পতাকা
অগ্রণী প্রাইমারি স্কুলের হেডমাস্টার মনতাজ আলী সাহেব সকাল থেকেই পায়চারি করছেন উনার অফিসে। দেখে মনে হচ্ছে কোনো একটা বিষয় নিয়ে তিনি খুবই চিন্তিত। একধরনের উদ্বেগ কাজ করছে উনার মনে। ডিসেম্বর মাস, শীতের সকাল অথচ মনতাজ আলী সাহেব ক্রমাগত ঘামছেন। ডাকপিয়ন সকালে একটি চিঠি দিয়ে গেছে। সেটি পড়ার পর থেকেই মনতাজ আলী সাহেবের এ অবস্থা। চিঠিটি তিনি এ পর্যন্ত ১১ বার পড়ে ফেলেছেন।
সকল শিক্ষকদের ডেকে পাঠিয়েছেন উনার অফিসে। শিক্ষকেরা বুঝে উঠতে পারছেন না কি হয়েছে। শুধু একে অন্যের দিকে তাকাচ্ছেন। সবার উৎকণ্ঠা দূর করে মনতাজ আলী সাহেব উনার হাতের চিঠিটি শিক্ষকদের দেখালেন। চিঠিটি এসেছে উপজেলা শিক্ষা অফিসারের কাছ থেকে। আগামী ৩ দিন পর ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের দিন শিক্ষা অফিসার অগ্রণী প্রাইমারি স্কুল পরিদর্শন করবেন এবং নিজ হাতে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করবেন। খবরটি শুনে শিক্ষকদের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হলো কিন্তু সবার চোখে মুখে একধরনের খুশির ঝিলিক। উপজেলা শিক্ষা অফিসার স্কুলে আসবেন, এটা কি কম কথা! কিন্তু মনতাজ আলী সাহেব যে জন্যে চিন্তিত, তা হলো হাতে সময় আছে মাত্র তিন দিন। অনেক আয়োজন বাকি। এবারের বিজয় দিবস তো আর অন্য বছরের মতো পালন করলে হবে না। শিক্ষা অফিসার থাকবেন। স্কুলের একটা ইজ্জত আছে না!
মনতাজ সাহেব শিক্ষকদের উদ্দেশ্যে বললেন, আপনারা এখন থেকেই কাজে নেমে পড়েন। ক্রীড়া শিক্ষক আফিয়া ম্যাডামকে দায়িত্ব দিলেন খেলাধুলার ব্যাপারটা দেখার জন্য, আর সঙ্গে পিটি এবং দলীয় জাতীয় সংগীতের প্রস্তুতি। খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারটা মনতাজ সাহেব নিজেই নিলেন। কারণ, তিনি নিজেও খুব ভোজনরসিক। উনার সবচেয়ে প্রিয় খাবার হচ্ছে গিন্নীর হাতের ইলিশ মাছের শর্ষে বাটা। খুব ইচ্ছা ছিল শিক্ষা অফিসারকে ইলিশ মাছের শর্ষেবাটা খাওয়াবেন কিন্তু উনাকে কি আর মাছের তরকারি দিয়ে খাওয়ানো যায়! শিক্ষা অফিসার বলে কথা! উনিতো খাবেন মুরগির রোস্ট আর খাসির রেজালা দিয়ে। ধর্ম শিক্ষক আরশাদ হোসেনকে বললেন, পতাকা উত্তোলনের পর মোনাজাত করতে। ভালো কাজে আল্লাহকে স্মরণ করব না, তা কেমনে হয়। একটু ভিন্ন কিছু করার জন্য তিনি সঞ্জয় স্যারের দিকে তাকালেন। সঞ্জয় স্যার যদিও বিজ্ঞানের শিক্ষক কিন্তু ভালো কবিতা লেখেন। আর সেই কবিতা মনতাজ সাহেব খুব আগ্রহ নিয়ে শোনেন এবং ঠাট্টা করে বলেন, আপনি বিজ্ঞানের শিক্ষক না হয়ে বাংলার শিক্ষক হলে ভালো হতো! সঞ্জয় স্যারকে একদিন দাওয়াত দিয়ে বাড়িতে নিয়ে গেলেন। বললেন আমার গিন্নীর হাতের চারটা ডালভাত খাবেন আর খাওয়ার পর আপনার কবিতা শোনাব। সঞ্জয় স্যার ডাল ভাতের সঙ্গে মনতাজ সাহেবের গিন্নীর হাতের শর্ষে ইলিশও খেলেন। সে দিন সঞ্জয় স্যারের কবিতা শোনে মনতাজ সাহেব চোখের পানি ধরে রাখতে পারলেন না।
সঞ্জয় স্যার বললেন আমরা একটা দেয়ালপত্রিকা বের করতে পারি যেখানে স্কুলের ছেলে–মেয়েদের লেখা আর চিত্রাঙ্কন থাকবে। মনতাজ সাহেব বললেন আইডিয়াতো খারাপ না। অবশ্য এর আগেও বর্ষাপত্র নামে একটি দেয়াল পত্রিকা বের হয়েছিল যেটি ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ব্যাপক সারা ফেলেছিল। তিনি ইংরেজির শোভন স্যারকে বললেন আপনি সঞ্জয় স্যারের সঙ্গে মিলে দেয়ালপত্রিকার কাজ শুরু করে দিন। মনে রাখবেন, ইংরেজিতেও যেন দু–একটা লেখা থাকে। তাতে শিক্ষা অফিসার সাহেব খুশিই হবেন।
বিজয় দিবসের আগের দিন সকালে মনতাজ সাহেব শিক্ষকদের নিয়ে আবার বসলেন এবং কাজের অগ্রগতি দেখলেন। সবার কঠোর পরিশ্রমে একটি ভালো আয়োজন হবে বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু সমস্যা একটি রয়েই গেল। আর তা হলো পতাকা। স্কুলের যে পতাকাটি আগামীকাল শিক্ষা অফিসার সাহেব ওড়াবেন, সেটি গত কয়েক দফা ব্যবহারে ময়লা হয়ে আছে। সবাই অন্যান্য কাজ নিয়ে এত ব্যস্ত যে পতাকাটি পরিষ্কার করা বা নতুন পতাকা কেনার ফুরসতই মিলছে না। অংকের ফজলুর স্যার মনতাজ সাহেবকে বললেন আমরা একটা কাজ করতে পারি। পতাকাটি ধুয়ার দায়িত্ব আমাদের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে কাউকে দিয়ে দিতে পারি। তারা এটিকে ধুয়ে শুকিয়ে কাল সকালে নিয়ে আসবে। মনতাজ সাহেব বললেন, তবে তা–ই হোক।
স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের একত্রিত করা হয়েছে একটি দায়িত্ব দেওয়ার জন্যে। দায়িত্বটা খুবই সাধারণ। স্কুলের জাতীয় পতাকাটিকে ধুয়ে শুকিয়ে আনতে হবে। ছেলেমেয়েরা মহা আগ্রহে এসে জড়ো হয়েছে। এদের মধ্যে সূর্য আর পাতা যমজ ভাইবোন। দুজন একই ক্লাসে পড়ে। যেহেতু তারা দুজন একই বাড়িতে থাকে, তাই দায়িত্বটা তাদের ওপরই পড়ল।
সূর্য আর পাতার সময় কাটছে না। অপেক্ষায় থাকে কখন ক্লাস শেষ হবে আর ওরা পতাকা নিয়ে বাড়ি ফিরবে। স্কুল শেষে আনন্দচিত্তে পতাকা নিয়ে তারা বাড়ি ফিরল। বাড়ি ফিরে ওরা ওদের মা কে বলল, কাল স্কুলে লাল আর সবুজ রঙের ড্রেস পরিয়ে দিতে। পতাকার সঙ্গে মিল রেখে ওরা ড্রেস পরবে। ওদের মা পুরো কথা শুনে বললেন দে পতাকাটা আমি ধুয়ে দিচ্ছি। কিন্তু না ওরা নিজেরা করবে। কল পাড়ে সাবান দিয়ে ভালো করে পতাকাটিকে ধুয়ে রোদে শুকাতে দিল দুজন। ওদের মা ভাত বেড়ে খেতে ডাকলেন কিন্তু ওরা পতাকার পাশে বসে থাকলো আর অপেক্ষা করতে থাকলো কখন শুকাবে। পতাকাটি শুকানোর পর সূর্য আর পাতা ঘরে বসে থাকতে পারল না। মামার দেওয়া সাইকেলটা নিয়ে দুজনে বেরিয়ে পড়ল। সূর্য সাইকেল চালাচ্ছিল আর পাতা সাইকেলের পেছনে বসে পতাকাটি উড়িয়ে বাংলাদেশ বাংলাদেশ বলে বাড়ির পাশের রাস্তা দিয়ে সবাইকে দেখাচ্ছিল। ওদেরকে দেখে মনে হচ্ছে, এর চেয়ে খুশির আর এর চেয়ে আনন্দের কাজ ওরা জীবনে করেনি। কিন্তু ওদের এই খুশি আর আনন্দ বেশিক্ষণ থাকল না। দুজনেরই মুখ ভীত আর চোখে পানি। সাইকেল চালানোর সময় হঠাত করে পতাকাটি সাইকেলের পেছনের চাকায় পেঁচিয়ে যায় এবং ছিঁড়ে দুই জায়গায় ফুটো হয়ে যায়। সূর্য পাতা দুজনে চিন্তায় আর ভয়ে অস্তির! এখন কি হবে! কি করবে তারা। কাল স্কুলে ওরা কি নিয়ে যাবে! ওদের বাবা মা শুনলেতো ওদের আস্ত রাখবেন না! দুজন চুপচাপ বাড়ি ফিরল। পতাকা ছেঁড়ার ব্যাপারে কাউকে কিছুই বলল না তারা। সে রাতে দুজনেরই ঘুম হল না। পতাকা ছেঁড়ার দুঃস্বপ্ন ওদের তাড়া করে বেড়াল।
আজ ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস। মনতাজ সাহেব ফজরের নামাজ পড়েই সূর্য উঠার সঙ্গে সঙ্গে স্কুল পৌঁছালেন। শিক্ষকেরাও আজ আগে আগে স্কুলে পৌঁছে গেলেন। ছেলেমেয়েরাও আসতে শুরু করেছে। সব প্রস্তুতি দেখে মনতাজ সাহেব খুবই খুশি। সময়মতো পতাকাটা হাতে চলে এলে আর কোনো চিন্তা থাকবে না। সূর্য আর পাতা লাল সবুজের ড্রেস পড়ে পতাকা নিয়ে বের হলো। ওদের মন ভালো নেই। মায়ের বার বার জিজ্ঞাসার পরও ওরা কিছুই বলল না।
শিক্ষা অফিসার সাহেব এসে পৌঁছেছেন। মনতাজ সাহেবকে খুবই ব্যস্ত দেখা গেল। শিক্ষা অফিসার সাহেবের পরিদর্শন কালে কোন ত্রুটি হোক সেটা তিনি হতে দেবেন না। অবশেষে পতাকা উত্তোলনের সময় চলে এলো। উত্তোলনের ঠিক আগ মুহূর্তে সূর্য আর পাতা পতাকা নিয়ে পৌঁছায়। পতাকাটি স্যারের হাতে দিয়ে ওরা ভয়ে ভয়ে গিয়ে লাইনে দাঁড়ায়। পতাকা তোলা হয়। সঙ্গে সঙ্গে ছাত্রছাত্রীরা দলীয় জাতীয় সংগীত গাওয়া শুরু করল। আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি…। কিন্তু অবাক কাণ্ড! পতাকায় ছিঁড়ে যাওয়ার কোনো চিহ্নই নেই! কেবল পাতার সবুজ স্কার্ট এর একটি কোনা ছেঁড়া। আর ছেঁড়া সূর্যের লাল জামার বুকের বাম পাশটা। সূর্য আর পাতা ভয়ে ভয়ে আড়চোখে পতাকার দিকে তাকাল। তারা দেখল, পতাকাটি মাথা উঁচু করে পত পত করে উড়ছে।
*লেখক: অপু ইসলাম, লন্ডন, যুক্তরাজ্য
দূর পরবাসে লেখা, ভ্রমণ কাহিনি, গল্প, নানা আয়োজন পাঠান [email protected] এ