মেট্রো
আমি যখন জার্মানিতে প্রথমবার যাই, সবচেয়ে বেশি অভিভূত হয়েছিলাম সেখানকার পাতালরেল দেখে। জীবনে প্রথমবারের মতো পাতালরেল বা মেট্রো দেখেছি। সেই ২০০১ সালের কথা, জার্মানির স্টুটগার্ট শহরের কাছাকাছি একটি ছোট শহরে ছিল স্টুটগার্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস। শহরে যাতায়াতের জন্য মেট্রোরেল ও বাস—দুটিই ছিল। মার্সিডিস বেঞ্জের বাসে চড়তে খুব ভালো লাগত।
মেট্রোও ছিল অনেক ভালো, ছয় মিনিটেই শহরে চলে যেতাম মেট্রোতে চড়ে। মেট্রোর টিকিট কাটার মেশিন দেখে অভিভূত হয়েছিলাম। মেশিনের স্ক্রিনে কোথায় যাব, তা লিখে দিলেই কত ভাড়া বলে দিত। মেশিনের ভেতর টাকা ঢোকালেই টিকিট বের হয়ে যেত। টিকিট কাটার মেশিনে টিকিট কেটে, ভূগর্ভস্থ স্টেশনে নেমে রেলে চড়তাম। এগুলো ছিল বৈদ্যুতিক রেল। রেলের ওপরে বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন ছিল, সেখান থেকেই বিদ্যুৎ আসত রেলের পাওয়ার রুমে। রেল যে বিদ্যুতে চলে, অনেকে সেটা বুঝত না। একদিন এক ছাত্র বলছিল, রেল চলে ব্যাটারিতে, যা আমাদের মধ্যে হাসির খোরাক জুগিয়েছিল।
চলন্ত রেলে কীভাবে বিদ্যুতের সংযোগ দেওয়া হয়, বিষয়টি নিয়ে আমি বাংলাদেশে থাকতেই অনেকবার ভেবেছি। বাংলাদেশে তখন বৈদ্যুতিক রেল ছিল না, তাই দেখার সুযোগও ছিল না। আমার এক পরিচিতজন আমেরিকায় থাকত। আমি তাকে জিজ্ঞেস করেও কোনো ব্যাখ্যা পাইনি।
চলন্ত রেলে আবার তারের সংযোগ কীভাবে হবে? আমাকে বিষয়টি অনেক ভাবাত। দেশের বাইরে যাওয়ার পর আমি তা বোঝার চেষ্টা করেছি, রেলের ওপরের লাইন এবং রেলের সংযোগ পরখ করে দেখেছি। রেলের ওপরে একটি ঝুলন্ত তার থাকে, রেলের ছাদে থাকে কার্বন স্ট্রিপ, যা ওই তারে সংযোগ সৃষ্টি করে। রেল চললে কার্বন স্ট্রিপটি বিদ্যুতের তারের নিচে স্লাইড করে ট্রেনে বিদ্যুতের প্রবাহ নিশ্চিত করে।
বাংলাদেশে মেট্রোরেল চালু হয়েছে। আপনাদের কি ধারণা আছে, কত ভোল্টের বিদ্যুতের লাইন আছে রেলের ভেতর বিদ্যুতের প্রবাহের জন্য? এটা কি ডিসি কারেন্ট, নাকি এসি কারেন্ট? মেট্রোর ওপরে যে একটি তারের লাইন দেখতে পান, সেখানে ১ হাজার ৫০০ ভোল্টের ডিসি কারেন্ট সরবরাহ করা হয়। আপনারা ১২ ভোল্টের গাড়ির ব্যাটারি দেখেছেন, যা দিয়ে আগেকার দিনে আমরা টেলিভিশন চালিয়েছি। ১২ ভোল্টের ১২৫টি ব্যাটারি একসঙ্গে যুক্ত করলে ১ হাজার ৫০০ ভোল্ট পাওয়া যাবে। তাহলে কি গাড়ির ১২ ভোল্টের ১২৫টি ব্যাটারি দিয়ে মেট্রোরেল চলবে?
না চলবে না, কারণ আমরা ১ হাজার ৫০০ ভোল্ট পেলেও ট্রেন চলতে যতটুকু পাওয়ার লাগবে, গাড়ির ব্যাটারিতে এত পাওয়ার থাকে না। আমরা চেষ্টা করে দেখতে পারি, ট্রেন হয়তো একটু নড়বে শুধু। ১ হাজার ৫০০ ভোল্টের ডিসি কারেন্ট সচরাচর থাকে না। তাই মেট্রোর জন্য আলাদা সাবস্টেশন তৈরি করতে হয়েছে, যেখানে এসি কারেন্ট থেকে ১ হাজার ৫০০ ভোল্টের ডিসি কারেন্ট তৈরি করা হয়। ১ হাজার ৫০০ ভোল্টের ডিসি কারেন্টকে ইনভার্টারের মাধ্যমে ২০০ ভোল্টের এসি কারেন্টে পরিবর্তিত করে থ্রি-ফেজের ইলেকট্রিক মোটর চালানো হয়, যা রেলটিকে সামনের দিকে টেনে নিয়ে যায়। তাহলে কি ভবিষ্যতে ব্যাটারি দিয়ে মেট্রো চলবে না?
উত্তরটি ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’। আসলে অদূর ভবিষ্যতে ফুয়েল সেল দিয়ে ট্রেনের ভেতর বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে, যা দিয়ে ব্যাটারি চার্জ করা হবে। আর ব্যাটারি থেকে ইনভার্টারের মাধ্যমে থ্রি–ফেজ এসি কারেন্ট পাওয়া যাবে, যা দিয়ে মোটর চলবে। ফুয়েল সেল হলো হাইড্রোজেন দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রক্রিয়া। হাইড্রোজেন সেল এখনো ডেভেলপমেন্ট পর্যায়ে আছে। তবে আশা করা যাচ্ছে, অদূর ভবিষ্যতে এর উৎপাদন ও ব্যবহার শুরু হবে এবং কার্বন নির্গমন হ্রাসে ভূমিকা রাখবে।
জাপানে মেট্রোরেল চালু হয় ১৯২৭ সালে আর বাংলাদেশে ২০২২। প্রায় ১০০ বছর পর বাংলাদেশে মেট্রো পেলাম। ১০০ বছর আগে এত মানুষ ছিল না, তাই মেট্রোরেল বানাতে এত চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হতো না। ঢাকায় এমন সময় মেট্রোরেল হলো, যখন যানজটে মানুষ অতিষ্ঠ। ভিড়ের নগরে মেট্রোরেল তাই আশীর্বাদ। এটি জাপানিরা বানিয়েছে। রেললাইন, ট্রেনের বগি, প্ল্যাটফর্মের নিরাপদ দরজা, টিকিট কাটার মেশিন—সবই জাপান থেকে আনা। তাই আমাদের মেট্রোরের আর টোকিওর মেট্রোরেলের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। জাপানে এক স্টেশন থেকে আরেক স্টেশনে যেতে ১৪০ ইয়েন বা বাংলাদেশি মুদ্রায় ১১৫ টাকার মতো খরচ হয়। সে তুলনায় বাংলাদেশে ২০ টাকা ভাড়া যথার্থই মনে হচ্ছে।
অনেকে ঢাকার মেট্রোরেলের সঙ্গে কলকাতা বা করাচির মেট্রোর ভাড়া তুলনা করেন, যা মোটেও ঠিক নয়। কলকাতা বা করাচির মেট্রোরেল জাপান বানায়নি। জাপানিদের কাজ দীর্ঘস্থায়ী হয়, তাই ভাড়া কত, তা বিবেচনা না করে কোনোটির স্থায়িত্ব বেশি হবে, কোনোটির রক্ষণাবেক্ষণের ব্যয় কম হবে, সেটি বিবেচনা করা উচিত। মেট্রোরেল তৈরিতে কত বেশি ব্যয় হয়েছে, আমি সে প্রসঙ্গে আসব না। উল্লেখ্য, জাপানের তৈরি জিনিসপত্র চীনে তৈরি জিনিসপত্রের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ, অনেক ক্ষেত্রে তিন গুণ বেশি দামি এবং দীর্ঘস্থায়ী।
আমরা যত বেশি জাইকাকে নিয়ে কাজ করব, আমাদের স্থাপনার স্থায়িত্ব তত বেশি হবে। মেট্রোরেল ঢাকার মানুষের জীবনে স্বস্তি নিয়ে আসবে, মানুষ ঢাকার বাইরের দিকে বসবাস করে ঢাকায় অফিস করবে—এর চেয়ে বড় পাওনা আর কিছু হতে পারে?
লেখক: নূরুল আনোয়ার মামুন, তড়িৎ প্রকৌশলী, আমেরিকার গাড়ি তৈরির কোম্পানিতে কর্মরত, মিশিগান, যুক্তরাষ্ট্র