অসুস্থ নিকিউ তিত এবং তার বস
নিকিউ তিত, ছদ্মনাম। বাংলাদেশি, তবে এখন দক্ষিণ আফ্রিকাপ্রবাসী। দক্ষিণ আফ্রিকায় কোনো একটা দোকানে কাজ করে। যে দোকানের কাজে নিয়োজিত আছে, সে দোকানের মালিকও বাংলাদেশি। মুদির দোকান। তবে এই দোকানগুলো ছোট, মাঝারি ও বড় সাইজের হয়ে থাকে। নামে মুদিদোকান হলেও দোকানের আকারের ওপর ভিত্তি করে মুদিদোকানের দ্রব্যসামগ্রীর সঙ্গে ইলেকট্রনিকস, হার্ডওয়্যার, কাঠ-কয়লা, মাছ, মাংস, আইসক্রিম, সাজ-সরঞ্জাম, পেইন্ট ইত্যাদি মালামাল পাওয়া যায় বা বিক্রি করা হয়ে থাকে।
দক্ষিণ আফ্রিকায় এ ধরনের দোকানগুলোর মুষ্টিমেয় কিছু বাদ দিলে সব শিল্পের মালিক সাধারণত বাংলাদেশি। আর এসব দোকানগুলোর দেখভাল করে থাকেন মালিক স্বয়ং নিজেই। যদি দোকান পরিচালনা করতে একা সম্ভব না হয়, তবে চাহিদা অনুযায়ী অতিরিক্ত লোক বা কর্মচারী নেওয়া হয়। যেসব বাংলাদেশি ভাইদের পক্ষে দোকান কেনা সম্ভব হয়ে ওঠে না, মূলত তাঁরা বাংলাদেশিদের দোকানে চাকরি করেন।
এসব মুদিদোকানে লম্বা ডিউটি করতে হয়। দোকানের মালিক নিজে অথবা কর্মচারী যে–ই বা যাঁহারা দোকান পরিচালনা করুন, ডিউটি কিন্তু ঢের লম্বা। ভোর থেকে প্রায় মধ্যরাত পর্যন্ত ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান খোলা থাকে। সকাল ৭টা থেকে রাত ১১টা, কেউ সকাল ৬টা থেকে রাত ১১টা এবং সকাল সাড়ে ১০টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত দোকানে ডিউটি করতে হয়। সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক বা বার্ষিক কোনো প্ল্যাটফর্মে কর্মচারীদের জন্য ছুটি নেই। এমনকি বার্ষিক দুটি ঈদের ক্ষেত্রেও ওই একই অবস্থা। তবে দুই–একটা দোকান ঈদের দিন বন্ধ পাওয়া যেতে পারে, যার হিসাব হাজারে একটা। এমন দোকানে যাঁরা কাজ করেন, সেসব কর্মচারী সত্যিই বার্ষিক জোরকপালে বা লক্ষ্মীমন্ত।
নিকিউ তিত তেমনই একজন কর্মচারী। সারা দিন ডিউটি শেষে রাত সাড়ে ১১টার পর রাতের খাবার খেয়েই বিছানায় গিয়ে ঘুম দিতে হয়। আবার সকাল ছয়টায় ঘুম থেকে উঠে আনুষঙ্গিক কাজ সম্পন্ন করার পর সাড়ে ছয়টায় ডিউটি শুরু হয়ে যায়। নিকিউ তিতের কোনো সাপ্তাহিক ছুটি যেমন নেই, তেমনই নেই কোনো ঈদের ছুটি। অনুরূপভাবে নেই কোনো পাক্ষিক, মাসিক, বার্ষিক ও বড় দিনের ছুটি। এসব নিকিউ তিতরা ধীরে ধীরে রোবটে রূপান্তরিত হয়ে যায়।
এই তিত একদা অসুস্থ বোধ করতে লাগল। কেমন অসুস্থতা? হজম শক্তিতে সমস্যা। তিত মনে করে, যদি সে কিছু খেয়ে থাকে, তবে খাবারগুলো সঠিকভাবে হজম হয় না। গ্যাজা গ্যাজা পায়খানা হয়। খালি পেটে টোকা দিলে ঢোলের মতো ঢোব ঢোব শব্দ করে। মাঝেমধ্যে এন্টাসিড খায় নিজ থেকে, কিন্তু কাজ হয় না। তাই তার শারীরিক চিন্তা শুরু হলো এখান থেকে।
দক্ষিণ আফ্রিকার সরকারি হাসপাতালগুলোয় ডাক্তার দেখানো, যেকোনো টেস্ট (সেখানে সব ধরনের টেস্টের ব্যবস্থা আছে), সব ধরনের প্রয়োজনীয় ওষুধ দেওয়াসহ যাবতীয় চিকিৎসার ফ্রি ব্যবস্থা আছে। নিকিউ তিত চিন্তা করল হাসপাতালে গিয়ে ডাক্তার দেখাবে।
যেহেতু তিত চাকরি করে, সেহেতু তাকে অবশ্যই বসের অনুমতি নিয়েই হাসপাতালে যেতে হবে। সব ক্ষেত্রে এটা একটা নিয়মও বটে। তাই তিত একদিন হাসপাতালে যাওয়ার জন্য তার বসের নিকট সময় চাইল। বসের মনের মধ্যে কিছুটা আঁকুপাঁকু করলেও স্বাস্থ্যবিষয়ক ছুটি চাওয়ার কারণে বসের পক্ষে ‘না’ বলার সুযোগ হয়নি। সুতরাং বস ‘হ্যাঁ’ বলে সম্মতি দিলেন। এখন প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে গেল, তিত হাসপাতালে কবে যাবে?
দক্ষিণ আফ্রিকায় যাঁরা বস, অর্থাৎ দোকানের মালিক, তাঁদের ঢের ব্যস্ত থাকতে হয়, যা ধ্রুব সত্য। তাঁদের দোকানে সময় দিতে হয়, তদারকি করতে হয় এবং মালামাল ক্রয় করার জন্য এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে ছুটতে হয়। ঘুমাতে বা খেতে গেলেও মন রাখতে হয় দোকানের দিকে। সব ক্ষেত্রে টেকসই বুদ্ধি দিয়ে দোকান পরিচালনা করতে হয়।
অবশেষে তিত একটা দিন পেয়ে গেল হাসপাতালে যাওয়ার জন্য। তিতকে একটু খুশি খুশি ভাব লাগছে। যতক্ষণে হাসপাতালে থাকতে হবে, ততক্ষণে খেঁচ ঘেঁচি ডিউটি যন্ত্রণা থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে আর কি। দোকানে ডিউটির সময়ে কাস্টমারদের সঙ্গে দিনে কতবার যে মুখ থাকতে মুখোমুখি হয়ে যায়, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। মাঝেমধ্যে হাতাহাতিও বাধ্যতামূলক বিষয় হয়ে যায়। হাসপাতালে গেলে অন্তত সেদিনটা তো যন্ত্রণা থেকে নিরিবিলি থাকতে পারবে তিত। হাসপাতালে দিনব্যাপী ঠ্যাং ভেঙে দাঁড়িয়ে থাকলেও নিরিবিলি এ কারণেই বলছি যে অন্তত একটা বাস্তব অসিলায় একগুঁয়েমি থেকে স্বস্তি পাওয়া গেল। অবশ্য দোকানের ডিউটিতে সকাল থেকে রাত অবধি ঠ্যাং ভেঙেও দাঁড়ানোর সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। ঠ্যাং সোজা করেই থাকতে হয়।
তিত ডিউটি শেষ করে লুকিয়ে থাকা ফুর্তিতে ফুরফুরে মেজাজে ঘুমাতে গেল। কারণ, সকাল হলে দোকানে ডিউটি না করে নতুন শার্ট, প্যান্ট ও জুতা পরিধান করে ডাক্তার দেখানোর জন্য হাসপাতালে যাবে। তিতের হাসপাতালে যাওয়াকে কেন্দ্র করে এক সপ্তাহ ধরে নিজ প্রস্তুতি চলছে। তারই ধারাবাহিকতায় নতুন শার্ট, প্যান্ট ও জুতা কিনেছে সে। তা ছাড়া একটা সানগ্লাস কিনেও লজ্জায় লুকিয়ে রেখেছিল। সেটা আবার ফাঁস হলো হাসপাতালে যাওয়ার আগের দিন। দুপুরে ভাত খেতে গিয়ে রুমে একলা হওয়ায় চোখে নতুন চশমা লাগিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে রিহার্সাল দিচ্ছিল। ঠিক সেই সময় রুমে প্রবেশ করে তিতের রুমমেট। রুমমেট যখন রুমে ঢোকে, তখন তিত অপ্রস্তুত হয়ে জবুথবুতে রূপান্তরিত হলো। এই জবুথবু ভাবটা সহায়ক হলো চশমাটা জনসমক্ষে আসার। সানগ্লাসটির গ্লাস ওপরের অংশ হলুদ রঙের, আর নিচের অংশ সাদামতো। ফ্রেম ছিল বক্রাকৃতি।
আমরা সবাই জানি যে তিতের মাথা আধা টাক। বলতে পারি বেলজিয়াম গ্লাস। নিচের দিকে যতটুকু চুল আছে, তা দিয়ে মাঝেমধ্যে বেলজিয়াম গ্লাসটুকু ঢাকার ব্যর্থ চেষ্টা করে। এ কারণে তাকে মাথার অবশিষ্ট চুলগুলো বড় করতে হয়। এতেও তাকে খুব অস্বস্তিতে পড়তে হয়। রাতে ঘুমালে ২০–২৫টা চুল বালিশে লেগে থাকে। যা-ই হোক, তিত এবার ব্যর্থ চেষ্টা না করে সফল চেষ্টা করতে লাল–হলুদ মিশ্রিত একটা ক্যাপ ক্রয় করে এনেছে।
তিত যাবে হাসপাতালে রোগী হয়ে। তারপরও এত সংস্থিতির সঙ্গে আয়োজন। কেন এত আয়োজন? চাকরি করার সুবাদে কাজ বাদ দিয়ে বাহ্যরূপে বা বহিরাংশে যাওয়ার সুযোগ নেই তিতের। ছুটির অভাবে ফুর্তি অপূর্ণ থাকে যেখানে, সেখানে যদি যেকোনো উপলক্ষে দোকানে কাজ না করার ছুটি পাওয়া যায়, তবে সে দিনটা তো কাঞ্চননির্মিত মৃগ। তাই ছুটির এ দিনটা পুরোপুরি আমোদপ্রমোদের সঙ্গে উপভোগ করার জন্য নিকিউ তিতের এত আয়োজন।
পরদিন সকাল ছয়টায় স্মার্টফোনে ক্রিং ক্রিং বেলে ঘুম ভেঙে গেল তিতের। যদিও এ রাতটা ছিল তার জন্য অতিশয় লম্বা। ভাবাবিষ্ট তিতের কাছে আবেগকম্পিত রাতটা আজ যেন শেষ হওয়ার নয়। উতলা মনে তিতের উদ্দীপিত রাতে নিদ্রা ভেঙেছে দণ্ডে দণ্ডে পই পই।
নিকিউ তিত বিছানা ছেড়ে আনুষঙ্গিক কাজকর্ম শেষ করে নতুন পোশাক পরে রওনা দিল হাসপাতালের দিকে। নতুন শার্ট, প্যান্ট, জুতা, টুপি আর নতুন চশমা লাগিয়ে যখন হেঁটে চলছে, তখন সে নিজেকে বারবার দেখছে। নিজেকে একটা স্মার্টফোনের চেয়েও বেশি স্মার্ট ভাবছে।
আজ বোধ হয়, সারা দিন ডিউটি করতে হবে নিকিউ তিতের বসকে। সেই কষ্টে বসের মন একটুও ভালো নেই। হাসপাতাল থেকে তিত না ফেরা পর্যন্ত বসের আর কোনো অবস্থায় দোকান থেকে বের হওয়া সহনসাধ্যতেও সম্ভব হচ্ছে না। সকাল সাতটার আগেই বস দোকান খুলে বেচাকেনা শুরু করে দিয়েছেন। কারণ, বস অবহিত আছেন যে হাসপাতালে যাওয়ার কারণে আজ তিতের পক্ষে দোকান খোলা সম্ভব হবে না। বস মনঃকষ্ট নিয়ে দোকান চালাচ্ছেন। স্মিত বা হাসির মধ্যে কোনো স্লিম নেই, হাসিগুলো আজ খসখসে।
তিত যাওয়ার সময় বসের কাছ থেকে বিদায় নিল। বস মনের দুঃখে আধো দৃষ্টিতে তিতের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কাজ শেষ হলে তাড়াতাড়ি ফিরে এসো।’ তিত ছোট্ট করে জবাব ‘আচ্ছা’ বলে বের হয়। তিতের সাজগোজের হাবভাব দেখে বস হয়তো মনে মনে নিশ্চয়ই বলেছেন, নোকিয়া টেন যে ভাবে হাবভাব নিছে, তাতে মনে হচ্ছে আইফোন ফোর্টিন।
তিত হাসপাতালে পৌঁছে নিয়ম অনুযায়ী লাইনে দাঁড়িয়ে হাসপাতালের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের কথামতো ধাপে ধাপে সব কাজ করে যাচ্ছে। কাজের মধ্যে আছে হাসপাতালে নাম লিপিবদ্ধ করা, ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করা, বিভিন্ন টেস্ট সম্পন্ন করা, টেস্ট নিয়ে আবার ডাক্তারের কাছে যাওয়া, প্রেসক্রিপশন নিয়ে হাসপাতাল ফার্মেসি থেকে ওষুধ সংগ্রহ করা ইত্যাদি। এসব সম্পন্ন করতে কোনো টাকাপয়সা খরচ হয় না। শুধু ধৈর্য ধরে কাজগুলো করতে হয়।
এত সময়ে তিতের বস ডিউটি করতে করতে নিশ্চয় ক্লান্ত। শারীরিকভাবে ক্লান্ত না হলেও মানসিকভাবে ক্লান্ত না হয়ে পারেন না। তাই তো এরই মধ্যে দুবার ফোন দিছেন তিতকে। ফোন করার মূল উদ্দেশ্য একটাই; কখন বা কত সময় পরে তিত দোকানে আসতে পারে, তারই একটা ধারণা নেওয়ার চেষ্টা।
বিকেল চারটা বেজে গেছে। হাসপাতালে ডাক্তারদের পাশাপাশি প্যাথলজিক্যালের কাজ শেষ হয়েছে। যাদের ওষুধ দিতে বাকি আছে, শুধু তাদের জন্য ফার্মেসি খোলা আছে। সেখান থেকে তাদের সবাইকে একে একে ফ্রি ওষুধ দিচ্ছে। সুতরাং আরও এক ঘণ্টা সময় লেগে যাবে বলে অনুমান করা যায়।
চারটা বাজার পরপরই বস তিতকে আবার ফোন দিছেন। কারণ, তিত এখনো দোকানে ফিরে আসেনি। বসের ধারণা, হাসপাতালের কাজ শেষ করে তিত দোকানে না এসে অন্য কোথাও সময় কাটাচ্ছে। বসের ফোন রিসিভ করে তিত। বসকে বর্তমান অবস্থানের কথা জানাল তিত। তখন সে হাসপাতালের ফার্মেসির সামনে কিছু ওষুধ নেওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। বসকে বিস্তারিত জানানো হলো তিতের পক্ষ থেকে। পক্ষান্তরে বসের ভাষ্য ছিল, এখনো কি হাসপাতাল খোলা আছে? এখন তো চারটার বেশি বাজে, গেট তো বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা, এ সময় তো হাসপাতালে একটা গরু, ছাগলও থাকার কথা নয়, আচ্ছা তাড়াতাড়ি চলে এসো।
বসের এমন মন্তব্যে হতাশ হলো তিত। সকাল থেকে না খেয়ে থাকায় ক্ষুধার্ত তিতের পেটে পাথর জমা হলো। নতুন জামাকাপড়ে মনোবল বাড়ানো তিতের চোখে অন্ধকার, মুখে আঠা। নতুন চশমা এখন আর আলো দিচ্ছে না। ওষুধ নেওয়ার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা তিত মনের দুঃখে রুম থেকে বের হয়ে চোখ থেকে চশমা খুলে ছুড়ে ফেলে পা দিয়ে পিষে ভেঙে দিল। মাথার ক্যাপটা ফেলে দিল ডাস্টবিনে।
ওষুধ নিয়ে মাথার টাক বের করে হেলেদুলে দোকানে এল তিত। বস দেখে একটা গোপন দীর্ঘশ্বাস ফেলে ক্লান্ত শরীরে সতেজতা আনলেন। তিত দ্রুতগতিতে নাকে–মুখে খেয়ে দোকানে এল। তারপর বস দোকান থেকে চলে গেলেন।
হাসপাতাল থেকে ডাক্তার পর্যালোচনা করে ব্যবস্থাপত্র দিলেন। পাশাপাশি তাকে আবার হাসপাতালে যাওয়ার জন্য একটা তারিখ দিলেন। কিন্তু তিত মানসিকভাবে সিদ্ধান্ত নিল সে আর হাসপাতালে যাবে না। কারণ, সে আর অন্যের বিরক্তির কারণ হতে চায় না। তাতে যদি রোগ খারাপের দিকেও চলে যায়, তবুও চাকরি করা অবস্থায় সে আর ডাক্তার দেখাতে যাবে না।
এই তিতের মতো বহু কর্মচারী আছেন, যাঁরা দিনের পর দিন এমন অসুখ নিয়ে ডিউটি করছেন। বসের পরিষ্কার বা ক্লিন অনুমতি বা ছুটির অভাবে বা সুযোগ না থাকার কারণে ডাক্তার দেখাতে যেতে পারেন না। তাঁদেরকে নানাবিধ রোগ নিয়ে বছরের পর বছর ডিউটি করতে হচ্ছে। চিকিৎসা করার মতো সপ্তাহে, মাসে বা বছরে একটা দিন ছুটির বড়ই ঘাটতি।