অনলাইনে ভূমি সেবা, অপ্রত্যাশিত আনন্দ

প্রতিবছরের মতো এবারও সস্ত্রীক বেড়াতে এসেছি ঢাকায়। বছরটি দুই ভাগের শেষ ভাগে পা দিলেই, অর্থাৎ জুলাই মাস এলেই মাতৃভূমির প্রতি এক আজানা ভালোবাসা জেগে উঠে মানসে। ডাক পড়তে থাকে বা টান আসতে থাকে হাজার মাইল দূর থেকে। একটি ক্ষীণ বেদনা জেগে উঠে বুকের কোনে। আত্মীয় স্বজন, বন্ধুবান্ধব, পরিচিতজন আর দেশের মাটির ডাক যেন শুনতে পাই। অগত্যা যোগাযোগ শুরু হয় পরিচিত ট্রাভেল এজেন্টের সঙ্গে। প্রতিবার যে বিমান পরিবহনে ভ্রমণ করি তার ব্যতিক্রম করতে মন চায় না। তাই বছর বছর মূল্যস্ফীতি হলেও সে পরিবহনের সঙ্গেই আবার সখ্যতা বাঁধি অর্থাৎ তাদের টিকিটই কিনে ফেলি দুজনার জন্য।

প্রতিবারের মতো এবার রুটিন মাফিক কিছু পারিবারিক অ্যাসাইনমেন্ট ছিল। যেমন, ট্যাক্স রিটার্ন জমা দেওয়া, নিজ আবাসনের কিছু উন্নতি করা, ব্যাংক অ্যাকাউন্টগুলোর হালনাগাদ করা, যৌথভাবে আত্মীয়–স্বজনদের সাহায্য–সহযোগিতা করার জন্য ভাই–বোনদের সঙ্গে আলোচনা করা, অসুস্থ আত্মীয়–স্বজন ও বন্ধুবান্ধবদের খোঁজখবর নেওয়া ইত্যাদি।

এবার রুটিনের বাইরে দুটি অ্যাসাইনমেন্ট উদয় হল। দুটিই জরুরি। ভূমি উন্নয়ন কর দেওয়া। নিজেদের আবাসস্থল ঢাকার ফ্ল্যাটটির এবং স্ত্রীর নারায়ণগঞ্জে তিন কাঠার একটি জমির কর পরিশোধ করতে হবে। পরিচিতজনদের কাছে ধরনা দিলাম তথ্যের জন্য। জানা গেল গত কয়েক বছর ধরে অনলাইনে কর দেওয়া যাচ্ছে। তবে সে পর্যন্ত যেতে হলে প্রথমে অনলাইনের কাজটুকু আগে সারতে হবে। তারপর অনলাইনে আসবে কর পরিশোধের সুযোগ। আর যেতে হবে না দূরদূরান্তের ভূমি অফিসে। ঢাকার ফ্ল্যাটটির নামজারি করা ছিল ৩৫০০০ টাকার বিনিময়ে এবং তার তথ্যগুলো অনলাইনে পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু নারায়ণগঞ্জের জমির নামজারী করা হয়েছিল অনলাইনের বহু পূর্বে, জানাল স্ত্রী। তবে এখনো জমি হস্তান্তর হয়নি। ইহকালে হবে কি না, সেটাও সন্দেহের আওতায় রয়েছে। সে কথা এখানে অপ্রাসঙ্গিক। এদিকে আমার বড় ভায়রা নারায়ণগঞ্জে ভূমি অফিসের এক কর্মচারীর সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করে আহ্বান পেলেন সেখানে পদধূলি দিয়ে অনলাইনে কর দেওয়ার প্রাথমিক কাজটি সেরে ফেলার জন্য। তবে তাতে কিছু খরচা আছে বলে জানালেন তিনি ফোনে। আমরা প্রস্ততি নিচ্ছি গাড়ি ভাড়া করে সেখানে যাব এবং একই দিন দুচোখ ভরে জমিটি দেখে আসার বাসনাও হলো।

ইতোমধ্যে আমি স্ত্রীর জমির কাগজপত্র ভূমি অফিসের কর্মচারীর ফর্দ মোতাবেক ফটোকপি করে ফেললাম। এখন যাওয়ার দিনক্ষণ ঠিক করা বাকি। ঢাকার ফ্ল্যাটটির নামজারিতে দেখতে পেলাম একটি বারকোড। কৌতূহলবশত মোবাইলে স্ক্যান করতেই আলাদিনের চেরাগের মতো হাজির হলো ভূমি অফিসের ওয়েব পেজ। নিচের ছবিটি দেখুন।

ইউরোপে বসবাস বিধায় এহেন কোনো সরকারি কাজ নেই, যা কি আমাদের অনলাইনে করতে হয় না। তাই পেজটির ধরনধারন অতি পরিচিত মনে হলো। আশাবাদী মনে পেজটি ঘেঁটে জানা গেল অনলাইনে রেজিস্ট্রি করার যাবতীয় ব্যবস্থা রয়েছে এখানে। কল সেন্টারের ফোন নম্বরও দেওয়া আছে সেখানে, ১৬১২২। কৌতূহলবশত এবং পুরোপুরি নিশ্চিত হবার জন্যে কল দিয়ে বসলাম ১৬১২২–তে।

এবারও ধাক্কা খেলাম! সেই একই কায়দায়, ইউরোপিয়ান পদ্ধতিতে একটি যান্ত্রিক স্বর জানালো আমাকে চাপতে হবে ভিন্ন ভিন্ন নম্বর, আমার দরকারি সেবা পেতে হলে। একবার একটি সংখ্যা চাপার পর এবার অনুরোধ এলো আরেকটি সংখ্যা চাপার জন্য। তিনবারের মাথায় ভুল করে বসলাম আমি। আমাকে অবাক করে দিয়ে যান্ত্রিক কণ্ঠটি বলে উঠল, ‘আপনি অপেক্ষা করুন, আমাদের সেবক ফ্রি হলেই আপনার কলটির উত্তর দেবেন। ইউরোপে এ কথাটির অর্থ হলো অফুরন্ত অপেক্ষা! আপনি জানেন না কখন আসবে সে কণ্ঠস্বর? সেটা ১০ মিনিট থেকে ৩০ মিনিটও লেগে যেতে পারে। মোবাইল ফোনের খরচ অযথা না বাড়িয়ে লাইন কেটে দেওয়ার মুহূর্তেই একটি সুমধুর নারী কণ্ঠস্বর ভেসে এল। স্বাগত জানিয়ে জানতে চাইল, ‘আপনাকে কী সেবা দিতে পারি?’

আমার প্রশ্ন ছিল, অনলাইনে কর দেওয়ার জন্য আমাকে কি কি করতে হবে? জানালাম আমার নামজারি করা আছে। জমির কথা না বলে শুধু ঢাকার ফ্ল্যাটটির কথাই উল্লেখ করলাম। নিশ্চিত ছিলাম নারায়ণগঞ্জে যাওয়ার কোনো বিকল্প নেই। তাই সে প্রসঙ্গটা তুললাম না। নারী কণ্ঠস্বর একটু অপেক্ষা করার অনুরোধ করে আমাকে একাকী রেখে কোথায় যেন হারিয়ে গেল। না, সেটা স্বল্পক্ষণের জন্য। দুই মিনিটেই ফিরে এসে দ্রুত গতিতে আমাকে কী কী করতে হবে, তার একটি ফিরিস্তি আউড়ে গেলেন। ঘাবড়ে গেলাম। এটা কি নারী কণ্ঠস্বর, না কি যান্ত্রিক স্বর? না, তিনি যান্ত্রিক নন। ধারণা করলাম, তিনি দুই মিনিট সময় নিয়ে একটি তথ্যমূলক কাগজ এনে আমাকে তা দ্রুত পড়ে শোনালেন। আমি যেহেতু অর্ধেকও হৃদয়াঙ্গম করতে পারিনি, তাই খুঁটে খুঁটে প্রশ্ন করে বিস্তারিত তথ্য জেনে নিলাম। কোন ওয়েব পেজে, কোথায় কী কী তথ্য দিতে হবে, ইত্যাদি। ফোনে অনেক সময় অনেক তথ্য বোঝা যায় না। তাই তিনি এসএমএস করে কিছু তথ্য আমাকে পাঠাবেন বলে জানালেন। আমি এ ধরনের সেবা পেয়ে কৃতার্থ হলাম যথার্থই! যা কিনা আমি আশা করি করিনি। সালাম বিনিময় করে কথোপকথন শেষ হলো।

দুরু দুরু বুকে এবার ল্যাপটপ চালু করে ঢুকে পড়লাম ওপরের ওয়েব পেজে। ধীরে ধীরে লিখে দিলাম আমার ফোন নম্বর, নাম, ফ্ল্যাটমালিকের নাম ও ঠিকানা, ই-মেইল। চয়েস করতে হলো একটি মানানসই কিন্তু নিরাপদ পাসওয়ার্ড। সব কিছুই একটি আন্তর্জাতিক মাপের নিরাপত্তা মাপকাঠি মোতাবেক। আমার রেসপেক্ট ধীরে ধীরে মাপকাঠির অনেক ওপরে জ্বর মাপা থার্মোমিটারের পারদের ন্যায় আকাশের পানে ধাবিত হতে লাগল। একপর্যায়ে মোবাইলে ওটিপি এল এবং আমার অ্যাকাউন্ট রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন হলো। আমাকে এবার লগইন করতে বলা হলো নতুন পাসওয়ার্ডটি ব্যবহার করে। সব কিছুই সম্পন্ন হলো বিনা বাধায়।

এবার ফ্ল্যাটের তথ্য দিয়ে এগোতে হলো। জেলা, উপজেলা, মৌজা, খতিয়ান নম্বর ও আরও কত কি! সব তথ্যই আছে খতিয়ানে। অনলাইনে জেলা দিলেই সে জেলার উপজেলাগুলো পাওয়া যাচ্ছে। সেখান থেকে বেছে নিতে হলো নির্ধারিত উপজেলা। মৌজার নামগুলোও চলে এল আপনা–আপনি উপজেলা মোতাবেক। বাকি রইল খতিয়ান নম্বর। যা কিনা দিতে হলো খতিয়ান থেকে। এরপর মোবাইলের মাধ্যমে খতিয়ানের ছবি তুলে সেটা আপলোড করলাম। সব তথ্যগুলো দিয়ে পাতাটি হালনাগাদ করতেই ইউরেকা! নাম এসে গেল, ফ্ল্যাটমালিকের এবং খতিয়ানের অন্য তথ্য। আনন্দে স্ত্রীকে ডেকে জানান দিলাম ফ্ল্যাটমালিক হিসেবে তার নাম ও অন্যান্য তথ্য সঠিক দেখা যাচ্ছে। এমনকি সর্বশেষ কোন সাল পর্যন্ত কর দেওয়া আছে, সেটাও রয়েছে।

নারায়ণগঞ্জের জমির খতিয়ানটি ফাইল থেকে বের করে দেখলাম, সব তথ্য আছে কি না? হ্যাঁ, আছে। এক্সপেরিমেন্টালি শুরু করলাম সে জমির তথ্য দিয়ে। এবার দ্রুত এগোতে পারলাম পূর্ব অভিজ্ঞতার আলোকে। ইউরেকা! এবারও সব এসে গেল। স্ত্রীকে আবার জানান দিলাম খুশির খবরটি। কোথাও কারচুপি নেই। সরকারি তথ্যভান্ডারে সব তথ্যই সঠিক!

আরেকটু ঘেঁটে জানা গেল নির্ধারিত উপজেলা ভূমি কর্তৃপক্ষ প্রতিটি খতিয়ানে হোল্ডিং নম্বর যোগ করলেই দেখা যাবে কোন খতিয়ানে কত টাকার কর বাকি আছে, কত টাকা জরিমানাসহ মোট কত টাকা দিতে হবে। অপেক্ষা না করে আমার বড় ভায়রাকে মোবাইলে কল দিয়ে দ্রুত চলে আসতে বললাম কাগজপত্র নিয়ে। ওনার স্ত্রী অর্থাৎ আমার স্ত্রীর বড় বোনের জমি রয়েছে নারায়ণগঞ্জের একই মৌজায়। ফোন করে ভায়রার ছেলের মোবাইল নাম্বার এবং ই-মেইল নিয়ে নিলাম। সেগুলো লাগবে ওনাদের জমির ওনলাইন রেজিস্ট্রেশনের জন্য।

ভায়রা এসে গেলে সম্পন্ন করে ফেললাম তাঁদের রেজিস্ট্রেশন। এবারও সব তথ্য পাওয়া গেল নির্ভুল। ভায়রা বললেন, সম্ভবত দুই ঘণ্টার মধ্যেই চলে আসবে হোল্ডিং নাম্বার। আমি ততটা আশাবাদী নই। সেটা ছিল বৃহস্পতিবার। সামনে দুটি ছুটির দিন। এর পর নববর্ষ (ইংরেজি নতুন বছর)। ভায়রাকে বললাম, ছুটির দিনগুলো বাদ দিন। এর পর আগামী সপ্তাহে এলেই আমি সন্তুষ্ট। এক সপ্তাহ পর না হয় আবার ফোন করব ১৬১২২–তে। ৩১ ডিসেম্বর ব্যস্ত থাকায় হোল্ডিং নাম্বার হালনাগাদ হলো কিনা, দেখতে ভুলে গেলাম। ইংরেজি নববর্ষ উদ্‌যাপন করে পরের দিন ১ জানুয়ারি ভূমি মন্ত্রণালয়ের ওয়েব পেজে লগইন করে চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। গত দিনই ঢাকার ফ্ল্যাটটির হোল্ডিং নাম্বার দেওয়া হয়েছে। দেরি না করে পরবর্তী পদক্ষেপ অর্থাৎ কর দেওয়ার পথে এগোলাম। এবারও আশ্চর্য হলাম ওয়েব পেজটির গঠন এবং কার্যপ্রণালির ওপর। বিভিন্নভাবে কর পরিশোধ করা যায়। বিকাশ ও অন্য সেবা ছাড়াও দেওয়া যাবে ব্যাংকের মাধ্যমে। যে কেউ আপনার হয়ে দিতে পারবে কর। আমি অতি সহজেই বিকাশের মাধ্যমে, মোবাইল ফোন দিয়ে ওটিপি নিয়ে পরিশোধ করলাম কর। মুহূর্তের মধ্যে পেয়ে গেলাম কর পরিশোধের রসিদ। যেটা সহজেই সেভ করে রাখা যায় মোবাইলে বা কম্পিউটারে। সব তথ্যই সব সময় পাওয়া যাবে ও দেখা যাবে লগইনের পর যার যার পেজে।

ভায়রাকে আনন্দের সংবাদ দিয়ে জানালাম আগামী কয়েক দিন অপেক্ষার পর নারায়ণগঞ্জের কোনো খবর না এলে প্রয়োজনে ভূমি অফিসের সেই কর্মচারীর শরণাপন্ন হয়ে কিছু টাকার বিনিময়ে হোল্ডিং নম্বর বের করে নেওয়া যাবে তখন।

না, সেটার দরকার আর পড়েনি। দুদিন পর আমাদের সবাইকে আনন্দের সাগরে ভাসিয়ে চলে এলো হোল্ডিং নাম্বার। পায়ে হেঁটে নারায়ণগঞ্জ থেকে নয়, অনলাইনে। এরপর আমরা দুই ভাইরা ভিন্ন ভিন্ন সময়ে অনলাইনে পরিশোধ করলাম, আমাদের দুই স্ত্রীর জমির ভূমি উন্নয়ন কর, বাংলা ১৪৩০ সাল পর্যন্ত। আমরা বঞ্চিত হলাম নারায়ণগঞ্জ ভ্রমণের একটি সুযোগ থেকে। তবে বেঁচে গেল উপরি কিছু খরচের বোঝা।

বিভিন্ন তথ্য ঘেঁটে জানলাম, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরাসরি নির্দেশে ভূমি অধিদপ্তর অত্যন্ত নিপুণতার সঙ্গে ইউরোপিয়ান মানের এ সেবাটি চালু করতে সক্ষম হয়েছেন। আমি মনে করি এটা এবং এ ওয়েব সেবাটি একটি মাইলফলক। আমাদের দেশের অন্য আর সব সেবাকে ঠিক একই মানে নিয়ে আসতে পারলে আমরা সত্যিই গর্ববোধ করব আইটিতে প্রশিক্ষিত আমাদের দেশের লাখো প্রফেশানালদের নিয়ে। এরাই কিন্তু প্রবাসে তৈরি করছে এ ধরনের লক্ষ সেবার অনলাইন পেজ।

কত টাকা কর দিলাম জানতে চান কী?

ঢাকার ফ্ল্যাটের জন্য ১২৪ টাকা আর নারায়ণগঞ্জের ৩ কাঠা জমির জন্য ৪০ টাকা। এত কম টাকার ভূমি কর আর কোনো দেশে আছে কি না, সন্দেহ আছে আমার। আমার সময় লেগেছে আনুমানিক ৪০ মিনিট। আগামীতে তা নেমে আসবে ১০ মিনিটে।

*লেখক: কামরুল ইসলাম, সুইডেনপ্রবাসী

**দূর পরবাসে লেখা, গল্প, ভ্রমণ কাহিনী পাঠাতে পারবেন প্রবাসের পাঠকেরা। মেইল অ্যাড্রেস [email protected]