তোমরাই আমাদের বাংলাদেশ
কিছুক্ষণ পরপর ভয়ে ভয়ে ফেসবুক বা ইউটিউবের ভিডিওগুলো দেখছি। সারাক্ষণ একটা ভয় ঘিরে রাখছে, আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী ছেলে–মেয়েদের কী হবে! ভীষণ অসহায় লাগছে! আবু সাঈদের মা–বাবার কথা, পরিবারের কথা ভাবতেও পারছি না!
এই ছেলে–মেয়েগুলো তো কোনো অপরাধ করেনি, নিজেদের ভবিষ্যতের পরিকল্পনা নিয়ে একটা দাবি তারা তুলতে পারবে না? তারা নিজেদের দাবি যৌক্তিকভাবে তুলে না ধরলে কারা বলবে তাদের কথা?
এই অনিশ্চয়তার মধ্যেও আবার এই ছেলে–মেয়েদের ভয়াবহ সাহস দেখে কী অদ্ভুত একটা সাহস পাচ্ছি।
সব সময় দুর্নীতির খবর দেখে দেশের প্রতি যে একটা শঙ্কা কাজ করত, কেন জানি সেটা কেটে যাচ্ছে!
ছোট ছোট মেয়েরা, এমনকি স্কুলের ছাত্রীরাও কী সুন্দর করে নিজেদের অধিকার যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছে! এত এত খারাপ খবর, ভয়াবহ দুর্নীতি, প্রশ্নপত্র ফাঁস—এত কিছুর মধ্যেও এক চেতনার দেশ দেখছি যেন!
কেন জানি মনে হলো, তাঁদের বয়সে আমি কী করছিলাম? মনে পড়ে, স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনের শুরুর দিকে আমার বাবার আহ্বানে টাঙ্গাইল জেলায় আন্দোলন শুরু হয়। আন্দোলনের কারণে ৪০–৫০টি মামলা নিয়ে আমার বাবা একজন আইনজীবী তখন দিনের পর দিন পালিয়ে থাকতেন।
আমি আর আমার মা সন্ধ্যায় বাবাকে খুঁজে বেড়াতাম। তখন সেলফোন ছিল না, মাঝেমধ্যে ল্যান্ডফোনে ফোন দিয়ে আব্বা জানাতেন, ভালো আছেন, বেঁচে আছেন। আমাকে আর ছোট ভাইকে বিছানায় রেখে আম্মা সারা রাত জেগে থাকতেন! আজকের এই দিনেও হয়তো অনেক মা নির্ঘুম বসে আছেন আন্দোলনকারী ছেলের পথ চেয়ে! কোনো মা হয়তো জাহানারা ইমামের মতো তুলে রাখছেন একেকটা দিনকে তাঁর দিনলিপির পাতায়।
স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সেই দিনে আমি এই স্কুলের মেয়েদের মতো রাস্তায় এসে দাঁড়ানোর কথা ভাবতে পারিনি, এত সুন্দর করে বড় ভাই–বোনদের দাবিকে সমর্থন জানাতে পারিনি! এই স্কুলের বাচ্চাদের সমর্থন দেখে সারা দিন চোখ ভিজে যাচ্ছে অকারণে! শুধু এই আন্দোলন নয়, জীবনের কোনো ক্ষেত্রেই তোমাদের কেউ বৈষম্য দেখাতে পারবে না! তোমাদের চিন্তাধারা তোমাদের চলার পথের সব বৈষম্যমূলক আচরণ ছুড়ে ফেলবে!
বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে আমাদের সময় বুয়েটে সাবেকুন নাহার সনি হত্যার পরও আমি তোমাদের মতো করে রাস্তায় এসে এভাবে আন্দোলন করতে পারিনি! আজকের দিনে বেসরকারি ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের এই ঐক্য ১৯৫২, ’৭১, ’৯০–পরবর্তী আরেকটি আন্দোলন যোগ করেছে!
এই প্রজন্মের ছেলে–মেয়েরা কী পরিপক্বভাবে বৈষম্যহীন দেশের কথা বলে নির্ভয়ে রাস্তায় ঝাঁপিয়ে পড়ছে!
এরা আমাদের গৌরবের মুক্তিযোদ্ধাদের উত্তরাধিকার না হলে কারা উত্তরাধিকার? এই ছোট ছোট ছেলে–মেয়েরা কত নিঃস্বার্থ ও সাহসী হলে তাদের বন্ধুর মৃত্যুর পরও নিজেদের জীবনের কথা ভেবে বসে নেই! এরা মুক্তিযোদ্ধাদের উত্তরাধিকার না হলে কারা উত্তরাধিকার?
দেশের সার্বিক এ অবস্থায়, হতাশার এত খারাপ অবস্থার মধ্যেও একমাত্র এই প্রজন্মের সচেতনতা ও দায়িত্ববোধ দেখে এক অদ্ভুত ভালো লাগা কাজ করছে! এরাই আমাদের বাংলাদেশ, এরাই আমাদের এই যুগের যোদ্ধা!
*লেখক: গুলফাম-ই-জান্নাত, পিএইচডি, মিনিস্ট্রি অব ট্রান্সপোর্টেশন, অন্টারিও, কানাডা