স্বচ্ছ বাতায়ন

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

দীর্ঘদিন স্বদেশের তরে রণ সাজানোর বিশেষ উপলক্ষ বের করা একরকম দুষ্কর হয়ে পড়েছে। অক্ষি পলকে কালের নিদারুণ পরিক্রমায় এত দ্রুত যে বছরের অঙ্ক দশের গোড়ায় কড়া নাড়ানোর উপক্রম হয়েছে, তা যেন নিজের কাছে ভয়ানক অদ্ভুত লাগছে। বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা, বৈচিত্র্যময় করোনাভাইরাসে জীবন থমকে যাওয়া, অন্ন–বস্ত্র সংকুলানের ব্যস্ততা ইত্যাদি নানান জটিলতায় এতগুলো বছর কীভাবে যে গেছে, তার হিসাব যেন মিলতেই চায় না। প্রিয় মাতৃভূমি, যার প্রতিচ্ছবি আঁকি প্রতিমুহূর্তে হৃদয়ের ক্যানভাসে স্বপ্নের তুলির অমলিন আঁচড়ে। এ যে এমন এক ছবি যার সূচনা হয়েছে বটে, কিন্তু উপসংহারের নেই কোনো আকুতি। উচ্ছন্নে যাওয়া দিনগুলোর অমলিন স্মৃতি, ক্ষণে ক্ষণেই অক্ষি দর্পণে দোলা দিয়ে ওঠে। প্রাণবন্ত খেলার মাঠ, নিস্তব্ধ নদীর ঘাট, ঝাঁকড়ালো বটবৃক্ষের পাদদেশে প্রশান্তির নিশ্বাস কিংবা বিলম্বিত সাঁঝে গৃহে ফেরা বালকের মায়ের অগ্নিমূর্তি দীর্ঘশ্বাস। এসব চিত্রই হৃদয় বীণায় ঝংকার তুলে আনমনা করে তোলে। মায়ের রাগের অন্তরালের অনুরাগ, বিশ্বব্রমাণ্ডের সবকিছুকেই তুচ্ছ করে অনুভূতির স্মৃতির অধ্যায়কে বারবার নবায়ন করে ফেলে। যার স্নেহের প্রসারিত হস্তের মূর্ছনা মুহূর্তেই দূরীভূত করে সমস্ত যাতনা। মায়ের  অক্ষিদ্বয়ের মায়ার বাঁধন, অপসৃত করে বেদনার অলিখিত প্রস্রবণ। স্বদেশের জন্যে নির্মিত দূর্নিবার আবেদন এবার শতসহস্র ব্যস্ততাকে জলে ডুবিয়ে দিয়েছে। ডিসেম্বর মাস, ক্রিসমাস উপলক্ষে জার্মানিতে কর্মচাপ তেমন উপলব্ধি হয় না, অধিকন্তু বাৎসরিক ছুটির সম্পূর্ণটাই খরচ না হওয়ায়, নিজের অগোচরেই কল্পিত ভ্যাকেশন সূচি নির্মিত হয়ে গেছে।

স্বদেশে পরিভ্রমণের আকাঙ্ক্ষা খানিকটা বিলম্বে উদিত হওয়ার কারণে, বিমানের টিকিটের দামে একরকম আগুন লেগে গেছে। টিকিটের দরের গতিবিধি উপলব্ধি করে নয়নদ্বয় প্রায় ছানাবড়া হয়ে গেল। আকাশতরির টিকিটমূল্যে যেরূপ ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে, তাতে তাকে আইপিএল কিংবা বিপিএল এর ক্রীড়াবিদ নিলামের চেয়েও ঢের গতিশীল তুলনা করলেও কম যাইবে না। যা–ই হোক, স্থানীয় শহর স্টুটগার্ট বিমানবন্দর কর্তৃক টিকিট ক্রয়ে তেমন একটা সুবিধা করতে না পারায়, ২০০ কিলোমিটার অধিক তফাৎ রেখে ফ্রাঙ্কফুর্ট বিমানবন্দর হতে যাত্রা রচনা করার নিমিত্তে টিকেটে ক্রয় করার সংকল্প পাকা করলাম। হপ্তা ব্যবধান রেখে স্বদেশে যাত্রার উদ্দেশ্যে পুরোদমে প্রস্তুত হওয়ার উপলক্ষ স্থির হলো। যাত্রার ফর্দ রচিত হয়েছে, ফ্রাঙ্কফুর্ট-দুবাই-ঢাকা। দুবাই ইন্টারন্যাশনাল বিমানবন্দর আমার পূর্বপরিচিত। কেননা বিভিন্ন গন্তব্যে যাত্রার লক্ষ্যে দুবাইকেই মধ্যম পন্থা অবলম্বনের দরুণ, তার সহিত কিঞ্চিৎ মিতালি রচিত হয়েছে। ভারি চমৎকার নান্দনিকতায় পরিপাটি বিমানবন্দরখানা মানুষের অক্ষিজোড়া বরাবরই আকৃষ্ট করে রাখে। বিলাসিতার সুস্পষ্ট ছাপ ও আভিজাত্যের ছোঁয়া পরিলক্ষিত হওয়ায়, মানুষ তাতে যতটুকু সময়ই অতিবাহিত করার সুযোগ পায় না কেন, সেলফির জোয়ারে নিজেকে না ভাসিয়ে তর সয় না।

অলংকরণ: আরাফাত করিম

ট্রানজিট টাইম তিন ঘণ্টা। কোনো কর্মচাপ উপলব্ধি না করে, ওয়েটিং রুমের সর্বশেষ প্রান্তে একাকী নয়নদ্বয়ের কপাট নামিয়ে প্রশান্তি অনুভবের প্রয়াসে বিশ্রাম জ্ঞাপন করতে থাকলাম। স্থান ও কাল বিবেচনায় জার্মান ও ইংলিশ ভাষায় বিগত দুই হালি বছর অধিক ব্যবহৃত হওয়ায়, ওয়েটিং রুমে নানা আঞ্চলিক বাংলা ভাষার উত্তাল আলাপন একরকম কাব্যপ্রীতির আবির্ভাব ঘটাল। পক্ষিকুলের ন্যায় কিচিরমিচির ধ্বনির মধুময় সংলাপ সবকিছুকেই আলোড়িত করে রাখল। এই যাত্রায় খানিকটা ভিন্নমাত্রা জুগিয়েছেন বাংলাদেশের সুপরিচিত তিনজন নাট্য ও চলচিত্র অভিনেতা। আমাদের ফ্লাইটের যাত্রীও তাঁরা। তাঁদের নাম চিনবেন না এমন বাঙালি আবিষ্কার করা প্রায় জাদুঘরের আসবাবের মতো দুষ্প্রাপ্য। অভিনেতারা সামান্যতম দূরুত্ব বজায় রেখে খানিকটা আড়াল করে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করলেন। কেননা ভক্তকুলের সেলফির চাপে তাঁদের খ্যাতির জোয়ারে ভাটা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাকে তো আর খাটো করে দেখা যায় না। তবে আক্ষেপের বিষয় হলো, ট্রানজিট টাইম আড়াই ঘণ্টার অধিক গড়িয়ে যাওয়ার পরও, কোন ভক্তবৃন্দ তাঁদের প্রতি তেমন আগ্রহ প্রকাশ করলেন না। পরিশেষে অভিনেতারা নিজ ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করে, নিজস্ব আরামের গদিকে হারাম করে, জনসমক্ষে পায়চারি করতে থাকলেন। অপেক্ষমাণ বাঙালি ভ্রাতা ও ভগ্নিগণ তাঁদের অক্ষিজোড়া ললাটে তুলে, কেবল একদৃষ্টে নয়নদ্বয় তাঁদের সমীপে স্থির করে রাখলেন। তাঁর বিপরীতে একজন প্রাণীও তাঁদের সহিত একটি বারের জন্যও ক্যামেরার ফ্ল্যাশ জ্বালালেন না। জনপ্রিয়তায় খরা চলছে কি না, তা উপলব্ধি করেই বুঝি, অভিনেতারা অভিমান ছলে মনঃক্ষুণ্ন হয়ে, জনমানবময় স্থান কর্তৃক জননীরব স্থানে পুনরায় গমনে একপ্রকার বাধ্যই হলেন।

পাসপোর্ট ও বোর্ডিং পাস তল্লাশিপূর্বক খাতির যত্ন করেই বিমান কর্তৃপক্ষ বিমানে প্রবেশের অনুমতি প্রদান করলেন। সিট নাম্বার ৩১–ডি, তাই অক্ষিদ্বয়কে বড় সচেতন রেখে গভীর একাগ্রতার সহিত কাঙ্ক্ষিত সিটের অনুসন্ধানে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। তবে বেদনার বিষয় হলো, আমার সিটের নিকটেই একটা স্বল্প জটলা সৃষ্টি হয়ে গেছে। নিজের সিটে নিজেই অতিথি কিনা! তিন–চারজন তো সেই সারির সিট ছাড়া অন্য কোথাও বসবেন না বলে পণ করে ফেলছেন। আর তাদের হাঁকডাক খানিকটা দূর হতেই অবলোকন করে মনে একটা কিঞ্চিৎ দাগ কেটে গেল। ব্যাপারখানা কী!! তা অনুসন্ধানে সামান্য এগিয়ে আসতেই সমস্ত মামলা জলের ন্যায় পরিষ্কার হয়ে গেল। ৩১–এফ সিটে একজন ভয়ানক চমৎকার তনুশ্রী আসনে উপবিষ্ট আছেন। দৃষ্টি দর্শনে ইউরোপের অধিবাসীই বিবেচিত হল। সোনালি কেশ আর আসমানি নয়নযুগলকৃত মুখশ্রীতে সূর্যের তির্যক কিরণ স্বচ্ছ বাতায়ন ভেদ করে ঠিকরে পড়তেই উজ্জ্বলতার প্রদীপ জ্বলে উঠেছে। ৩১–ডি, ৩১–ই সিট দুটিতে দুজন মাতৃভূমির সন্তান খুব গর্ব করে আসন গেড়েছেন। অনুগ্রহপূর্বক আমার সিট নাম্বার দেখিয়ে সম্মানের সহিত দখলকৃত আসনখানা উদ্ধার করতে তেমন একটা বেগ পেতে হয় নি। পাশের সিট ৩১–ই এর সম্মানিত যাত্রীকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও আসন ত্যাগ করতে হলো। কেননা তার প্রকৃত আসন অন্যত্র সুবিন্যস্ত রয়েছে। সবশেষ ৩১–ডি ও ৩১–এফ এর মধ্যস্থ ৩১–ই সিটটা ফাঁকাই রইল। এইভাবে মিনিট দশেক অতিবাহিত হতেই আনুমানিক দুই কুড়ির ঊর্ধ্ব বয়সী বাঙালি বাবু হন্তদন্ত করে, বিনা বাক্য খরচ করে, প্রায় আমার ওপর দিয়েই  ৩১–ই, ফাঁকা সিটে আসন চেপে অত্যন্ত নুরানি হাসিতে মত্ত হয়ে পড়লেন। তার নুরানি হাসি অবলোকন করে মনে হল যে তার জীবন আজকের জন্য ষোলো আনা সার্থক।

আমি: আচ্ছা আঙ্কেল, একটু বলেও তো বসতে পারতেন, একরকম ওপর দিয়ে এসে বসে পড়লেন?

কথিত  আঙ্কেল: আরে, ভাল একটা সিট, বসে পড়লাম।

আমি: ও, আপনার সিট নাম্বার কত?

কথিত আঙ্কেল: এই তো দেখেন! ৪১–ই

আমি: আঙ্কেল, এটা তো ৩১–ই

কথিত  আঙ্কেল: ৩১–ই আর ৪১–ই তো একই, শুধু ৩ আর ৪, এই তো পার্থক্য। তাই না?

আমি: হুঁ, তাই। আপনার সিট আরও ১০ সারি পেছনে।

কথিত  আঙ্কেল: আরে চলবে, সব একই।

আমি: সিট পরিবর্তন করলে জরিমানা হতে পারে।

কথিত  আঙ্কেল: ও, তো আগে বলবেন না!!!

আমি: আপনি তো বলারই সুযোগ দিচ্ছেন না।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

যা–ই হোক উনি অবিলম্বে প্রস্থানের ডঙ্কা বাজানোর দরুণ, ৩১–ই আসনখানা পুনরায় শূন্য অবস্থায় রইল। ৩১–এফ সিটের তনুশ্রী এখন মিট মিট হাসছেন আর বারবার আমার প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কিছু একটা বলার অজুহাত খুঁজতেছেন।

আমি: আপনি কি কিছু বলতে চান? (Do you want to say something?)

তনুশ্রী: হুঁ। কী ঘটেছে এখানে? (What’s happened here?)

আমি: কিছুই না। এই সিট নম্বরে একটু গোলমাল হয়েছে।

তনুশ্রী: তো সবার জন্যই গোলমাল হয়েছে? (মিট মিট হাসছে)

আমি: দেখুন, আপনার স্বচ্ছ বাতায়ন কর্তৃক যেহেতু অধিক সূর্যালোকের সমাগম আবির্ভূত হয়েছে, তাই একটু বাড়তি উষ্ণতার প্রয়াসে আপনার পাশের আসনের চাহিদা খানিকটা বর্ধিতই মনে হয়। (মিট মিট হাসছি)

তনুশ্রী: তাই নাকি!! আপনার মন্তব্যের জন্য বিশেষ ধন্যবাদ।

আমি যে তাকে ভূগোল বোঝানোর চেষ্টা করেছি, তা তিনি খুব নিখুঁতভাবেই অনুধাবন করতে পেরেছেন। তাই তিনি নিজেকে সংবরণ করতে ব্যর্থ হয়ে, মিট মিট হাসি অট্টহাসিতে রূপান্তরিত হলো।

তনুশ্রী: আপনার সিট নাম্বারে তো আবার গোলমাল হয়নি?

আমি: সম্ববত না। ৩১–ডি আমার সিট, ৩১–ই ফাঁকা আর ৩১–এফ আপনার সিট।

তনুশ্রী: হুঁ, ঠিক ঠিক।

আমি: দেখুন, আমার চার চোখের অন্তরালে ত্রুটিবিচ্যুতির সম্বাবনা নিতান্তই খাটো থাকে।

তনুশ্রী: চার চোখ কীভাবে?

আমি: দুই চোখ বিধাতার করুণার দান, আর বাকি দুই চোখ চশমাদাতার পরীক্ষিত উপাদান।

ও, ডেট মিন্স আই গ্লাস বলে খানিকটা উঁচু স্বরে হাসতে লাগলেন। তার হাসির সুর মূর্ছনা স্বল্প দূরত্বে প্রবাহিত হওয়ায়, আশপাশের বাঙালি ভ্রাতা ও ভ্রাতৃদের কৌতূহলী দৃষ্টি আমার প্রতি তির্যকভাবে নিপতিত হওয়ার, তা আমার মনঃবৃত্তেও হাসির খোরাকে পরিণত হলো। অল্প কালের ব্যবধানে উড়ালতরিটি ভূমির সহিত হাজার হাজার ফিট পার্থক্য গড়ে আসমানপানে বজ্রবেগে ধাবিত হল। শুভ্র মেঘমালাকে ছেদ করে, চারপাশের সমস্ত কিছুকে ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র ও তুচ্ছ জ্ঞান করে, সীমাহীন উচ্চতায় নিজের অবস্থান প্রতিষ্ঠা করল। ইতিমধ্যেই বাঙালি ভ্রাতা ও ভ্রাতৃ মহোদয়গণ তাদের অন্নব্যঞ্জনের একটু সাময়িক সুরাহের নিমিত্তে বিমানবালাকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছে। বিমানবালাও কম যায় না, সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছে যে ঘণ্টা দেড়েক উদরে পাথর বেঁধে অপক্ষাপূর্বক সুস্বাদু খোরাকের দেখা মিলবে। যথাবিধি ঘণ্টা দেড়েক কাল স্রোতবেগে অতিক্রান্ত হয়ে গেল। অন্নব্যঞ্জনা থরে থরে বিন্যস্ত করা ও তার পরিবেশনেও চক্ষুদ্বয়ে কোনোরূপ ত্রুটি পরিলক্ষিত হচ্ছে না। তবে  বিপত্তি ঘটেছে, অন্নপরবর্তী পানীয় পরিবেশনে। টাটকা মুসলিম সন্তানদের পানীয় নির্বাচনের আগ্রহ অবলোকন করে নয়নজোড়া মুহূর্তেই চড়কগাছ বনে গেল। একের পর এক লাল পানীয় সরবরাহের আবেদন আসছে। বিমানবালাও ভ্রুযুগলকে কিঞ্চিৎ সংকুচিত করে ভিন্ন অনুভূতির সাড়া জাগালেন। শুনে এসেছে যে, মুসলিমরা লাল পানিকে বিষপান ভেবে লক্ষ হস্ত তফাৎ বজায় থাকে। কিন্তু আজকে চিত্রিত হয়েছে উল্টো চিত্র।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

যা–ই হোক আপ্যায়নের পর্ব চুকিয়ে, স্বল্প বিশ্রামের নিমিত্তে প্রস্তুতি গ্রহণ করলাম। ল্যাপটপ, ট্যাব, জ্যাকেট ইত্যাদি প্রয়োজনীয় সামগ্রী খানিটা যত্ন করে, পার্শ্বস্থ শূন্য আসনে নির্ভয়ে স্থান প্রদান করলাম। নয়নদ্বয় রুদ্ধ মারফত, ঘুমের রাজ্যে প্রবেশের লক্ষ্যে অতীব চেষ্টা তদবিরের ত্রুটি করলাম না। মিনিট দশের ব্যবধানে তন্দ্রাচ্ছন হয়ে সামান্য অবচেতন অনুভব হল। তবে আমরা সিটের পশ্চাৎ হতে অবিরাম ধারার ঠকঠক শব্দ কর্ণকুহরে আঘাত হেনে, তন্দ্রার ছন্দে পতন ঘটিয়ে একবারে বিহ্বল করে ফেলল। ফলে ঘুমের রাজ্যে দ্বার নিমেষেই রুদ্ধ হতেই নয়নতারা স্পষ্ট হয়ে গেল।

আমি: ভাই, আপনার কোন প্রবলেম হয়েছে?

ভ্রাতা: হুঁ। খুব গরম লাগছে। দেখেন না জানালাটা খুলছেই না !!!

তার কথা শুনে হাসব না কাঁদব তারই মধ্যকার গোলকধাঁধায় আবদ্ধ হয়ে গেলাম। মুহূর্তেই জবানের শব্দভান্ডার শূন্য হয়ে গেল। কীরূপ বাক্য প্রয়োগ করা যথার্থ হবে, তা ভেবেই নিথর হয়ে গেলাম।

আমি: ভাই, বিমানে তো জানালা সিল্ড করা, এটা খুলবে না।

ভ্রাতা: আরে ভাই আপনি জানেন না। খোলার তো একটা ব্যবস্তা আছেই। এতো দামি জিনিস!

আমি: ভাই, জানালা খোলা যায় না।

ভ্রাতা: এতো টাকা দিয়ে টিকিট কাটলাম। জানালা আবার খুলবে না!

আমি: আপনার মাথার ওপর তো কুলিং সিস্টেম আছে, তা ব্যবহার করতে পারেন।

ভ্রাতা: ও, তাই নাকি?

আমি: জি।

ভ্রাতা: এইটা! ধুর, এতো ছোট জিনিস দিয়ে কি কিছু হয়? বড় ফ্যান নাই?

তিনি স্বচ্ছ বাতায়নের আলো প্রতিরোধক কপাটখানা নিয়মিত ধারায় উত্থান-পতনে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। হাবভাবের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে মনে হলো যে তিনি ইঞ্জিনিয়ারিং বিদ্যায় বিশেষ পারদর্শিতা দেখিয়ে, একটি অতিরিক্ত জানালা আবিষ্কার করে তাতে নির্মল বায়ু সরবরাহে ধন্য হবেন। ইতিমধ্যে দুজন বিমানবালা যথাস্থানে উপস্থিতি প্রকাশ করলেন। তাঁর বিনয়ের সহিত স্বচ্ছ বাতায়ন কোনোভাবেই অবমুক্ত করার ব্যবস্থা না থাকার অপারগতা পেশ করলেন। তার ওপরের কুলিং সিস্টেম চালু করে, সামান্য ধৈর্য ধারণে জন্য হাত জোড় করে অনুরোধ জ্ঞাপন করলেন। আর পরবর্তীতে অন্য কোনো সমস্যায় পতিত হবার সংশয় থাকেল, তাঁদের স্মরণ করে ধন্য হবার আর্জি পেশ করেলন। সত্যিই কালের পরিক্রমায় নানাবিধ বৈচিত্র্যময় স্মৃতি হৃদয়ের মণিকোঠায় চিরতরে স্থান কুড়িয়ে লয়। আজকের এই অতুলনীয় ভ্রমণস্মৃতি হৃদয়ের আঙিনায় বর্ণিল তুলির মায়াবী আঁচড়ে নির্মিত অসামান্য আল্পনা হয়ে অনন্তকাল ফুটে থাকবে।

  • লেখক: আমিমুল হোসাইন, সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, স্টুটগার্ট, জার্মানি 

  • দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]