নিরানন্দময় টাইপিং

এসএসসি পরীক্ষার তিন মাস পর রেজাল্ট বের হয়। আমার এসএসসি পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর বড়দা বললেন, ‘এ সময়ে বসে না থেকে টাইপং শিখ।’ ১ নম্বর ডিআইটি বিল্ডিংয়ের দোতলায় টাইপ শেখার প্রতিষ্ঠান আল-হেলাল। চাকরিপ্রত্যাশী অনেকেই তখন অবসরে টাইপ শিখতেন। টাইপ জানা থাকলে সেটি অতিরিক্ত যোগ্যতা হিসেবে বিবেচিত হতো। অনেকে শর্টহ্যান্ডও শিখতেন।

ভর্তির পর প্রশিক্ষণের পর্ব, তিন মাসের কোর্স। প্রতিষ্ঠানটির মালিকই প্রশিক্ষক, তিনি আমাকে একটি টাইপরাইটারের সামনে টুলে বসতে বললেন। প্রথমে প্রথম পাঠ দেখিয়ে দিলেন দুই হাতের আঙুল পরিচালনা করে। একটি চিকন বই দিয়ে বললেন, বই থেকে আঙুল সঞ্চালনের সব পাঠ মুখস্থ করে নিতে হবে। পুরোনো লক্কড়ঝক্কড় মার্কা একটি টাইপরাইটার আমার দুই হাতের ছন্দহীন আঙুলের চাপে ককিয়ে ওঠে। প্রশিক্ষককে জানালে তিনি এসে রিবন টানাটানি করে আঙুলে কালো কালি লেপটে টাইপরাইটারটিকে আঙুলের চাপ সহনের উপযোগী করে তোলেন।

বিকেলে বাসায় ফেরার পথে দুই হাতের আঙুলগুলো বাতাসে অহেতুক চাপ দিয়ে অনুশীলনের ব্যর্থ চেষ্টা করে। বাতাস বিরক্ত না হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে হাসে। ভগ্নিপতি ঢাকায় থাকেন। দেখা হলে বললাম, ‘দুলাভাই, টাইপ শেখার জন্য ভর্তি হয়েছি।’ হেসে বললেন, ‘লেখাপড়া শিখে তুই কি টাইপিস্ট হবি, না কেরানিগিরি করবি?’ দারুণ ভাবনার কথা, টাইপ শিখে কী করব? ভাতঘুমের সময় দুপুররোদে খানপুরের বাসা থেকে ডিআইটি হেঁটে যাওয়া ও পড়ন্ত বিকেলে বাসায় ফিরে আসাটা অনেক বিরক্তিকর। মনে হলো, সত্যিই টাইপ শেখাটা বিরাট নিরানন্দময়। সময়ের বিশাল অপচয়! তার চেয়ে বই পড়ার নেশাটাই ঢের আনন্দদায়ক। ফিরে যাই নিজের ভুবনে, সুধীজন পাঠাগারে।

আব্বার ছোট্ট একটি পোর্টেবল টাইপরাইটার ছিল, আজও আছে মনে হয়। বছর শেষে বন্দুক, পিস্তলের লাইন্সেস নবায়নের জন্য আব্বা চালান টাইপ করে টাকাসহ চার কপি চালান আমাকে দিয়ে বলতেন, ‘এই নে, যা ব্যাংকে গিয়ে ফি জমা দিয়ে আয়।’ মেজদা ও দুলাভাই, দুজনেই আব্বার টাইপরাইটারে ঝড় তুলতেন। তাঁদের মতো ঝড় ডেকে আনতে না পারলেও দীর্ঘদিন আমি আব্বার টাইপরাইটারে এক আঙুলে অসংখ্য ব্যবসায়িক চিঠি টাইপ করেছি। জীবনের শুরুতে সে এক মধ্যদুপুরের না বলা গল্প।

নারায়ণগঞ্জের কোর্ট মসজিদ প্রাঙ্গণে প্রফেশনাল টাইপিস্টরা বসতেন। হারুন ভাই ইংরেজি টাইপ করতেন এবং তাঁর পাশে আরেক ভদ্রলোক বাংলা টাইপ করতেন। তাঁদের কাছ থেকে আমার কাজগুলো করিয়ে নিতাম। এ ছাড়া আরও দু-একজনের কাছ থেকেও বাংলা টাইপ করেছি। তাঁদের কাছ থেকে বাংলা টাইপ করতে গিয়ে একটি কঠিন সত্য হৃদয়ঙ্গম হলো। সবাই বাংলা টাইপের প্রতিটি লাইনে প্রচুর ভুল করেন।

টাইপে ভুল সংশোধনের কথা বললে রেগে যেতেন, অসন্তুষ্ট হতেন। বলতেন, ‘আমরা এত বছর ধরে টাইপ করছি, এটাই তো আমাদের অভিজ্ঞতা। কেউ কিছুই বলে না। টাইপ করে দিলে টাকা দিয়ে চলে যায়। আপনার কাছ থেকে এখন নতুন করে সব শিখতে হবে।’ এসব কি ভালো লাগে, বলেন? এভাবে তো কাজ করা যায় না! বারবার টাইপের কাজ সংশোধন করলে তাঁদের কাজ বাধাপ্রাপ্ত হয় এবং সময় বেশি ক্ষেপণ হয়; অর্থাৎ তাঁর আয় কমে যাচ্ছে। এর পর থেকে আমি নির্দিষ্ট একজনের কাছে টাইপ করিয়েছি। প্রথমেই তাঁকে জানিয়েছি, ‘আপনার পছন্দ অনুযায়ী টাইপ করলে চলবে না। আমার পছন্দ অনুযায়ী নির্ভুল বাংলায় টাইপ করতে হবে। আপনি সময় বেশি ব্যয় করার জন্য আপনার ধার্যকৃত পারিশ্রমিকই আমি দেব।’ ‘ভয় নাই, ওরে ভয় নাই।’ এরপর থেকে আমাকে দেখলেই টাইপিস্ট ভদ্রলোক ঠোঁট চেপে হাসতেন, নড়েচড়ে বসতেন।

সুধীজন পাঠাগারে আল আমিন ভাই কর্মাধ্যক্ষ, আমি গ্রন্থাগারিক। আল আমিন ভাইকে বললাম, টাইপিস্টদের বাংলা বানান শেখার জন্য পাঠাগারে দুই-তিন ঘণ্টার একটি কর্মশালা করা যেতে পারে। দুই-তিন ঘণ্টা সময় ব্যয় করার জন্য তাঁদের কিছু টাকা দিতে হবে। কর্মশালায় অংশগ্রহণ করলে কর্মস্থলে অনুপস্থিতির কারণে তাঁদের আয় কমে যাবে। তাঁরা আসতে চাইবেন না। টাকা দিলে অংশগ্রহণকারীরা উৎসাহিত হবেন, সেই সঙ্গে রিফ্রেশমেন্টের ব্যবস্থাও থাকবে। আল আমিন ভাই স্পনসর সংগ্রহ করে কর্মশালাটি বাস্তবায়িত করেছিলেন। বাংলা টাইপিস্ট ও কম্পিউটার কম্পোজারদের কাছে গিয়ে সুধীজন পাঠাগারের চিঠি দিয়ে আমি অনুরোধ জানিয়েছিলাম। সবার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে কর্মশালাটি সফল হয়েছিল।