স্যামন মাছের বেদনাবিধুর জীবনচক্র

স্যামন মাছছবি: লেখকের পাঠানো

বিদেশে আসার দুই দশক পর প্রথমে ক্যাট ফিশ ধরার মাধ্যমে মাছ ধরায় হাতেখড়ি। সেটাও বন্ধু মোহাম্মদ সানাউল্লাহ খান খোকন ভাইয়ের অনুপ্রেরণায়। এরপর সান ফিশ ও কার্প ফিশ। ক্যাট ফিশ (মাগুর মাছের মতো), সান ফিশ (মেনি মাছের মতো) ও কার্প ফিশে রয়েছে রুই মাছের স্বাদ। এই তিন রকমের মাছ ধরার পর বারবার মন ছুটে যায় স্যামন ফিশের প্রতি। মৎস্যবিদ্যার গুরু আকতার হোসেন ভাইকে বলি, স্যামনের সঙ্গে কি কখনো দেখা হবে না? ছোট জাতের মাছ শিকারের পর আমার বোধগম্য হলো যে আমার বর্তমান ছিপ দিয়ে বড় মাছ শিকার করা যাবে না। আরেকটি ছিপ ও সুতা সংগ্রহ করি। কারণ, বড় মাছের জন্য ছিপ ও সুতা ভারি শক্তপোক্ত হতে হবে। তা না হলে মাছ বশে আনা যাবে না। দ্বিতীয় ছিপ সংগ্রহের পর মনে হলো, এবার তাহলে প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিকে উত্তীর্ণ হয়েছি।

‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় দাবাড়ু মেজদা বলেছিলেন, ফুটবল খেলোয়াড়ের সঙ্গে রাতে ঘুমালে টের পাবি, সে ঘুমের মধ্যে তোকে লাথি দেয়। আর একজন দাবাড়ু ঘুমের মধ্যে বলে, রাজা চেক, চেক। কী বিস্ময়জাগানিয়া গল্প! কিছুদিন আগে আমি স্বপ্নে দেখি সান ফিশ ধরেছি। এর পরপরই মৎস্যবিদ্যার গুরু আকতার হোসেন ভাই ফোনে বললেন, সিজন তো প্রায় শেষ। চলুন সান ফিশ ধরতে যাই। পরে আর পাওয়া যাবে না। তাঁর শিডিউল অনুযায়ী ভোরে দুজনে রওনা হই। দীর্ঘ ভ্রমণের পর সূর্যোদয়ের আগেই আমরা স্পটে পৌঁছি। প্রবাদ শুনেছি, ‘চুরিবিদ্যা বড় বিদ্যা, যদি না পড়ে ধরা’। এখানে গুরুর বিদ্যা বড় বিদ্যা। কারণ, মাছ শিকারে গুরুর দর্শন হলো, সূর্যোদয়ের আগেই স্পটে পৌঁছাতে হবে। সঠিক সময়ে পৌঁছার কারণে ভোরের আকাশে তাঁর হাসি বিস্তৃত হলো। গুরু মাছ শিকারে মনোনিবেশ করলে প্রকৃতি ও ভোরের আকাশের ছবি আমার মন কেড়ে নেয়। প্রায় আড়াই ঘণ্টা সান ফিশ ধরার পর আকতার ভাই বললেন, চলুন, এবার তাহলে স্যামন মাছ ধরতে যাই। স্যামনের কথা শুনেই আমার মন নেচে ওঠে। ভাবি, এত দিনে স্বপ্ন হলো সত্যি। ‘আহা, কী আনন্দ আকাশে বাতাসে’।

স্যামন মাছ ধরা চলছে
ছবি: লেখকের পাঠানো

প্রতিটি মাছের ঘরদোর আকতার ভাইয়ের জানা। মাছেরা কখন আসে, কখন চলে যায় এবং মাছেদের ঠিকানার জন্য তাঁর নোটবুক খুঁজতে হয় না। প্রতিটি মাছের নামের সঙ্গে ঠিকানাও তাঁর মুখস্থ। প্রয়াত বেগ স্যার আমাকে বলেছিলেন, ‘আপনি তো গুরু মারা শিষ্য।’ অনেক দেরিতে জেনেছি, আকতার ভাইও বেগ স্যারের ছাত্র। বেশ কিছু সময় চলার পর আমরা স্যামনের ঠিকানায় পৌঁছি। গাড়ি পার্ক করার সময় মৃত স্যামন মাছের গন্ধ নাকের ছিদ্রপথে এসে দাপাদাপি শুরু করে। দুজনে ছিপ হাতে অনেকটা পথ হেঁটে স্যামনের রাজ্যে এসে দেখি, ১০ থেকে ১২ জন শিকারি মাছ শিকারে ব্যস্ত। তাঁদের মধ্যে নারীও রয়েছেন একজন। তিনি বুট পায়ে ছিপ হাতে পানিতে নেমে স্যামনের পিছু পিছু হাঁটছেন। আহা, স্যামনের সেকি নজরকাড়া সন্তরণ, এই তো হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যায়! অনেক স্বাদের স্যামন আমার বাঁধন ছিঁড়ে যায়। স্যামন মাছ ধরাতেও রয়েছে বেশ কিছু বাধ্যবাধকতা, নিয়মকানুন। হাতে জাল দিয়ে এই মাছ ধরা সম্পূর্ণ বেআইনি। মনে হলো মৃত্যু আসন্ন জেনে স্যামন মাছ শিকারিদের ছিপে আটকানো খাবার খেতে আগ্রহী নয়। ওজনসমৃদ্ধ এই মাছ ছিপে আটকালেও সুতা ছিঁড়ে পগারপার। কারও কারও ছিপে আটকানোর পর দেখি তারা ‘লাপাত্তা লেডিস’। কৌশল অবলম্বন না করলে এই বিরাট মাছ ডাঙায় তোলা যায় না। তারপর সরকারি বিধিনিষেধ না মনে চললে রয়েছে বিশাল অঙ্কের জরিমানা। কখনো গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তখন ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ অবস্থা!  মৃত মাছের গন্ধে আকাশ–বাতাস ভারী হয়ে আছে, দুর্গন্ধে টেকা দায়। এই গন্ধের কারণে কয়েকবার মনে হয়েছে, ফিশিং থেকে পিঠটান দেব কি?

স্যামন মাছ
ছবি: লেখকের পাঠানো

স্যামন মাছের জীবনচক্র জেনে বিস্মিত হই। আহা মাছের জীবন, সে–ও বেশ রহস্যময়। জন্মের পর স্যামনের পোনা জন্মস্থান নদী থেকে দূরে সাগরে চলে যায়। ডিম দেওয়ার সময় হলে তারা সাগর থেকে জন্মস্থান সেই নদীতেই ফিরে আসে। অগভীর লেকের পানির স্রোতোধারায় স্যামনের জন্ম। ডিম থেকে স্যামনের জন্মের পর পোনারা দল বেঁধে সাগরের উদ্দেশে রওনা হয়। সাগরেই বেড়ে ওঠে তারা। পূর্ণবয়স্ক স্যামন ডিম পাড়ার সময় হলে দলে দলে ফিরতে থাকে জন্মস্থানে, যেখানে তাদের জন্ম হয়েছিল। তাদের যাওয়া-আসার পথে দেখা যায়, পাখি, বিভিন্ন প্রাণী ও মানুষ—সবাই তাদের শত্রু।
জন্মস্থান থেকে সাগরে চলে যাওয়া, তাদের এই যাত্রাপথ সহজ নয়। শীতের দেশ থেকে শীতের পাখিরা যেমন দল বেঁধে আমাদের দেশে আসে, আবার শীতের শেষে তারা ফিরে যায় নিজের আদি ঠিকানায়। দুর্যোগ ও বাধা ডিঙিয়ে তাদের পথচলা। কয়েক বছর সমুদ্রে থাকার পর ডিম দেওয়ার সময় হলে তারা ফিরে আসে জন্মস্থানে, ঠিক যে স্থানে তাদের জন্ম হয়েছিল। কী করে পথ চলে তারা? কেমন করে ফিরে আসে তারা জন্মস্থানে? জন্মস্থানে এসেই আবার ডিম দেওয়ার পর তারা দলে দলে মরে যায়! নারী স্যামন ডিম দেওয়ার পর তার সঙ্গে পুরুষ স্যামন মাছও মারা যায়, সে কি সহমরণ? সৃষ্টিকর্তা কি শীতের পাখি ও স্যামনের মস্তিষ্কে জিপিএস সেট করে দিয়েছেন? যেমন আমাদের শরীরে রয়েছে বায়োলজিক্যাল ক্লক। তাহলে তাদের মস্তিষ্কেও কি রয়েছে বায়োলজিক্যাল জিপিএস? সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টিতত্ত্ব রহস্যে ঘেরা।

বিভিন্ন জাতের স্যামন মাছ রয়েছে। স্যামন মাছ খেতে খুবই সুস্বাদু। বাংলাদেশের ইলিশ মাছের মতোই স্যামন দামি মাছ। কারণ, ইলিশ ও স্যামনে রয়েছে ওমেগা থ্রি। গোলাপি রঙের (পিংক স্যামন) স্যামনের কদর বেশি রেস্টুরেন্টে। কারণ তার ঘ্রাণ ও স্বাদ। স্যামনের মাথা আলাদাভাবে বিক্রি হয়। মাথা খুবই সুস্বাদু। ওমেগা থ্রির জন্য স্যামনের মাথা খুবই আদরণীয়।