সান্তা অ্যানা, প্রাণনাশী আগুনঝড়
মেরির সঙ্গে আমার পরিচয় যুক্তরাষ্ট্রের নর্দান ক্যালিফোর্নিয়ায়। এক ট্রেনিংয়ে আমি তখন সানহোসেতে। সে আমার বছর দুয়েকের ছোট। ভীষণ পরিশ্রমী একটি মেয়ে। কিছু বলার আগে কাজ করে ফেলে। বন্ধুত্ব হয়েছিল তখন তার সঙ্গে।
ছয় মাস আগে শুনলাম, আমাদের হাসপাতালে মেরি জয়েন করতে চায়। খুশি হলাম খুব। তাকে তো চিনি। কিন্তু জয়েন করল সে পার্টটাইম। ফুলটাইম অফার পাওয়ার পরও সে না করে দিল। কখনো আসে, কখনো আসে না। কাজ করে, কিন্তু তার মন কোথায় যেন পড়ে আছে। এই মেরিকে আমি চিনি না। গত সপ্তাহে আমাদের লোকাল বিদ্যুৎ কোম্পানি বেশ কয়েকবার সতর্কবার্তা পাঠাল, বিদ্যুৎ বন্ধ করে দিতে পারে, যদি আগুন লাগার আশঙ্কা থাকে। মেরির মুখ দেখি অন্ধকার। এরপর সোমবার সকালে লস অ্যাঞ্জেলেস এলাকায় ভয়াবহ আগুন লাগল। ওই দিন দেখি আমি কাজে পৌঁছানোর আগেই মেরি বসে আছে। বললাম, কী, খবর ভালো?
মেরি কাঁদতে শুরু করল অঝোর ধারায়। কী করব? টিস্যু এগিয়ে দিতে হাত ধরে বসে থাকলাম ১০ মিনিট। সে বলল, ১০ বছর আগে এ রকম এক আগুনে তার মা মারা গেছেন। আগুন এত তাড়াতাড়ি তাঁর বাসা পুড়ে শেষ করেছে, তিনি বের হওয়ার সময় পাননি। মেরি বলল, ‘আমি কেন কাজ করব? কার জন্য কাজ করব, বলো? মা তো আমার অনুপ্রেরণা ছিলেন।’ কি অসম্ভব কষ্ট। বাইরে সান্তা অ্যানা ঝড়, আমার শহর সান দিয়েগোতে এ ঝড়ের তাণ্ডব অনেক কম তবু...
সান্তা অ্যানা ইন ল্যান্ডে তৈরি হওয়া শুষ্ক ঝড়, যেটার তাণ্ডব শুরু হয়েছে সোমবার থেকে যখন আগুন লেগেছে লস অ্যাঞ্জেলেস শহরে। এ বছর রেকর্ডকালীন কম বৃষ্টি হয়েছে। এই শুষ্ক ঝড়, যার গতিবেগ ৬০ থেকে ১০০ মাইল, এ তাণ্ডবে লস অ্যাঞ্জেলেস কাউন্টিতে আগুন নেভানো অসম্ভব হয়ে পড়েছে। প্যালেসেইডস ফায়ার, ইটন ফায়ার দিয়ে শুরু, এরপর কেনেথ ফায়ার, হার্সট আর লিডিয়া উায়ারে পর্যন্ত ১০ জন মানুষ মারা গেছেন, হাজার হাজার একর জায়গা এবং প্রায় পাঁচ হাজার বা আরও বেশি স্থাপনা ভষ্ম হয়েছে। কিছু মানুষকে সরিয়ে নেওয়ার মতো সময় পাওয়া যায়নি। ঝড় এত তুমুল বেগে এসেছে, সঙ্গে আগুন।
সেলিব্রিটিসহ সাধারণ মানুষের সারা জীবনের স্বপ্ন নিমেষে ধুলায় মিশে গেছে। অন্ধকার একটা শহর এখন লস অ্যাঞ্জেলেস। যাঁরা বাসায় আছেন, এয়ার পিউরিফায়ার দিয়ে, জানালা বন্ধ করে স্বাভাবিক দিনের অপেক্ষায় আছেন। বেশি এক্সারসাইজ না করা বা পানি খেতে বলা হচ্ছে ফায়ার ডিপার্টমেন্ট থেকে। হাজারো মানুষকে দ্রুত সরিয়ে নিতে বলা হয়েছে। অচেনা মানুষ খুলে দিয়েছেন দরজা মানবসেবায়। সব স্কুল বন্ধ করা হয়েছে। আজ (শুক্রবার) সান্তা অ্যানার গতি কমবে না। শনি বা রোববারে কমবে, সোমবারে আবার বেড়ে যাবে। অগ্নিনির্বাপণকর্মীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আগুন নেভানোর কাজে নেমেছেন। জীবন আসলেই পদ্মপাতার পানি।
কেন আগুন লেগেছে, ব্যাপারটা তদন্ত করা হচ্ছে। আর্সেন বা মানসিক রোগগ্রস্ত কিছু লোক বিনা কারণে আগুন লাগায়। আবার সিগারেট না নিভিয়ে বেখেয়ালে ফেলে দিলেও আগুন লাগে। আবার কোনো যন্ত্র ম্যাল ফাংশন করলেও আগুন লাগে। দেখা যাক, স্মরণকালের ভয়াবহ আগুনের উৎস কী?
লস অ্যাঞ্জেলেসবাসী, আল্লাহ আপনাদের হেফাজত করুন। যতবারই সান দিয়েগো গ্যাস ও বিদ্যুৎ থেকে সতর্কবার্তা পাচ্ছি, যেকোনো সময়ে বিদ্যুৎ বন্ধ হয়ে যেতে পারে অনির্দিষ্টকালের জন্য, একটা হার্টবিট মিস করছি। আগামী পাঁচ দিন সান্তা অ্যানা তাণ্ডব চালাবে। অগ্নিনির্বাপণকর্মী, দ্রুত প্রক্রিয়াশীল ব্যক্তিরাসহ কাছের–দূরের সবাই ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন। আমাদের জন্যও দোয়া করবেন।