। আরেক হাতে ছালায় দড়ি। ছরু-ছোরা ইত্যাদি। আর প্রায় সব ঈদেই থাকতেন আরেক দল। তাঁরা ফেরিওয়ালা। বেলুন, হাওয়ায় মিঠাই, বাঁশের বাঁশি, লেবেনচুষ ইত্যাদি বিক্রি করতেন। নিজের পকেটে পয়সা থাকলে কিছু কিনে খেতাম। না থাকলে মন খারাপ করে বাড়ি চলে আসতাম। পয়সার জন্য মানুষের ভিড়ে আব্বাকে খোঁজার বুদ্ধি থাকলেও সাহসটি ছিল না। এই দুই দলের লোকদের ঈদের ময়দানে তখন একেবারেই বেমানান লাগলেও, অনেক পথে এলে বুঝেছি, তাঁরাও ঈদ আনন্দের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ধর্মীয় অনুশাসনের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য একীভূত হওয়াতে ইসলাম ধর্ম আরও বাস্তবসম্মত ও জীবনঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছে।

রোজার ঈদ হলে নামাজের পরে বাড়িতে বকরি জবাই হতো আর কোরবানির ঈদ হলে সঙ্গে একটা গরুও থাকত। বাড়ির বাইরের ঘরের সামনে একদিকে চলত গোশত কাটাকাটি। আরেক দিকে চলত বিশাল ঈদগাহ কমিটির মিটিং। আমাদের ঈদগাহের মালিকানা ও ব্যবস্থাপনা ছিল আশপাশের পাঁচ গ্রামের পাঁচ পঞ্চায়েতের যৌথ ব্যাপার। আব্বা ছিলেন এর মোতোয়ালি। তাই মিটিং হতো আমাদের বাড়িতে। উপস্থিত থাকতেন পাঁচ গ্রামের সব মাতবর। নামাজের পরে ঈদগাহে যে চাঁদা তোলা হতো, তা আমাদের বাড়ির মিটিংয়ে গোনাগুনি হতো। গোনার পরে এগুলো ঈদগাহের ইমাম ও সহকারী ইমামের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হতো। আমি ততক্ষণ গোশত কাটাকাটি দেখতাম। একটু সময় মিটিং শুনতাম। ফলে কোনো কাজই ঠিকমতো হয়ে উঠত না। ঈদের মিটিংটি বড় বলে পিঠা-সন্দেশ খাওয়ানো সম্ভব হতো না। তবে পানসুপারি আর গুড়গুড়ি হুঁকোর চর্চা চলত বেহিসাব। জানতে বড় ইচ্ছা করে হুঁকো, তামাক, আর পানসুপারির চল কি এখনো থানদেশে আছে?

রান্নাবান্নার জন্য স্বাভাবিকভাবেই দুপুরের খাবারে দেরি হতো। তবে মজা করে ইচ্ছেমতো পেট ভরে গোশত দিয়ে খাওয়াটা আমি খুবই উপভোগ করতাম। এমন উপাদেয় ও পর্যাপ্ত খাবার বহুলে মাত্র দু-তিনবারই আমাদের কপালে জুটত। বিকেলবেলা পাশের গ্রামে ফুফুর বাড়ি বেড়াতে যাওয়া ছিল ঈদ উদ্‌যাপনেরই একটি অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ। সেখানে গেলে পেতাম সেমাই ও মিষ্টি পিঠা। হইহুল্লোড় করে সন্ধ্যায় ফিরে আসতাম ঘরে।

আমাদের বাড়িতে কোরবানির ঈদের দুটো বিশেষত্ব ছিল। প্রথমটি হলো, যাদের নামে পশু কোরবানি করা হতো, তারা কোরবানির গোশত রান্না হওয়ার আগে অন্য কিছু খেতেন না। দ্বিতীয়টি হলো, আমার দাদি কোরবানির গোশত প্রায় এক মাস ধরে সংরক্ষণ করতে পারতেন। সে যুগে রেফ্রিজারেশনের কথা তো গ্রামদেশে কল্পনারও বাইরে ছিল। দাদি আরেকটি কাজ করতেন। ওই গোশত দিয়ে একেক দিন একেক পরিবার করে আমাদের গ্রামের সবাইকে দুপুরবেলা ভাত খাওয়াতেন এবং ওই জিয়াফত সিরিজ চলত তিন–চার সপ্তাহ ধরে।

কি রোজা, কি কোরবানি ঈদ, এশার নামাজের পর আমাদের বাড়িতে শুরু হতো ওই দিনে সবশেষ ও আসল উৎসব। গ্রামের সবাই যার যার ঘরে ঈদের জন্য যা রান্না হতো, তার একটি বড় অংশ নিয়ে আসতেন আমাদের কাছারি ঘরের সামনের উঠোনে। কেউ আনতেন পোলাও গরু গোশত। কেউ রাঁধতেন খিচুড়ি। কেউবা দিতেন সাদা ভাত আর তার সঙ্গে খাসি অথবা মুরগির গোশতের ঝোল। ছোট বড়, ছেলেমেয়ে, জোয়ান-বুড়ো সবার মিলনমেলা ফলত আমাদের বাড়ির আঙিনায়। ছোট ছোট হারিকেন জ্বালিয়ে আলো-আঁধারির মাঝে আম্মা সবাই একসঙ্গে ভাগযোগ করে খাবারগুলো খেতাম। কোনো কোনো সময়ে অন্ধকারের মধ্যে খাবার পাতে যে পোকামাকড় পড়ত না, তা–ও নয়। আর পড়লেই–বা কী, এত কিছু দেখে ও বেছে খাওয়ার কি সময় ছিল আমাদের? খাওয়া শেষ হলে পুকুরে গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে আসতাম। আজকাল দেশে–বিদেশে নামীদামি হোটেল, মোটেল ও কমিউনিটি সেন্টারে কত শৌখিন পার্টি হয়, খাওয়াদাওয়া হয়, কিন্তু ছোটবেলাকার সেই আনন্দ কোথাও খুঁজে পাই না।

সারা দিন হইচই করার পর ক্লান্ত হয়ে পড়তাম। তবু শুতে যেতে চাইতাম না। মনে হতো ঘুমোতে গেলেই তো আনন্দ হাতছাড়া হয়ে যাবে। অবশেষে আব্বার বকাবকিতে বিহালায় যেতে হতো। অবসন্ন শরীর নিয়ে বিছানায় শুলেই ঘুমিয়ে পড়তাম। ক্লান্তিতে আরামে লম্বা ঘুম ঘুমোতাম। মাঝে মাঝে ঘুমের মধ্যে আগামী ঈদের স্বপ্ন দেখতাম। ঈদ যেমন আনন্দময় তেমনি তার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করাটাও কোনো অংশে কম আনন্দের ছিল না।

প্রবাসজীবনে বউ-ছেলেমেয়ে নিয়ে আজও ঈদ করি। আজও আনন্দ পাই। এখনো দিনগুলো—আবার কবে আসবে রোজা। কবে আসবে ঈদ। খুশির ঈদ। তবে সেদিনের সঙ্গে আজকে একটা পার্থক্য আছে। আজকের প্রত্যাশার সঙ্গে একটা জিনিস নিশ্চিত জানি, শৈশবের সঙ্গে চিরদিনের মতো হারিয়েছি তার আনন্দ-উচ্ছ্বাস। ফিরে পাব না সেই সময়। জীবনে আর কোনো দিন ফিরে আসবে না সেই ঈদ। ফিরে পাব না সেই হাসিখুশি আর কোলাহল।

বলতে পারেন, কেন এমন অনুভূতি হয়? আমার ধারণা, আনন্দ অনুভব ও উপভোগের বেলা মানুষ বড়ই কৃপণ। নতুন প্রাপ্তি যতই হোক না কেন, পুরোনোগুলোকে সে ভুলতে চায় না। ছাড়তে চায় না। আর চাইলে কি পারে?

বাংলাদেশের পরিস্থিতি এখন যেদিকে গড়াচ্ছে, তাতে মনে হয় যেদিন ছেলেবেলার মধুর মধুর স্মৃতিকথা বিসর্জন দিতে হবে, সেদিন বুঝি আর বেশি দূরে নয়। কেন বলছি, শুনুন। আমার এক পাঠক বন্ধু এ লেখায় আগের সংস্করণ পড়ে আমাকে যা লিখেছেন তার সারসংক্ষেপ হলো এ রকম, ‘জনাব, আপনি যে বাংলাদেশে বড় হয়েছেন, সে বাংলাদেশ আর আজকের বাংলাদেশ এক নয়। এখন বাংলদেশের মানুষ আর গরিব নয়। এখানে এখন অনেক অনেক লোক আছেন যাঁরা প্রতিদিনই ঈদ করে থাকেন।’ আপনাদের মতো আমিও জানি, এখন দেশে অনেক মানুষ আছেন, যাঁরা আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, পাড়াপ্রতিবেশী নিয়ে ঈদ করতে চান না। তাঁরা ঈদ এলে সপরিবার চলে যান কক্সবাজার, কুয়াকাটা, আর যাঁরা আরও ধনী তাঁরা যান ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর, কুয়ালালামপুর। এমনকি ইউরোপ-আমেরিকাতেও গিয়ে তাঁরা ঈদ উদ্‌যাপন করে থাকেন। সবশেষে আপনাদের কাছে আমার প্রশ্ন, যেদিন বাংলাদেশের সব মানুষ প্রতিদিনই ঈদ করবে, সেদিন কি আমার ছেলেবেলার সেই ঈদ, সেই স্মৃতি, সেই আনন্দ থাকবে, নাকি উন্নয়নে হাওয়ায় হারিয়ে যাবে? কথাগুলো লিখতে গিয়ে বুঝতে পারছি আবেগে চোখ দুটো ভিজে আসছে।

লেখক: অর্থনীতির অধ্যাপক, টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি; এডিটর - জার্নাল অব ডেভেলপিং এরিয়াজ