দ্য পাওয়ার অব ফুটবল
বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন পরীক্ষার প্রস্তুতি কি চলছে। সাধারণ জ্ঞান বইয়ের সারা বিশ্ব অংশে একটা প্রশ্ন ছিল এমন—কোনো উৎসবকে ‘গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’ বলা হয়। যত দূর মনে পড়ে উত্তরের চারটি বিকল্পের মধ্যে ছিল—অলিম্পিক গেমস, বিশ্বকাপ ফুটবল, বিশ্বকাপ ক্রিকেট, সাফ গেমস এমন সব উত্তর। স্থায়িত্ব ও মাত্রার বৈচিত্র্যের কারণে আমার মাথায় ঘুরছিল উত্তর হবে অলিম্পিক গেমস। কিন্তু উত্তরপত্রে গিয়ে দেখলাম উত্তর হচ্ছে বিশ্বকাপ ফুটবল। তখন মনে হলো আসলেই বিশ্বকাপ ফুটবল যেভাবে সারা বিশ্বকে নাড়িয়ে দেয়, এভাবে হয়তো–বা আর কোনো উৎসব সারা বিশ্বের মানুষকে একই সুতায় বাঁধতে পারে না।
একটু পেছন ফিরে দেখা যাক। এক টাকা দামের বাংলা, ইংরেজি আর অঙ্কের এক্সারসাইজ খাতা পাওয়া যায় দোকানে। সেই খাতার ওপর বল পায়ে এক লোকের ছবি দেওয়া। তার মাথার কাছে বিশ্বকাপ ফুটবলের ছবি দেওয়া। ছবিটার নিচে লেখা ম্যারাডোনা। এভাবেই আমাদের পরিচয় ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা মহাতারকা ম্যারাডোনার সঙ্গে। তখনো বল আমাদের কাছে সহজলভ্য নয়। আমরা বিভিন্ন প্রকারের কাগজ একত্র করে পাটের সুতলি দিয়ে দলা পাকিয়ে বেঁধে খেলতে নেমে পড়ি। কিন্তু অত্র অঞ্চলে বিদ্যুৎ বা টেলিভিশন না থাকায় বাস্তবে ফুটবল খেলা দেখার সৌভাগ্য হয়নি। কিন্তু পাড়ায় পাড়ায় ফুটবল খেলার প্রতিযোগিতা চলে। আর সেখানে ট্রফি হিসেবে দেওয়া পানপাতা আকারের ‘সিল’। কালো কাঠের শরীরে টিনের তৈরি কিছু প্রতিকৃতি গাঁথা থাকে। কখনো সেটা ধরে দেখার সুযোগ পেলে নিজেকে ধন্য মনে করতাম আমরা।
এরপর শহরতলিতে এসে প্রথম পরিচয় বিদ্যুৎ, টেলিভিশন ও ফুটবলের জাদুকর ম্যারাডোনার সঙ্গে। পাড়ার একমাত্র টেলিভিশনে খেলা দেখার ব্যবস্থা। যেদিন খেলা থাকে, সেদিন টেলিভিশন ঘর থেকে বের করে বারান্দায় চেয়ার পেতে তার ওপর বসিয়ে দেওয়া হয়। সারা উঠানজুড়ে পাড়ার সব মানুষ দর্শক হিসেবে ভিড় করেন। সামনের দিকে ছোটদের বসার জন্য খেজুরের পাতার পাটি বিছিয়ে দেওয়া হয়। আর বড়রা পেছনে দাঁড়িয়ে খেলা দেখেন। ম্যারাডোনার পায়ে বল আসার সঙ্গে সঙ্গে উঠানজুড়ে নিঃশব্দ নীরবতা নেমে আসে। সবাই যেন নিশ্বাস নিতেও ভুলে যায়। ম্যারাডোনাকে বিপরীত দলের খেলোয়াড় ল্যাং মেরে ফেলে দিলে তাকে শাপশাপান্ত করে রাগ ঝাড়ে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় ম্যারাডোনা যেন আমাদের পাড়ার হয়ে বল খেলছে। এরপর আমাদের হাতে আসে বাদামের (জাম্বুরাকে কুষ্টিয়া অঞ্চলে বাদাম বলা হয়) বল। সেটা নিয়ে আমরা পাড়ার মধ্যে খোলা জায়গায় ঢোলকলমির ডাল দিয়ে গোলপোস্ট বানিয়ে খেলতে নেমে পড়ি।
পুরো গ্রামের মানুষ ম্যারাডোনা তথা আর্জেন্টিনার সমর্থক। আমি তখনো জানি না যে আর্জেন্টিনার বাইরে অন্য দলকেও সমর্থন করা যায়। বন্ধু আমিনুরের বাড়িতে খেলা দেখতে গিয়ে জানলাম, কিছু কিছু মানুষ বিশ্বকাপ ফুটবলে অন্য দলকেও দেয়। আমিনুরের ছোট চাচা হচ্ছেন ব্রাজিলের সমর্থক। তাই খেলা দেখতে বসলেই অবধারিতভাবে ছোট চাচার সঙ্গে আমাদের বিতর্ক শুরু হয়ে যেত। এই আলোচনাটা আমাদের খেলা দেখাতে বাড়তি আনন্দ যোগ করত। এ ছাড়া তখন দেয়ালে দেয়ালে আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের পতাকা আঁকা দেখতাম আমরা। তার নিচে লেখা থাকত যারা এই পতাকা এঁকেছে, তাদের নাম ও সংগঠনের নাম। এরপর ঢাকাতে এসে দেখলাম এই সমর্থন করা যেন একটা উৎসবের রূপ নিয়েছে। বাড়ির ছাদে ছাদে সমর্থক দলের বাহারি রঙের পতাকা শোভা পাচ্ছে। অনেকেই নিজের সমর্থক দেশের ওপর বাংলাদেশের পতাকাও টাঙিয়ে দিয়েছেন। পাখির দৃষ্টিতে তখন বাংলাদেশকে দেখলে মনে হবে পতাকার দেশ, উৎসবের দেশ। আমি তাই এই সমর্থন করাটাকে স্বাগত জানাই। উৎসব প্রিয় জাতি আমরা অন্যের জয়কে নিজের জয় বানিয়ে উৎসবে মেতে উঠি। অবশ্য বর্তমানে এই অবস্থা পরিবর্তিত হয়েছে।
বর্তমান বিশ্বে ফুটবল বিশ্বকাপে বিভিন্ন দলকে সমর্থনের এই হাওয়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যেও এসে লেগেছে। সেগুলো নিয়ে প্রবাসীদের মধ্যেও চলছে বিতর্ক ও আলোচনা। তবে এবার অস্ট্রেলিয়া খেলার যোগ্যতা অর্জন করলে অনেকেই অস্ট্রেলিয়াকে সমর্থন দিয়ে গেছেন। আর রাউন্ড ষোলোতে খেলার যোগ্যতা অর্জন করার ফলে সেই পালে আরও হাওয়া লেগেছে। রাউন্ড ষোলোতে খেলার যোগ্যতা অর্জন করলে অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে বিভিন্ন স্থানে সেই ম্যাচ বড় পর্দায় দেখানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল। আগের দিন বুয়েটের আমাদের ব্যাচের পুরকৌশলের গ্রীষ্মকালীন পুনর্মিলনীর সময় আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম এবার আমরা এই ম্যাচটা বড় পর্দায় দেখব। স্থান হিসেবে ঠিক করা হলো সিডনির ডার্লিং হারবার। সকাল ছয়টায় ম্যাচ শুরু হবে।
আমাদের বাসা থেকে যেতে সব মিলিয়ে ঘণ্টা দেড়েক লাগবে। সেই মোতাবেক আমরা মোবাইলের ঘড়িতে রাত চারটার এলার্ম দিয়ে রাখলাম।
ভোরে ঘুম থেকে উঠে সবাই সবাইকে ফোন দিয়ে জাগিয়ে দেওয়া হলো প্রথমে। এরপর ট্রেনে চড়ে বসা। আমাদের ধারণা ছিল ম্যাচ শুরুর ঠিক আগে দিয়েই যেহেতু মাঠে পৌঁছাব, আমরা নিশ্চয়ই মাঠে জায়গা পাব। কারণ, অস্ট্রেলিয়ার প্রধান খেলা রাগবি, যেটাকে এরা ‘ফুটি’ বলে। ফুটবলকে বলে সকার আর ক্রিকেটকে বলে ‘ক্রিকি’। এখানকার স্থানীয় টিভি চ্যানেলে ফুটি ছাড়া তেমন কোনো খেলারই সরাসরি সম্প্রচার করা হয় না। তবে এবারের বিশ্বকাপ খেলাগুলো দেখাচ্ছে। অর্থনীতির ‘ডিমান্ড অ্যান্ড সাপ্লাই’ নীতি মেনেই এটা করা হয়। আমরা ধরেই নিয়েছিলাম তেমন একটা জনসমাগম হবে না। কিন্তু আমাদের ধারণা ছিল মহাভুল। ডার্লিং হারবারে পৌঁছে দেখি মূল মাঠ ম্যাচ শুরুর আগেই কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। আমরা পুরো মাঠ অতিক্রম করে মাঠের বাইরের আরও দুটো পর্দার একটার সামনে স্থির হলাম। যেখানে পর্দার কিছুটা কাছাকাছি কোনার দিকে আমরা বসার জায়গা পেলাম।
খেলার মধ্য বিরতিতে কফি আনতে গিয়ে আমরা দোকানগুলোর সামনে মানুষের দীর্ঘ সারি দেখলাম। সেখানে বন্ধুদের রেখে আমি পুরো এলাকা চক্কর দিতে বেড়িয়ে পড়লাম। ডার্লিং হারবার মাঠের মধ্যে দুটো বড় পর্দায় খেলা দেখানো হচ্ছে। আর পুরো মাঠের চারদিকে সাউন্ড বক্স দিয়ে দেওয়া হয়েছে। যাতে একেবারে স্টেডিয়ামের শব্দের একটা অনুভূতি হচ্ছে। মূল মাঠের বাইরে বিভিন্ন ভবনের সিঁড়ি, ছাদে যে যেখানে পেরেছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এই খেলা দেখছেন। পাশাপাশি মাঠের পাশের ছোট ছোট বটগাছেও অনেকে উঠে পড়েছেন। আর পাশের পার্কের বিভিন্ন রাইডের উঁচু উঁচু স্থানও ভরে উঠেছে মানুষে মানুষে। চারদিকে অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় দলের জার্সির রঙের জার্সি পরা মানুষের উপচে পড়া ভিড়। এর মধ্যেও বেশ কিছু নীল–আকাশি রঙের আর্জেন্টিনার জার্সি পরা মানুষেরও দেখা পাওয়া গেল।
আমরা যেখানে বসেছিলাম সেখানেই নীল–সাদা জার্সি পরা দুই তরুণী এবং এক তরুণকে দেখে পরিচিত হলাম। আমার গায়ে তখন অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় পতাকা। বললাম, ‘আমি বাংলাদেশের মানুষ।’ শুনে সঙ্গে সঙ্গে তারা বলল, ‘জানি তোমাদের দেশের কথা। তোমাদের দেশের লোক বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনাকে সমর্থন করে।’ উত্তরে বললাম, বাংলাদেশের ফুটবলই সবচেয়ে জনপ্রিয় াা আর বিশ্বকাপ ফুটবল তো এক উন্মাদনার নাম। আবালবৃদ্ধবনিতা সবাই এই উৎসবে শামিল হয় যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী। সবাই রীতিমতো প্রতিযোগিতা করে পছন্দের দলের দীর্ঘতম পতাকা বানানোর চেষ্টা করে। উত্তরে এক তরুণী বললেন, ‘হ্যাঁ, আমাদের দেশের সবগুলো টিভি চ্যানেলে তোমাদের দেশের খবর প্রচার করা হয়েছে। আমার কাছে লিংকগুলো এখন নেই, না হলে তোমাকে দেখতে পারতাম। এরপর তাদের সঙ্গে সেলফি তুললাম। তারা আনন্দসহকারে পোজ দিল। এরপর মাঠের মধ্যে পেয়ে গেলাম একজন অস্ট্রেলিয়ান মেসিকে। তাকে সেলফি তোলার প্রস্তাব দিলে সেও সানন্দে বিজয় চিহ্ন দেখিয়ে পোজ দিল।’
বিশ্বকাপ ফুটবল আসলেই ‘গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’ সাত সমুদ্র তেরো নদীর দেশ অস্ট্রেলিয়াতে এসে আবারও তার প্রমাণ পেলাম। ফুটবলের উন্মাদনা সবাইকে একই সূত্রে বেঁধে ফেলেছে। বড় পর্দায় দল বেঁধে সবাই খেলা দেখেছে। আর বড় পর্দায় খেলা দেখতে গিয়ে আমাদের মনে হচ্ছিল আমরা যেন স্টেডিয়ামের জনসমুদ্রেই আছি। যেকোনো একটা আক্রমণ বা প্রতি আক্রমণের সময় সেই সমুদ্রে ঢেউ ওঠে। গোল হলে পড়ে যায় শোরগোল। চলতে থাকে দীর্ঘক্ষণ। বিশ্বব্যাপী ফুটবলের এই উন্মাদনা এটাই প্রমাণ করে যে সারা পৃথিবীর মানুষই আসলে উৎসবপ্রিয়। তারা যেকোনো উপলক্ষে আনন্দ করতে ভালোবাসে। নিজের দেশের দল খেলুক বা না খেলুক সবাই একটা পছন্দনীয় দল বেছে নিয়ে সমর্থন দেয়। আমি বিশ্বাস করি, এতে বিশ্বব্যাপী মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসায় প্রকাশ পায় এবং এভাবেই একদিন মানুষ সব যুদ্ধ ও সহিংসতাকে জয় করতে শিখে যাবে। বিশ্বকাপ ফুটবল হয়ে উঠুক সংঘাতময় পৃথিবীকে শান্তিতে বদলে দেওয়ার মাধ্যম। আসলেই হয়ে উঠুক ‘গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’।