এক শ্রাবণ সন্ধ্যা
বাংলাদেশে এখন বর্ষাকাল, আষাঢ় ও শ্রাবণ—এ দুই মাস যার ব্যাপ্তি। এ সময় দেশে মুষলধারে বৃষ্টি হয়, ঘরের চাল বেয়ে বাদলের নিরবচ্ছিন্ন ধারা পড়তে থাকে অবিরাম। পানির প্রবল ধারায় এ সময় নানা আবর্জনা ঘর-বাড়ি, রাস্তা-ঘাট থেকে দূরে, নির্জনে গিয়ে পড়ে কোন নদ-নদী, সাগর, মহাসাগরে। নদ-নদী, খাল-বিল ডুবে যায়। সাময়িক কিছু অসুবিধা হলেও, কৃষক-কৃষাণীরা খুশিতে মেতে ওঠেন নতুন ধান রোপণ করবেন বলে। গ্রীষ্মের প্রখরতায় গাছপালার জীর্ণশীর্ণ চেহারা থেকে যেন নতুন প্রাণের সঞ্চার হয়, যা জানান দেয়, গাছের নতুন নতুন পাতা এবং কুঁড়ি গজানোর মধ্য দিয়ে। শ্রাবণে বৃষ্টির তীব্রতা একটু বেশিই থাকে, আর তাইতো বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শ্রাবণে গান রচনা করেছেন—
শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে,
পড়ুক ঝরে
তোমারি সুরটি আমার মুখের পরে,
বুকের পরে...
রবীন্দ্রসংগীতের এই গানটিতে সকল জীর্ণতা, দীর্ণতা, ক্ষুধা, দারিদ্র্যের স্তরে স্তরে শ্রাবণের বৃষ্টির ধারার মত ঝড়ে পড়ুক সুরের ধারা, এমন বন্দনা করা হয়েছে। যেখানে ফুল ফোটে না, ফল ধরে না, শ্রাবণের বাদল ধারা তাদেরকেও জাগিয়ে দেয়ার নিবেদন করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ, আর কানাডা চার ঋতুর দেশ হলেও আবহাওয়ার কিছু মিল আছে। কানাডায় বর্ষাকাল বলে আলাদা নাম নেই। এখানে এখন গ্রীষ্মকাল চলে এবং এই গ্রীষ্মের মধ্যেই আমরা এখানে বাংলাদেশের বর্ষাকালের আমেজ, অনুভূতি পেয়ে থাকি। এমন দিনে আমরা মুড়ি-চানাচুর, মাংস-খিঁচুড়ি খেয়ে থাকি। বাংলাদেশের মতো আমাদের এখানেও এখন অনেক বৃষ্টি হয়। এই তো সেদিন নোভা স্কশিয়াতে বন্যা হয়ে গেল, অনেক রাস্তাঘাট, ব্রিজ ভেঙে গেল, নদ-নদী, খাল, ঘরবাড়ি ডুবে গেল।
বর্ষাকালের গুরুত্ব অনেক। এর সঙ্গে প্রাকৃতিক এবং সাংস্কৃতিক সম্পর্ক রয়েছে। এই মৌসুমিক বৃষ্টি সারা বিশ্বের অর্থনৈতিক এবং কৃষি ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এসময় কানাডাতে স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ক্লাস থাকে না তথা ছুটি থাকে। ফলে সাংস্কৃতিক উৎসব এবং ব্যক্তিগত উপভোগের জন্য এই মৌসুমে বিভিন্ন আনন্দদায়ক অনুষ্ঠান ও কার্যক্রম অনুষ্ঠিত হয়।
অভিভাবকেরাও সারা দিনের কাজ ও বাধ্যতামূলক কর্মকাণ্ড এই সময়ে কিছুটা কমিয়ে দিয়ে সময় কাটানোর জন্য বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন বা অংশগ্রহণ করে থাকেন। প্রকৃতির সৌন্দর্য, বৃষ্টি, ঘাসের ও ফুলের খুশবু, হ্রদ, নদী, সাগর, মহাসাগরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ভোগ করতে ছুটে চলেন এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে।
এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে সুদূর প্রবাসে বিস্তৃত করার অব্যাহত প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে আয়োজন করা হয় এক সাংস্কৃতিক সন্ধ্যার। শ্রাবণ মাসকে স্মরণ করে তার গুরুত্ব, গাম্ভীর্যকে নতুন প্রজন্মের কানাডার প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে ছড়িয়ে দেবার জন্য এক শ্রাবণ সন্ধ্যার আয়োজন করা হয় কানাডার লন্ডন, অন্টারিওতে। তা যেন ঠিক শ্রাবণের বাদল ধারার মত এখানকার প্রজন্ম বা প্রবাসীদের মনকেও করে উদ্বেলিত।
অনুষ্ঠানে শাওন সেঁজুতির কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথের ‘শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে,/পড়ুক ঝরে তোমারি সুরটি আমার মুখের পরে,/বুকের পরে’ গানটি যেন প্রবাস জীবনে আমাদের শ্রাবণ মাসের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মাহাত্ম্যকে মনে করিয়ে দেয়। এরপর একে একে নৃত্য, একক সংগীত, দলীয় সংগীত, আবৃত্তি, ফ্যাশন শোর মতো দর্শকনন্দিত পর্বগুলো চলতে থাকে। অন্য অনেক গানের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের আরও একটি অনবদ্য গান ‘পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে’, শাহ আবদুল করিমের শৈশবে ফিরে যাওয়ার গান ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম’ দলীয় কণ্ঠে, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের হৃদয় ছুঁয়ে দেওয়া শৈশবে সন্তানদের প্রতি বাবাদের অকৃত্রিম ভালোবাসার গান , ‘আয় খুকু আয় খুকু আয়’ দ্বৈত কণ্ঠে পরিবেশিত হয়। অনন্ত জলিলের নিঃস্বার্থ ভালোবাসা ছবির গান, ‘ঢাকার পোলা’র সঙ্গে দারুণ সব দলীয় নাচ গ্যালারিভর্তি দর্শকদের মুগ্ধ করে রাখে পুরো অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠানটি শেষ হয়, ফ্যাশন শোর মধ্য দিয়ে, যেখানে পাঠকনন্দিত হুমায়ূন আহমেদের হিমু চরিত্রটি ফুটিয়ে তোলা হয়, কালজয়ী ধারাবাহিক নাটক ‘কোথাও কেউ নেই’–এর বাকের ভাই-মুনা চরিত্র, এবং সবশেষে আসে সেই বর্ষাকালের কৃষক-কৃষাণীর চরিত্র, যাঁরা কোদাল কাঁধে নিয়ে ও মাথায় পান্তাভাত নিয়ে জমি চাষ করতে মাঠে যান।
আয়োজকরা অনেক ব্যস্ততার মধ্যেও শিশুদের পারফর্ম করার জন্য প্রস্তুত করা, তাদের অভিভাবকদের সময় ও স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের জন্য, বেশ কিছু তরুণ উদ্যমী স্বেচ্ছাসেবক যাঁরা অনুষ্ঠানের অনেক আগে থেকেই নিরলস কাজ করে এসেছেন। সর্বোপরি অনুষ্ঠানটির প্রাণ, দর্শকদের বিশেষ ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে এবং আগামীতে আবার দেখা হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করে অনুষ্ঠানটির সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়।
লেখক: নূর আলম, পোস্টডক্টরাল রিসার্চ ফেলো, ইউনিভার্সিটি অব নিউব্রান্সউইক, কানাডা