নেদারল্যান্ডসে ফ্যাশনবিপ্লব: উন্নত বস্ত্র, ন্যায্য মজুরি
১৬ মে নেদারল্যান্ডসের ইনশেড শহরের স্যাক্সিয়ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাশন অ্যান্ড টেক্সটাইল টেকনোলজির শিক্ষার্থী ও শিক্ষকেরা ফ্যাশনবিপ্লবে অংশগ্রহণ করেন। এর সূত্রপাত ২০১৩ সালে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া রানা প্লাজা ঘটনা থেকে। রানা প্লাজায় প্রায় ১২ শতাধিক পোশাককর্মী ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন। আহত হয়েছিলেন প্রায় আড়াই হাজার পোশাককর্মী। সেই মর্মান্তিক ঘটনা আজও বিশ্বব্যাপী জনগণকে আতঙ্কিত করে। সে ভয়াবহ ঘটনার পর থেকে বাংলাদেশের পোশাকশিল্পে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। কিন্তু পোশাককর্মীদের সীমিত বেতনে বর্তমান বাজারে মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
পোশাককর্মীদের সুস্বাস্থ্য, মানবাধিকার নিশ্চিত, ন্যায্য মজুরির দাবি ও শিশুশ্রম বন্ধের দাবিতে পুরো ইউরোপে প্রায় ১০ বছর ধরে চলছে বিভিন্ন আন্দোলন ও সচেতনতামূলক আলোচনা সভা। এর মূল স্লোগান, ‘উন্নত বস্ত্র, ন্যায্য মজুরি’। ফ্যাশনবিল্পব একটি পরিষ্কার, নিরাপদ, ন্যায্য, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক ফ্যাশন শিল্পের জন্য প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে; যেন বিশ্বব্যাপী ফ্যাশন শিল্পে পরিবেশ সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধার করে বৃদ্ধি ও লাভের চেয়ে মানুষকে বেশি মূল্য দেওয়া হয়।
পোশাককর্মীদের কম মজুরি ও দারিদ্রতার সমস্যাটি আমাদের ফ্যাশন এবং টেক্সটাইল প্রশিক্ষণে, গণমাধ্যমে ও বাড়িতে খাবার টেবিলে বহুবার উত্থাপিত হয়েছে। বিশ্বজুড়ে লাখো মানুষ টেক্সটাইল, পোশাক ও জুতা উৎপাদনে কাজ করেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ কর্মী তাঁদের মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য যথেষ্ট বেতন পান না। ফ্যাশনবিপ্লব ইউরোপে ১০ লাখ স্বাক্ষর সংগ্রহ করার জন্য একটি পিটিশন শুরু করেছে, যেটি সম্পূর্ণ হলে পোশাকশিল্পে কর্মরত জনগণের ন্যায্য মজুরি দেওয়ার জন্য একটি নতুন আইন প্রণয়ন করা হবে, যা ফ্যাশন কোম্পানিগুলোকে পোশাককর্মীদের জীবনযাত্রার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য যথাযথ পারিশ্রমিক দিতে বাধ্য করবে। যাঁরা আমাদের জামাকাপড় তৈরি করেন, তাঁদের বেশির ভাগই নারী। তাঁরা বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনের চেয়ে কম উপার্জন করেন। বর্তমান মজুরি মৌলিক চাহিদা পূরণ করে ভালোভাবে বসবাসের উপযোগী নয়। পোশাকশিল্পে কর্মরত শ্রমিকেরা দারিদ্রতার মধ্যে আটকা পড়ে থাকেন, যখন বড় ফ্যাশন সংস্থাগুলো তাদের কঠোর পরিশ্রম থেকে লাভ করতে থাকে। এটি একটি অন্যায় ও শোষণমূলক ব্যবস্থা। কোভিড-১৯ মহামারি শ্রমিকদের জন্য মজুরি নিরাপত্তাহীনতাকে আরও গভীর করেছে। যাঁরা আমাদের পোশাক তৈরি করেন, শ্রমিকদের কোনো সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী নেই। তাঁরা খাদ্য, স্বাস্থ্যসেবা ও বাসস্থানের জন্য অর্থ প্রদানের জন্য সংগ্রাম করেন। এ কারণেই ফ্যাশন সাপ্লাই চেইনে কর্মরত সবার বসবাসের যোগ্য মজুরির জন্য ইউরোপীয় নাগরিকদের উদ্যোগ, ‘গুড ক্লদস ফেয়ার পে’ ক্যাম্পেইন এমন আইনের দাবি করছে, যা সারা বিশ্বের টেক্সটাইল ও পোশাক শ্রমিকদের ন্যায্য বেতন পেতে সহায়তা করবে। ইসিআই-ইউরোপিয়ান সিটিজেনস ইনিশিয়েটিভ তাই এ উদ্যোগটি নিয়েছে। এখন পর্যন্ত ১ লাখ ৮০ হাজার ২২৬ জন (২৫ মে, বৃহস্পতিবার বিকেল পর্যন্ত) পিটিশনটিতে স্বাক্ষর করেছেন। যত দিন না এটি ১০ লাখ ইউরোপিয়ান নাগরিক স্বাক্ষর করবেন, তত দিন ফ্যাশন বিপ্লবের ক্যাম্পেইন পুরো ইউরোপে অব্যাহত থাকবে।
পশ্চিমা দেশের পোশাক মূলত এশিয়ার দেশগুলোতেই উৎপাদিত হয়। যেখানকার মানুষের জীবনযাত্রার মান পশ্চিমা বিশ্বের থেকে নিম্নতর। এখানকার জনগণকে সচেতন করার জন্য পরিবেশ ও সামাজিক স্তর উভয় ক্ষেত্রেই একটি টেকসই পোশাকশিল্পের জন্য নানা প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। প্রশিক্ষণ কর্মসূচি হিসেবে কখনো কখনো আমাদের উপলব্ধি করার জন্য কংক্রিট কর্মের প্রয়োজন হয়। যার ফলাফল ‘গুড ক্লদস ফেয়ার পে’ ক্যাম্পেইন। এটি বিশেষভাবে কম মজুরি, যেমন নারী ও অভিবাসী শ্রমিকদের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত ঝুঁকিপূর্ণ গোষ্ঠীগুলোকে চিহ্নিত করার জন্য ইউরোপিয়ান ব্র্যান্ডগুলোর ওপর বিশেষ জোর দেবে। এ প্রস্তাবে কোম্পানির মূল্য নির্ধারণ, খরচ ও সামগ্রিক ক্রয় পদ্ধতির ব্যবস্থা রয়েছে, যাতে শ্রমিকদের তাঁদের মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য অতিরিক্ত কর্মঘণ্টার (ওভারটাইম) ওপর নির্ভর করতে না হয়। এ আইনটি বিশ্বব্যাপী পোশাক শ্রমিকদের জন্য ইউরোপিয়ান স্তরে প্রথম মজুরি আইন হবে। এটি ইউরোপের আইন ও প্রবিধানগুলো নিশ্চিত করবে, যেন সারা বিশ্বের কোম্পানিগুলো তাদের সাপ্লাই চেইনের শ্রমিকদের ন্যায্য অর্থ প্রদান নিশ্চিত করতে ভূমিকা পালন করে। ইউরোপীয় কমিশন বাধ্যতামূলক মানবাধিকার ও পরিবেশগত কারণে আইন প্রবর্তন করার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছে, যা কোম্পানিগুলোকে তাদের সরবরাহ শৃঙ্খলে পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করবে। ইসিআই এ ছাড়াও প্রস্তাবিত ইউরোপিয়ান ন্যূনতম মজুরি নির্দেশিকা, ওইসিডি (OECD) ডিউ ডিলিজেন্স গাইডেনস, আইএলও এমএনই (ILO MNE) ঘোষণা এবং টেকসই টেক্সটাইলের জন্য আসন্ন ইউরোপিয়ান কৌশলের মতো অন্যান্য নীতি উপকরণ তৈরি করেছে।
পোশাক খাতে এখন পর্যন্ত মজুরি নিয়ে এটাই হবে একক বৃহত্তম ইউরোপিয়ান প্রচার। সফল হলে আইনটি একটি ন্যায্য ফ্যাশন ব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে যুগান্তকারী পদক্ষেপ হবে, যেখানে ব্র্যান্ডগুলো তাদের পোশাক তৈরির সঙ্গে যুক্ত কর্মীদের জন্য দায়বদ্ধ থাকবে। ফ্যাশন সাপ্লাই চেইনের লাখো কর্মীকে সুরক্ষিত করার জন্য এই ধরনের সক্রিয় নীতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং ইউরোপ ইতিবাচক পরিবর্তনের পথ দেখাতে পারে।
*লেখক: তানজিলা রহমান মৌনিতা, স্যাক্সিয়ন ইউনিভার্সিটি অব অ্যাপ্লায়েড সায়েন্স, নেদারল্যান্ডস
***দূর পরবাসে লেখা পাঠাতে পারবেন আপনিও। ঠিকানা [email protected]