লিসবনে এক ‘বাঙালি পাড়া’

লিসবনের বাঙালিপাড়া হিসেবে পরিচিত ‘রুয়া দো বেনফোরমোসো’ এলাকা
ছবি: লেখক

কালো পাথরের রাস্তা। অনেকটা সরু আর আঁকাবাঁকা। দুপাশে শত শত বছরের পুরোনো বাড়িঘর। তিন-চারতলা উঁচু বাড়িগুলোর ওপরের অংশে মানুষের বসবাস। নিচে দোকানপাট। অনেকটা পুরান ঢাকার মতো। গায়ে গায়ে মিশে থাকা ঐতিহ্যবাহী বাড়িগুলোর প্রতিটিই ছোট ছোট ব্যালকনি দিয়ে ভরা। নতুন কেউ এলে ব্যালকনিগুলোতেই প্রথমে চোখ আটকে যায়। কারণ, ইউরোপের মাটিতে এভাবে খোলা ব্যালকনিতে কাপড় শুকাতে দেখা যায় না আর কোথাও। তাও আবার লুঙ্গি-গামছার মতো বাঙালিয়ানা পোশাক! পর্তুগালের ‘রুয়া দো বেনফোরমোসো’র চিত্র এটি, যেটি মূলত ‘বাঙালি পাড়া’ নামেই বেশি পরিচিত।

রাজধানী লিসবনের ডাউনটাউন মার্তিম মোনিজে এলেই ইউরোপের চিরচেনা দৃশ্যে বাংলাদেশের ছাপ পড়ে। আধমাইল দৈর্ঘ্যের রুয়া দো বেনফোরমোসো রাস্তার দুপাশে শতাধিক বাঙালি দোকান। বাংলায় লেখা সাইনবোর্ড। দোকানের সামনে দেশি শাকসবজির পসরা সাজিয়ে বসেন বিক্রেতারা। লাউ, কুমড়া, মিষ্টি আলু থেকে শুরু করে ঝিঙে, করলা, চিচিঙ্গা সবই পাওয়া যায় এখানে। প্রতিদিনই বাজারে ওঠে লালশাক, পুঁইশাক, পালংশাক কিংবা কলমিশাকের মতো দেশি শাকসবজি। দোকানিদের মতে, ঢাকার কারওয়ান বাজারেও যা না পাওয়া যায়, পর্তুগালের বাঙালি পাড়ায় তা পাওয়া যায়। বরং এখানকার শাকসবজিতে ক্ষতিকর রাসায়নিকের ব্যবহার না থাকায় স্বাদটাও একটু বেশি।

দোকানের সামনে দেশি শাকসবজির পসরা সাজিয়ে বসেন বিক্রেতারা
ছবি: লেখক

শাকসবজির দোকানের পাশাপাশি আছে মুদিখানা, রেস্তোরাঁ, চা-কফি ও মিষ্টির দোকান। কেউ কেউ আবার দেশি পোশাক কিংবা চীন থেকে আনা ইলেকট্রনিকস পণ্যের পাইকারি ব্যবসা করেন। আছে বেশ কয়েকটি নাপিত ও দরজির দোকানও।

কথা হয় দুবাই থেকে পর্তুগালে আসা শুকুর আলীর সঙ্গে। বাঙালি পাড়ার একটি দোকানে বেছে বেছে লাউ কিনছিলেন তিনি। বলেন, ‘এই মার্তিম মোনিজে শুধু মা–বাবা, পরিবার ছাড়া আর কিছুই মিস করি না। মিস করার সুযোগ নেই। কারণ, এখানে সবই পাওয়া যায়। গত এপ্রিলে পর্তুগালে এসে অন্তত এটুকু অভিজ্ঞতা হয়েছে।’ শুকুর আলীর সঙ্গে সুর মিলিয়ে কথা বলে ওঠেন দোকানদার জহির আলম, ‘আমাদের দোকানে শতকরা ৮০ ভাগ শাকসবজিই আসে স্থানীয় পর্তুগিজ খেতখামার থেকে। এসব খেতখামারে বাংলাদেশিদের সঙ্গে নেপালি, পাকিস্তানি, ভারতীয় ও আফ্রিকান অভিবাসীরা কাজ করেন।’ কথোপকথনে যোগ দিয়ে আরও দুই স্থানীয় দোকানি মেহেরাজ ও রাজু জানান, কিছু কিছু বাংলাদেশি পণ্য তাঁরা ইউরোপের অন্যান্য দেশ থেকেও নিয়ে আসেন। বিশেষ করে ফ্রান্স, ইতালি, জার্মানি, স্পেন ও লন্ডন থেকে আসেন নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য। বাংলাদেশ থেকে সরাসরি পর্তুগালে আমদানিতে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, দীর্ঘসূত্রতা ও খরচ বেশি পড়ায় তাঁরা এসব রুট বেছে নেন।

এসব শাকসবজির বাজারে দরদামের হিসাবটা আবার অন্য রকম। প্রথম প্রথম অনেকেই অবাক হন। অবশ্য শুধু বাঙালি পাড়া নয়, পুরো পর্তুগালের বাজারই এমন। দুই-আড়াই ইউরোতে যেখানে এক কেজি মুরগির মাংস পাওয়া যায়, সেখানে এক কেজি মরিচের দামই দশ-বারো ইউরো। ছয়-সাত ইউরো দিয়ে এক কেজি গরুর মাংসের দামে কিনতে হয় একটি লাউ। এভাবে পর্তুগালজুড়েই নিরামিষের দাম আমিষের দ্বিগুণ। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা তিন-চার গুণও বটে!

লিসবনের ডাউনটাউন মার্তিম মোনিজে এলেই ইউরোপের চিরচেনা দৃশ্যে বাংলাদেশের ছাপ পড়ে
ছবি: লেখক

আটলান্টিক সাগরবেষ্টিত পর্তুগালে পানির দামে সামুদ্রিক মাছ পাওয়া যায়। তবু মিঠাপানির মাছ খোঁজেন অনেকে। ঠিক যেন তাঁদের জন্যই বাঙালি পাড়া। দেশ থেকে বাছাই করা সেরা মাছগুলো হিমায়িত হয়ে আসে পর্তুগালসহ ইউরোপের বাজারে। রুই, কাতলা, পাবদা, পুঁটি, মলা, ঢ্যালা, ইলিশ, বোয়াল সবই পাওয়া যায় বেনফোরমোসোর দোকানগুলোয়। অনেকে আবার আসেন কেবল হালাল মাংস কিনতে। আর এত সব থাকার পরও বাড়িতে যাঁদের রান্নার সময় নেই, তাঁদের জন্যই মজার মজার খাবার নিয়ে বসে থাকে বাঙালি পাড়ার রেস্তোরাঁগুলো। ভর্তা-ভাজি কিংবা পাঁচমিশালি মাছের তরকারিসহ সবই পাওয়া যায় এখানে। এসব রেস্তারাঁয় বাংলাদেশিদের পাশাপাশি পাকিস্তানি ও কিছু ভারতীয় লোকেরও দেখা যায়। এশীয় খাবারের স্বাদ নিতে ছুটে আসেন অন্যান্য দেশের পর্যটকেরাও।

বাংলাদেশিদের ভিড়ে সবচেয়ে বেশি মুখর থাকে রুয়া দো বেনফোরমোসোর চায়ের দোকানগুলো। গরম-গরম শিঙাড়া, পুরিসহ ঘরোয়া নাশতার বিভিন্ন আইটেম চলে এসব ক্যাফেতে। এমনকি পর্তুগিজ চিজ-রুটিতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠা বাংলাদেশিরাও দূরদূরান্ত থেকে ছুটে আসেন এককাপ দেশি চায়ের স্বাদ নিতে। চায়ের মধ্যে পাউরুটি ডুবিয়ে খাওয়ার অধিকার কেবল যেন বাঙালি পাড়াতেই! তাই প্রতিদিন না হলেও অন্তত মাসে একবার মার্তিম মোনিজে ঢুঁ মারেন তাঁরা। দেশে ফেলে আসা টংদোকানের চায়ের স্মৃতি হাতড়ে ফিরে যান আবার। এখানকার চায়ের আড্ডায় ঘুরেফিরে আসে বাংলাদেশের রাজনীতি কিংবা পর্তুগালের অভিবাসন নীতি। আড্ডাবাজদের চোখ-মুখের ভাষাই বলে দেয়, বাংলায় কথা বলতে পারার চেয়ে বড় তৃপ্তি আর নেই।

লিসবনের ডাউনটাউন মার্তিম মোনিজে এলেই ইউরোপের চিরচেনা দৃশ্যে বাংলাদেশের ছাপ পড়ে
ছবি: লেখক

কুমিল্লা মাতৃভান্ডারে মিষ্টি কিনছিলেন বরিশালের শহিদুল ইসলাম। মুখভর্তি হাসি নিয়ে তিনি বলেন, ‘পর্তুগালের রেস্তোরাঁ কিংবা সুপারশপগুলো থেকে মজার মজার ডেজার্ট তো প্রতিদিনই খাই। ওগুলোর অভাব নেই। তাই বলে বাংলাদেশের রসমালাইয়ের স্বাদ কি আর অন্য কিছুতে মেটে?’ মিষ্টি হাসিতে শহিদুলের কথায় সম্মতি দেন মিষ্টি কিনতে আসা আরও দুই ক্রেতা। বেনফোরমোসো ঘুরে দেখা যায় বেশ কিছু মিষ্টির দোকান। দোকানগুলোয় দেশি স্বাদের রসগোল্লা, চমচম, কালোজাম, ক্ষীর সন্দেশ, জিলাপিসহ সব ধরনের মিষ্টিই পাওয়া যায়। বাড়তি হিসেবে পাওয়া যায় বিভিন্ন রকম ঘরোয়া পিঠাপুলি।

তবে এত এত প্রাপ্তির ভেতরও আছে অপ্রাপ্তির আক্ষেপ। চায়ে চুমুক দিতে দিতে মুনতাসির আহমেদ নামের একজন বাংলাদেশি শিক্ষার্থী বলেন, ঢেঁকি যেমন স্বর্গে গেলেও ধান ভানে, বাঙালি তেমন ইউরোপে এসেও বদনাম কুড়ায়। মুনতাসিরের এমন মন্তব্যের মর্মার্থ খুঁজতে খুব বেশি দূর যেতে হয়নি। রাস্তার ওপরই বিস্কুটের প্যাকেট, চায়ের কাপ, কলার খোসা ছুড়ে ফেলছেন অনেকে। পুরো পর্তুগালের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা যেন হেরে যায় বেনফোরমোসোর কাছে। ময়লা-আবর্জনায় উপচে পড়া ডাস্টবিনগুলো বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার কথাই মনে করিয়ে দেয়। দেশ থেকে শিখে আসা এমন অনেক নেতিবাচক চর্চা চলে বেনফোরমোসোর রাস্তায়। কোনো ধরনের নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে ফুটপাতে পান বেচতে বসে যান কেউ কেউ। পুলিশ দেখলেই আবার টুপ করে লুকিয়ে পড়েন। আর যা-ই হোক, ইউরোপের মাটিতে এসব দৃশ্য বিরল। অভিবাসীদের এমন নেতিবাচক চর্চা একদমই ভালোভাবে নেন না পর্তুগিজরা। বিদেশের মাটিতে এভাবেই নিজেদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেন কিছু বাংলাদেশি; যার পুরো দায়ভার এসে পড়ে সমগ্র বাংলাদেশের ওপর।

কালো পাথরের রাস্তা। অনেকটা সরু আর আঁকাবাঁকা
ছবি: লেখক

বাঙালি পাড়া ঘুরে জানা যায়, নিয়মিত পুলিশি অভিযান চলে মার্তিম মোনিজে। বাঙালিদের যেন বাড়তি নজরদারিতে রাখে পর্তুগিজ সরকার। স্থানীয় গণমাধ্যমে প্রায়ই খবরের শিরোনাম হন তাঁরা। বেশির ভাগই ব্যবসাক্ষেত্রে নিয়মনীতি না মানা, ট্যাক্স ফাঁকি, পরিবেশদূষণ ও অভিবাসনসংক্রান্ত কাগজপত্র জালিয়াতির অভিযোগ। স্থানীয় লোকজন জানান, মার্তিম মোনিজ এলাকায় কিছু পাকিস্তানি ও ভারতীয়র দোকানপাট থাকলেও বাংলাদেশিদেরই বদনাম বেশি।

শাকসবজির দোকানের পাশাপাশি আছে মুদিখানা, রেস্তোরাঁ, চা-কফি ও মিষ্টির দোকান
ছবি: লেখক

বাংলাদেশিসহ এশিয়ানদের সচেতন করতে স্থানীয় কয়েকটি এনজিও কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশি কমিউনিটির প্রতিনিধিরা তাদের নানাভাবে সহযোগিতাও করেন। নিজ দেশের অভিবাসীদের সচেতন করতে স্বেচ্ছায় এগিয়ে আসেন কেউ কেউ। তাঁদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আগের তুলনায় কিছুটা উন্নতি হয়েছে ঠিকই, তবে দুর্নাম ঘোচাতে পারেননি বাংলাদেশিরা। তা ছাড়া পর্তুগিজ সরকারে বর্তমানে মধ্যম ডানপন্থীরা ক্ষমতায় এবং কট্টর ডানপন্থীরা প্রধান বিরোধী দলে থাকায় পান থেকে চুন খসলেই অভিবাসীদের একহাত নিচ্ছেন রাজনীতিবিদেরা। এমন পরিস্থিতিতে নিজেদের আরও বেশি সচেতন করতে স্থানীয় বাংলাদেশ দূতাবাসের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন অনেকে।