নির্বাচনী প্রচারে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করুন

নির্বাচনপ্রতীকী ছবি

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে নির্বাচনকালীন সময়ে সহিংসতা, রক্তপাত এবং উত্তেজনা একটি সাধারণ চিত্র হয়ে উঠেছে। নির্বাচনী প্রচারণায় প্রতিদ্বন্দ্বী দল ও নেতাদের বিরুদ্ধে নেতিবাচক বক্তব্য, কটূক্তি এবং দোষারোপের সংস্কৃতি আমাদের সমাজের স্থিতিশীলতা ও ভ্রাতৃত্ববোধকে ক্ষুণ্ণ করছে। প্রতিপক্ষকে হেয় প্রতিপন্ন করার এই প্রবণতা রাজনৈতিক সচেতনতা নয় বরং এটি সমাজে বিভক্তি, সন্দেহ ও ঘৃণার বীজ বপন করে। এই প্রেক্ষাপটে, দেশের সব রাজনৈতিক দলের নেতাদের প্রতি আমাদের আন্তরিক আহ্বান, আসন্ন জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে বিরোধী দল বা তাদের নেতাদের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচারণা থেকে বিরত থেকে, নিজেদের পরিকল্পনা, অতীতের ভুল এবং সেগুলো সংশোধনের উপায় নিয়ে কথা বলুন।

প্রথমত, প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত আক্রমণ না করে বরং নিজস্ব রাজনৈতিক দর্শন, উন্নয়ন পরিকল্পনা এবং ভবিষ্যতের রূপরেখা তুলে ধরা উচিত। নেতারা যদি বক্তৃতা শুরু করেন নিজের দলের অর্জন, জনগণের জন্য ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা এবং জাতির উন্নয়নে তাদের অবদান দিয়ে, তাহলে সেই ভাষণ আরও প্রেরণাদায়ক এবং গ্রহণযোগ্য হবে। নিজ দলের উন্নয়ন পরিকল্পনা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে প্রতিটি খাতে—শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, পরিবেশ, শিল্প, কর্মসংস্থান—কী ধরনের নতুন উদ্যোগ নেওয়া হবে, তা স্পষ্টভাবে উপস্থাপন করতে হবে। শুধু প্রতিশ্রুতি দিলেই হবে না, সেই প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন পদ্ধতি এবং সময়সীমাও তুলে ধরা উচিত। জনগণ আজ কেবল কথা নয়, দায়বদ্ধতা ও কার্যকারিতাও দেখতে চায়।

একটি পরিণত রাজনৈতিক নেতৃত্বের অন্যতম চিহ্ন হলো নিজেদের অতীত ভুল স্বীকার করে জনগণের কাছে ক্ষমা চাওয়া। এটি দুর্বলতা নয় বরং একটি মহানুভব মানসিকতার প্রকাশ। রাজনৈতিক নেতারা যদি বলেন, ‘আমাদের এই এই সিদ্ধান্ত ভুল ছিল, তার ফলে জনগণের ক্ষতি হয়েছে, আমরা তা উপলব্ধি করেছি এবং ভবিষ্যতে সেসব ভুল যাতে না হয়, সে জন্য নির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিচ্ছি।’ তাহলে জনগণের আস্থা বহুগুণে বেড়ে যাবে।

‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

নেতারা তাদের আগের ব্যর্থতা শুধরে ফেলার জন্য কী পদক্ষেপ নিচ্ছেন, তা স্পষ্টভাবে তুলে ধরতে পারেন। যেমন যদি পূর্ববর্তী আমলে দুর্নীতির অভিযোগ উঠে থাকে, তাহলে এখন কীভাবে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা হবে, তা ব্যাখ্যা করা উচিত। যদি জনসেবা অবহেলিত হয়ে থাকে, তাহলে এখন কোন নতুন কাঠামো গড়ে তোলা হচ্ছে তা জানাতে হবে।

যখন কোনো রাজনৈতিক দল বা প্রার্থী জনগণের সামনে কেবল ঘৃণার রাজনীতি নয় বরং স্বপ্ন, কাজ, এবং সম্ভাবনার কথা বলেন, তখন সেটি মানুষকে অনুপ্রাণিত করে। এই ধরনের ইতিবাচক প্রচার শুধু ভোটারদের কাছে গ্রহণযোগ্য হয় না, বরং গণতন্ত্রের জন্য একটি সুস্থ এবং টেকসই পরিবেশ গড়ে তোলে। উন্নয়নের প্রতিযোগিতা গঠনমূলক ও নৈতিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করে।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি নতুন ধারা তৈরি হোক, যেখানে বক্তৃতা হবে পরিকল্পনার, বিতর্ক হবে নীতিনির্ধারণ নিয়ে এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে উন্নয়নের দৌড়ে। নেতিবাচক প্রচার নয়, গঠনমূলক চিন্তাভাবনা ও আত্মসমালোচনার মধ্য দিয়েই ভবিষ্যতের পথ রচনা হোক। এতে করে শুধু একটি নির্বাচন নয়, একটি জাতির চেতনাই বদলে যাবে। শান্তি, সহনশীলতা এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে গড়ে উঠুক আগামী দিনের বাংলাদেশ।

ইতিবাচক প্রচারে কি হবে—

বিরোধী দলকে আক্রমণ না করে, নিজেদের পরিকল্পনা ও নীতিগুলো উপস্থাপন করলে সামাজিক ও রাজনৈতিক উত্তেজনা কমে আসবে। নেতিবাচক প্রচারণা মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে, যা সহিংসতার জন্ম দেয়। ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করলে সমাজে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে।

নেতিবাচক প্রচারে প্রায়ই সহিংস সংঘর্ষের দিকে নিয়ে যায়, যার ফলে রক্তপাত ও প্রাণহানিও ঘটে। ইতিবাচক প্রচার এই ধরনের সংঘর্ষের সম্ভাবনা হ্রাস করে, যা একটি শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি করতে সহায়তা করে। রাজনৈতিক নেতাদের ইতিবাচক আচরণ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি মডেল হিসেবে কাজ করবে। তারা শিখবে কীভাবে সুস্থ ও গঠনমূলক রাজনৈতিক পরিবেশে অংশগ্রহণ করতে হয়, যা দেশের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে শক্তিশালী করবে। ইতিবাচক প্রচার সমাজে ভ্রাতৃত্ববোধ ও পারস্পরিক শ্রদ্ধা বাড়ায়। নেতিবাচকতা থেকে দূরে থেকে, রাজনৈতিক দলগুলো একে অপরের প্রতি সহনশীলতা প্রদর্শন করতে পারে, যা সামাজিক বন্ধনকে আরও মজবুত করবে।

নির্বাচনী সহিংসতা
প্রতীকী ছবি

যখন রাজনৈতিক নেতারা ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেন, তখন সমাজের সাধারণ মানুষও সেই উদাহরণ অনুসরণ করে। এতে করে সমাজের কাঠামো শক্তিশালী হয় এবং নেতিবাচক বা অশুভ উপাদানগুলো সমাজে স্থান পেতে পারে না।

বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাসে সহিংসতা ও প্রাণহানির ঘটনা উদ্বেগজনক। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের সময় সহিংসতায় প্রায় বহু মানুষ নিহত এবং হাজারেরও বেশি আহত হয়েছিলেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে সহিংসতার ফলে প্রায় ২০ জনের মৃত্যু এবং শতাধিক মানুষ আহত হয়েছিলেন। এই পরিসংখ্যানগুলো আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে নেতিবাচক প্রচার ও রাজনৈতিক উত্তেজনা কীভাবে মানুষের জীবন ও সম্পদের ক্ষতি করতে পারে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতাদের প্রতি আমাদের আন্তরিক আহ্বান-নির্বাচনী প্রচারে বিরোধী দল ও নেতাদের বিরুদ্ধে নেতিবাচক বক্তব্য থেকে বিরত থেকে, নিজেদের পরিকল্পনা, অতীতের ভুলগুলো এবং সেগুলো সংশোধনের উপায় নিয়ে কথা বলুন। এই ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করলে সমাজে শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং ভ্রাতৃত্ববোধ বৃদ্ধি পাবে, যা একটি সুস্থ ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত জরুরি। বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি নতুন ধারা তৈরি হোক, যেখানে বক্তৃতা হবে পরিকল্পনার, বিতর্ক হবে নীতিনির্ধারণ নিয়ে এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে উন্নয়নের দৌড়ে। নেতিবাচক প্রচার নয়, গঠনমূলক চিন্তাভাবনা ও আত্মসমালোচনার মধ্য দিয়েই ভবিষ্যতের পথ রচনা হোক। এতে করে শুধু একটি নির্বাচন নয়, একটি জাতির চেতনাই বদলে যাবে। শান্তি, সহনশীলতা এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে গড়ে উঠুক আগামী দিনের বাংলাদেশ।

এই সুযোগে আমি দেশের সকল রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতৃত্বের প্রতি একটি বিনীত অনুরোধ জানাই, আপনারা অনুগ্রহ করে এই বার্তাটি দলীয় কাঠামোর সর্বস্তরে পৌঁছে দিন এবং তা কঠোরভাবে অনুসরণ করার নির্দেশনা দিন। এই একটি পদক্ষেপের মাধ্যমে আমাদের দেশ সুরক্ষিত হতে পারে, বহু প্রাণ রক্ষা পেতে পারে। বাংলাদেশ আর কোনো অস্থিরতা কিংবা বিশৃঙ্খলার সামর্থ্য রাখে না। এটা কি খুব বড় কোনো অনুরোধ? আমি বিশ্বাস করি, আপনারা এ আহ্বানে সাড়া দেবে।

*লেখক: একেএম আহসান উল্লাহ, শিক্ষক, ইউনিভারসিটি অব ব্রুনেই দারুস সালাম, ব্রুনেই [email protected]