3k33: ২য় পর্ব

ছবি: রয়টার্স

বৈজ্ঞানিক উপন্যাসের প্রথম পর্বের পর...

ফ্রাইডে বিকেলে ক্লাস করে এসে খুবই ক্লান্ত মন। বাসায় ফিরে বিটাকে বলল, তার রুমের লিকুইড ফুড মেশিন টপ আপ করতে। জুস, স্যুপ লাগবে বলে শাওয়ারে ঢুকে গেল। শাওয়ারে মনের হঠাৎ মনে হলো, আরেহ ঘণ্টাখানেক আগে জিল টেক্সট করেছিল তো, উত্তর দেওয়া হয়নি, ক্লাসে ব্যস্ত ছিল সে। বের হয়ে উত্তর দেবে। আগে তার মাকে ফোন করতে হবে।

বের হয়ে দেখল, বিটা রিফিল ফুড করে গেছে, গ্রিন লাইট জ্বলছে। সে আবারও বিটাকে ডাকল দুটো প্রোটিন আর ফ্যাট ফুড ট্যাবলেট দিয়ে যেতে আর তার কাপড়গুলো ওয়াশারে দিতে মন পম হাতে নিয়ে দেখে তার মা, নীলি ইতিমধ্যে ফোন করেছিল তাকে। মন ফোনব্যাক করল, ‘হ্যালো মাম... কেমন আছ?’

‘অডিও কল দিলে কেন, ভিডিও কল দাও। তোমাকে দেখিনি দুই দিন, তোমার শরীর ভালো? খেয়েছ?’

‘উফ মাম, থাক না, ভিডিও কল লাগবে না। খাব এখন। বাবা ফিরছে?’ মন দেখল, তার মা লাইন কেটে দিয়ে আবার ভিডিও কল দিয়েছে। ভিডিও কল রিসিভ করল মন, ‘বলো কী বলবে, দেখো কী দেখবে। আবার বোলো না আমার ওজন কমেছে। আমি ঠিক আছি। আর শোনো, আমি কিন্তু শিশু নই।’

‘হ্যাঁ, মীর ফিরেছে এশিয়া থেকে আজ। কাল প্রোগ্রাম না? তোমার মনে আছে তো? ১২টার আগে চলে এসো। শনও আসবে। তুমি তো আসলেই শুকিয়ে গেছো।’

‘হুঁ, মনে আছে, আসব। আচ্ছা একটা অনুরোধ করি, রাখবে?’

‘আগে বলো, শুনে দেখি।’

‘বিটাকে আমার দরকার নেই। আমি একা থাকি, কী–ই বা এমন কাজ বাসায়? সবকিছু তো মেশিন দিয়েই করে। একটু নড়াচড়া করে তো আমিই সব কাজ করে ফেলতে পারি। তখন আমি একটু বেশি খেতে পারতাম। বিটা থাকায় আমার কোনো কাজ নেই, কোনো ক্যালরি খরচ হয় না, শুধু শুধু অপচয়। এর চেয়ে যাদের দরকার, তারা নিক। আমি বিটাকে ডিপোতে জমা দিয়ে দিই?’

‘না, এসব কী বলো! তুমি একা থাকো বলেই তো আমি বিটাকে কিনে দিয়েছি, যেন তোমার সাহায্য হয়। অসুস্থ হলে একা না লাগে, নিরাপত্তাও একটা বিষয়। বিটা থাক। কাল চলে এসো সবুজ রঙের কিছু পরে।’

‘উফ মাম, কেন যে মান্ধাতার আমলের মতো কথা বলো! তোমার মতো আধুনিক একটা মহিলা এমন কথা বলে? বাসার সবকিছুই তো লকড থাকে। কার্ড সোয়্যাপ বা টাচ স্ক্রিন ছাড়া তো কিছুই ওপেন হয় না, তাহলে সিকিউরিটির প্রশ্ন কীভাবে আসে? আর বিটা কী এমন সাহায্য করে? বরং আমি অলস হয়ে যাচ্ছি। আবার বলছো সবুজ পোশাক পরে যেতে! সবাই এক রঙের পোশাক একদম স্কুল ইউনিফর্মের মতো লাগে, খুবই হাস্যকর!’

‘তুমি কি কারও সঙ্গে এনগেজ?’

মন খুব অবাক হয়ে তার মায়ের দিকে তাকাল। তারপর বলল, ‘সে রকম কিছু হলে কি আমি তোমাকে বলতাম না? তুমি তো আমাকে চেনো, আমি তোমারই মেয়ে। এই যে আমি এখন ফুড ক্যাপসুল খেয়ে, অ্যাসাইনমেন্ট শেষ করে, প্রে করে ঘুমিয়ে যাব। কিন্তু বিটা না থাকলে আমি রান্নাঘরে নিজেই কিছু রান্না করে খেতে পারতাম, আমার অনেক ক্যালরি খরচ হতো... বেশি খাওয়া হতো।’

‘আচ্ছা, তোমার ইচ্ছা হলে তুমি রান্না করে খেয়ো। কিন্তু বিটা থাক। তুমি এইরার অন্যতম বুদ্ধিমতী মেয়ে, ইউনিওয়ানের নজর আছে তোমার ওপর, সেটা কি তুমি জানো? আমি চেয়েছি এসব ঘরের কাজে তুমি সময় ব্যয় না করে পড়াশোনায় মনোযোগী হও। তোমাকে যেকোনো সময় মানবন্ত্ররা ডাকবে, তুমি সে জন্য প্রস্তুত হও। বিটা, ক্যালরি এসব নিয়ে ভাবার অনেক মানুষ এইরায় আছে, এসব তুচ্ছ বিষয় নিয়ে তোমার না ভাবলেও চলবে।’

‘তুমি এসব কী বলছো মাম?’

‘হ্যাঁ, ঠিকই বলছি। আমি তোমার মাম, সুতরাং আমি না জানলে কে জানবে? এ জন্যই আমি বিটাকে দিয়েছি। এগুলো আবার বন্ধুবান্ধবদের বোলো না। তুমি নিশ্চয়ই জানো, কেন মানা করছি। আচ্ছা এখন যেতে হবে। কালকের জন্য কিছু প্রস্তুতি আছে, সময়মতো চলে এসো। বিশেষ কিছু খেতে ইচ্ছা করলে আজই টেক্সট কোরো। মাম লাভস ইউ আ লট। বাই।’ লাইন কেটে দিল নীলি।

মন অনেকক্ষণ ধরে পমের দিকে তাকিয়ে আছে। অনেকক্ষণ পর টেক্সটের আওয়াজ, ‘তুমি কি বেশি ব্যস্ত?’ জিল পাঠিয়েছে।

‘সরি, আমি আসলেই বেশি ব্যস্ত ছিলাম। ফোন করব? টাইপ করতে ইচ্ছা করছে না,’ উত্তর দিল মন।

‘আমি কল করছি।’ টেক্সট পাঠিয়ে সঙ্গে সঙ্গে ফোন করল জিল।

‘হ্যালো’

‘হ্যালো’

দুপাশেই কিছুক্ষণ চুপচাপ। পরে জিল বলল, ‘ব্যস্ত ছিলে বললে!’

‘হুম, ইউনিভার্সিটিতে পমের সাউন্ড অফ ছিল, ব্যস্তও ছিলাম, বাসায় ফিরে ফ্রেশ হতেই মাম কল করল... একটু আগে কথা শেষ হলো, তোমার দিন কেমন গেল?’

‘আমি আজ অত ব্যস্ত ছিলাম না। বিকেলে ইউনিভার্সিটিতে গিয়েছিলাম। তাই তোমাকে টেক্সট করা, ফ্রি আছো কি না দেখতে।’

‘কেন রোববারে না দেখা করার কথা, সেটাই থাক। কাল মাম যেতে বলেছে, ফ্যামিলি প্রোগ্রাম।’

‘ওহ, সারা দিন?’

মন অল্প হেসে বলল, ‘না মনে হয় বা আমি ঠিক জানি না। ১২টায় যেতে বলেছে। আচ্ছা রোববারে কি তুমি গাড়ি নিয়ে আসবে না ট্রানে?’

‘সেটা এখনো ভাবিনি। গাড়ি নিয়েই বোধ হয় কিংবা কে জানে শেষ মুহূর্তে ট্রানেও যেতে পারি। কেন?’

‘না, গাড়ি হলে আমি তো বেনে থাকি, মেল হয়েই তাসে যাব। যাওয়ার পথে তোমাকে উঠিয়ে নিলাম।’

‘আচ্ছা, রোববার সকালে জানাব। এখন বাই...’

‘খিদা লেগেছে। ডিনার করিনি এখনো।’

‘ওহ তুমি রান্না খাবার খাও এখনো? আমি তো শুধু লিকুইড ফুড আর ক্যাপসুল খাই। ঝামেলা কম, কোনো প্রোগ্রাম না হলে।’

‘আমিও। রান্না খাবার খুব কম খাওয়া হয় কিন্তু আমার একটা বিটা আছে, সে সাহায্য করে তাই মাঝেমধ্যে ইচ্ছে হলে খাই।’

‘বাহ্, তুমি তো অ্যাডভান্স। আমার মামের আলফা আছে, আমি একটা গামা কিনতে বলেছিলাম। মাম রাজি হয় না, তখন নাকি সে অলস হয়ে যাবে, সুস্থ থাকতে মুভমেন্ট জরুরি।’

‘হুম, তোমার মা ঠিকই বলেছে। আমি অলস হয়ে গিয়েছি।’

‘আচ্ছা বাই।’

‘বাই’

জিল ভাবছে, মনের কণ্ঠ এত শান্ত। খুবই স্বাভাবিকভাবে কথা বলল। কণ্ঠে ওঠানামা বা উচ্ছ্বাস নেই আবার নির্জীবও নয়। খুবই পরিমিত, ধীরস্থির। যেন কতকাল ধরে তার সঙ্গে কথা বলেছি। জিলের মতো অস্থির নয় মন।

জিল তার মা টাসিকে বলেছে মনের কথা। সে রোববারে একটা মেয়ের সঙ্গে দেখা করবে। টাসি হেসে বলেছে, ‘দেখা করবে, আমাকে বলার কী আছে? তুমি যথেষ্ট বড় হয়েছ।’

জিল হেসে ফেলল। বলল, ‘আমি বেনের প্রিমিয়ারের জসের সঙ্গে কথা বলেছি। জস বলল, আমার জন্য নাকি তিনটা মেয়ে বাছাই করা আছে তাদের কাছে। যারা আমার মানসিকতার সঙ্গে মেলে। আমি তিনজনের সঙ্গেই আলাদা কথা বলে সিদ্ধান্ত নিতে পারি কাকে বিয়ে করব। অবশ্যই সেই মেয়েকেও রাজি থাকতে হবে।’

‘সে কী! তুমি এই জামানায় বিয়ে করতে চাও?’

‘হ্যাঁ, আমার এই নিয়মই পছন্দ।’

‘যে মেয়ের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছ, সে ওই তালিকার তিনজনের মধ্যে আছে?’

‘হ্যাঁ, কিন্তু তিন নম্বরে। জস বলছে, আমিও নাকি ওই মেয়ের জন্য যে তিনজন ছেলের তালিকা আছে, সেখানে তিন নম্বরে আছি!’

‘সেটা ব্যাপার না। দুজন দুজনের তালিকায় আছ, সেটাই আসল, তালিকায় না থাকলে কিছু যে হতো না, সেটা তো জানোই।’

‘হুম। কিন্তু মাম, এমন অদ্ভুত নিয়ম কেন? আর এই মেয়ে যদি ওই তালিকায় না থাকত, আমি তবু তার সঙ্গে দেখা করতাম, কথা বলতাম।’

‘আহা, ওরা তো মানুষের মানসিকতা, স্বভাব, বৈশিষ্ট্য বুঝেই তালিকা করে।’

‘কিন্তু এই মেয়ের যদি অন্য দুই ছেলের মধ্যে কাউকে বেশি পছন্দ হয়ে যায়, তখন?’

‘হ্যাঁ, সেটাও হতে পারে। আগেই এত কিছু না ভেবে দেখা করো। তুমি এত বুদ্ধিমান একটা ছেলে, কিন্তু অস্থিরতা কমাতে পারলে না। আমার শুভকামনা সব সময় তোমার সঙ্গে।’

পরদিন মন ঠিকই একটা সবুজ রঙের টপস পরে মায়ের বাসায় গেল।

নীলি, মীর খুব খুশি। অনেক দিন পর শনকে দেখে ভালো লাগল মনের, তার ছোট ভাই, যদিও ঠিক ছোট নয়, আবার ছোটও! এখন আর প্রাচীনকালের মতো মেয়েদের পেটের মধ্যে শিশু বড় হয় না, এখন সবাই টিউবকিউব শিশু। টিউবে নিষেকের পর জরায়ুর মতো কৃত্রিম কিউবে ভ্রূণ বড় হয়। ঠিক ৪০ সপ্তাহ পর সেটিকে মা–বাবার হাতে তুলে দেওয়া হয়। তার আগে মা–বাবাকে নিয়ে অনেক নিরীক্ষা চলে এটা দেখার জন্য যে তারা অভিভাবক হওয়ার যোগ্য কি না। তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় প্যারেন্টিংয়ের ওপরে। মন আর শনের ভ্রূণ একসঙ্গেই নিষিক্ত হয়েছিল টিউবে কিন্তু নীলি একসঙ্গে দুটো শিশু চায়নি। আগে মেয়ে চেয়েছিল তখন। তাই শনের ভ্রূণ বিশেষ প্রক্রিয়ায় দুই বছর সংরক্ষিত ছিল। সেই হিসাবে মন আর শনের বয়স প্রায় একই, কিন্তু শন জন্মেছে দুবছর পর! শন অনেক লম্বা হয়ে গেছে। অবশ্য এখন আর কেউই খাটো হয় না, সবাই অনেক লম্বা।

মন বাসায় ফিরল সন্ধ্যায় একগাদা রান্না করা খাবার আর মীরের আনা একটা এশিয়ান পোশাক নিয়ে। সেগুলো সব বিটার হাতে ধরিয়ে দিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে গেল। ক্লান্ত সে, ছুটির দিনেও বিশ্রাম হয়নি। রাত জেগে অ্যাসাইনমেন্ট শেষ করেছে। তাই কিছুক্ষণ পরই ঘুমিয়ে পড়ল মন।

রোববার সকাল ৯টা। মন ঘুম থেকে উঠে ভাবছে, ট্রানে যাবে না গাড়িতে, জিলকে জানাতে হবে।

মন হাতমুখ ধুয়ে হয়ে নীল শার্ট, কালো জ্যাকেট আর কালো প্যান্ট পরল, চুলগুলো পনিটেল করে, মুখে লোশন মাখল। এরপর চোখের নিচের পাতায় কালো আই পেনসিল দিয়ে একটা টান দিয়ে ওপরের পাতায় মাসকারা দিল। হালকা ব্রাউন শেডের লিপগ্লস দিয়ে আয়নায় নিজের দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর ভেংচি কেটে হ্যান্ডব্যাগ নিল। পমে ঢোকানোর আগে জিলকে টেক্সট করল, ‘এইটা আমার ঠিকানা, যাওয়ার সময় উঠিয়ে নিতে চাইলে এসো। ৯.৩৫ থেকে ৯.৪৫। এই ১০ মিনিট অপেক্ষা করব। এর মধ্যে না এলে আমার গাড়ি নিয়ে বের হয়ে যাব।’ এরপর বিটাকে ডেকে বলল মিষ্টিজাতীয় কিছু বানাতে আর বাসা ভ্যাকুয়াম করে শুকনা কাপড়গুলো আয়রন ফোল্ড করতে। ৯.৩২ বাজে। মন জুতা পরে ফেলল। নিজেকে আরেকবার আয়নায় দেখে বেরিয়ে গেল।

জিল গাড়িতেই বসে ছিল। ছাইরঙা টি–শার্ট আর নেভি ব্লু জিনস পরে, হাতে একটা নীল জ্যাকেট নিয়েছে সে। পম পকেটে। মনের টেক্সট পড়ে হাসল। ‘ওকে’ উত্তর দিয়ে গাড়িকে ভয়েস ইনস্ট্রাকশন দিল মেলের ঠিকানা। পাঁচ মিনিট লাগবে বড়জোর। স্বয়ংক্রিয় গাড়ি চলছে। জিল কিছুটা নার্ভাস বোধ করছে।

প্রায় চলে এসেছে। জিল তাকিয়ে দেখল, মন দাঁড়িয়ে আছে। নার্ভাসনেস বেড়ে গেল। জিল গাড়ি থেকে বের হয়ে মনের সামনে দাঁড়াল। চোখের দিকে তাকিয়ে ডান হাত এগিয়ে দিল। বলল, ‘আমি জিল।’ (মাথা কিছুটা ঝিমঝিম করছে, মেয়েটার চোখে নেশা আছে)

ছেলেটা এত হ্যান্ডসাম,কিন্তু একটু পাগলাটে। মন মৃদু হাসি দিয়ে ডান হাত এগিয়ে হ্যান্ডশেক করে বলল, ‘জানি তো। আর তুমিও জানো, আমি মন।’

‘চলো...’

গাড়িতে উঠে জিল আবার ইনস্ট্রাকশন দিল তাসের ঠিকানা—ওয়াইন গ্লাস বে বিচ। গাড়ি ছোটা শুরু করল। দুজনই চুপচাপ। যার যার পাশের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। পরবর্তী পাঁচ মিনিটে পৌঁছে গেল ওরা।

‘চলে এসেছি, চলো নামি।’

মন গাড়ি থেকে নেমেই বলল, ‘কী সুন্দর বিচটা। চলো বিচে যাই আগে, হেঁটে আসি। এখনো সূর্যের তেজ কম। পরে ক্যাফেতে আসি।’

‘আচ্ছা চলো।’

দুজনই একদম পানির সামনে এসে দাঁড়াল।

‘বলো তো, কেন তোমার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছি?’

‘কেন?’ চলবে...

 **দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]