কোরিয়ায় সামাজিক জীবন যেমন

‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

ছবি: লেখকের পাঠানো

দক্ষিণ কোরিয়া শিল্প–সংস্কৃতি এবং সামাজিক জীবনে অত্যন্ত উন্নত। এ দেশের সামাজিক বন্ধন অত্যন্ত দৃঢ় ও মজবুত। এদের একজনের জন্য আরেকজনের মায়া–মমতা–ভালোবাসা অত্যন্ত বেশি।

আমার নিজের চোখে দেখা কিছু ঘটনা আজ আপনাদের কাছে তুলে ধরছি। আশা করছি আপনারা মনোযোগ দিয়ে শুনবেন।

ইনচন রেলস্টেশন থেকে আমি পিয়ন টেক যাব। পাতালরেলে সিঁড়ি বেয়ে উঠানামা করতে হয়। আমি স্টেশনের রাস্তায় হাঁটছিলাম, তখন সিঁড়ির নিচে দেখলাম একজন মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন, উঠতে পারছেন না। আমি একটু কৌতূহলী হয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম, কী হয় মহিলার সঙ্গে। কোনো সঙ্গী ছিল না, হঠাৎ করে দেখলাম, কোথা থেকে একজন ভদ্রলোক এল। এসেই উনাকে কাঁধে তুলে নিল এবং সিঁড়ি পেয়ে ওপরে চলে গেল। এই হল কোরিয়ার মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা। মহিলা এই পুরুষের কাঁধ থেকে নেমে মাথা নুইয়ে বারবার তাকে সম্মানসূচক ভাষায় বলছিল খামচামিধা। আমি অবাক হয়ে চেয়ে চেয়ে দেখলাম আর ভাবলাম, ‘মানুষ মানুষের জন্য’ এ গানটা শুধু কোরিয়াতে শোভা পায়। মানানসই এমন অনেক ঘটনার সাক্ষী আমি নিজে। কয়টা বলব!

সামাজিক বন্ধন দক্ষিণ কোরিয়াতে অপরিচিত কারও সঙ্গে দেখা হলেই আগে জিজ্ঞাসা করবে, আপনার বয়স কত। যদি বয়স সমান সমান অথবা ২/১ বছর কম বেশি হয়, তাহলে আপনাকে সে বন্ধু হিসেবে মেনে নেবে। তেমনি আমার খুব কাছের বন্ধু কিম হার্ক সু। আমরা সমবয়সী, তাই আমার সঙ্গে খুব ভাব। শনিবারে কাজের শেষে দুজন সমুদ্র পাড়ে বেড়াতে যাওয়া বড়শি দিয়ে মাছ ধরা আমাদের রুটিন। সমুদ্রে বড়শি ফেলে যে মাছ ধরবে, সব আমাকে দিয়ে দেবে, সে নিজে নেবে না। প্রায় রোববারেই তার বাসায় দাওয়াত থাকে। সে খুব ভালো করে বুঝে গেছে, আমাদের বাংলাদেশের খাবার কেমন। তাই কোরিয়ান কিছু খাবার আছে, বাংলাদেশের মোরগের মাংসের তরকারির (মত তাক তুরি তাক) মতো, প্রায়ই বাসায় এই আইটেম করে এবং গরু ও সমুদ্রের মাছের বারবি কিউ তো থাকেই। বন্ধুর বউও অত্যন্ত আন্তরিক মেহমানদারিতে।

ছবি: লেখকের পাঠানো

বিভিন্ন বাজারে বিকালের দিকে গেলে দেখা যায় সমবয়সী বৃদ্ধরা একসঙ্গে বসে গল্প–গুজব করছে, সঙ্গে তাদের প্রিয় পানীয় সুজু (বাংলা মদ) থাকে। এটা তাদের জাতীয় পানীয়, যা জন্মের প্রথম দিন থেকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ব্যবহার করা হয়।

ঐতিহ্যবাহী পারিবারিক জীবনচক্রের মাইলফলক চিহ্নিত করার আচার-অনুষ্ঠান এবং ছুটির দিন এবং পূর্বপুরুষদের আচার-অনুষ্ঠান পালনের সঙ্গে এটা অনেকাংশে জড়িত। একজন ব্যক্তির জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো শিশুর প্রথম ১০০ দিন সমাপ্তি, তার বিবাহ এবং তার ৬১তম জন্মদিন। ঐতিহ্যবাহী কোরিয়ান বিশ্বাস অনুসারে, মৃত ব্যক্তির আত্মা কয়েক প্রজন্ম ধরে পৃথিবী ছেড়ে যায় না; তাই মৃত পিতা–মাতা এবং দাদা-দাদিকে এখনো পরিবারের অংশ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। মৃত্যুবার্ষিকী এবং প্রধান ছুটির দিনে তাদের সম্মান জানাতে পৈতৃক আচার-অনুষ্ঠান করা হয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি ছুটির দিন হলো চান্দ্র নববর্ষ এবং চুসিওক (ফসলের চাঁদ উৎসব, যা প্রায়ই কোরিয়ান থ্যাংকসগিভিং নামে পরিচিত), উভয়ই চন্দ্র ক্যালেন্ডার অনুসারে পালিত হয়। এই উৎসবগুলো পূর্বপুরুষদের নিজ শহরে বা পরিবারের প্রধানের বাড়িতে পরিবারের সমাবেশ দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। ছুটির উদ্‌যাপনের ঐতিহ্যবাহী উপাদানগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রবীণদের আনুষ্ঠানিক, শ্রদ্ধাশীল অভিবাদন, বিশেষ ধরনের ভাতের কেকের মতো বিশেষ খাবার প্রস্তুত এবং খাওয়া এবং ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরা (হ্যানবক )।

হাজার বছর ধরে কোরিয়ানদের দৈনন্দিন পোশাক ছিল হ্যানবক। এখন প্রায় সর্বত্রই পশ্চিমা পোশাক হ্যানবকের স্থান দখল করে নিয়েছে, কিন্তু এমনকি নগরবাসীরাও এখনও গুরুত্বপূর্ণ পারিবারিক সভা, ছুটির দিন, বিবাহ এবং অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার মতো বিশেষ অনুষ্ঠানে এটি পরেন। মহিলা এবং মেয়েদের আনুষ্ঠানিক হ্যানবকের মধ্যে রয়েছে রঙিন, লম্বা ঝাঁকুনিপূর্ণ স্কার্টের নিচে বেশ কয়েকটি স্তরের অন্তর্বাস এবং লম্বা টাই দিয়ে বন্ধ করে রাখা ছোট জ্যাকেট। পুরুষ এবং ছেলেদের সংস্করণে রয়েছে পূর্ণ-পাওয়ালা প্যান্ট এবং একটি দীর্ঘ, চওড়া-হাতা জ্যাকেট। বিবাহ, শিশুদের জন্মদিন এবং ৬১তম জন্মদিন উদ্‌যাপনের মতো বিশেষ অনুষ্ঠানের জন্য বিভিন্ন ধরনের হ্যানবক রয়েছে।

কিমচি

কিমচি বায়েচু (চাইনিজ বাঁধাকপি) কিমচি এবং ভাত। কোরিয়ান সাংস্কৃতিক পরিচয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো এ খাবার। এমনকি সবচেয়ে পশ্চিমা শহুরে বাসিন্দাদের খাদ্যতালিকায় এ খাবার থাকে। একটি কোরিয়ান খাবারে সাধারণত ভাত, স্যুপ বা স্টু এবং বেশ কয়েকটি পার্শ্ব–খাবার থাকে। জাতীয় খাদ্যতালিকায় কিমচির গুরুত্ব এতটাই যে আনুমানিক ১৬০ বা তারও বেশি জাত চিহ্নিত করা হয়েছে এবং সিউলে এই খাবারের জন্য নিবেদিত একটি জাদুঘর রয়েছে। সবচেয়ে সাধারণ ধরন হল মসলাদার বায়েচু (চীনা বাঁধাকপি) কিমচি। যদিও আজকাল অনেক পরিবার তাদের বেশির ভাগ কিমচি সুপারমার্কেট থেকে কিনে, তবুও অনেকে তাদের নিজস্ব তৈরি করে।

ছবি: লেখকের পাঠানো

কিমজাং-এর ঐতিহ্যবাহী প্রথা, যেখানে গ্রাম এবং পরিবারগুলো শরৎকালে শীতকালীন কিমচির সরবরাহ প্রস্তুত করার জন্য বেশ কয়েক দিন ব্যয় করে, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর গোয়াংজুতে অনুষ্ঠিত বার্ষিক কিমজাং উৎসবে উদ্‌যাপিত হয়। অন্যান্য জনপ্রিয় কোরিয়ান খাবার হল বিবিম্বাপ (সবজি, ডিম, একটি মসলাদার সস এবং কখনো কখনো মাংসের সঙ্গে মিশ্রিত ভাত), জাজাংমিয়ন (কালো-শিমের সসে নুডলস), বুলগোগি (কয়লার ওপর ভাজা মাংস), এবং সামগিয়েটাং (ভাত এবং জিনসেং দিয়ে ভরা পুরো মুরগির স্যুপ), যা পুনরুদ্ধারকারী হিসাবে খাওয়া হয়, বিশেষ করে গরম আবহাওয়ায়।