ক্রিসমাস এলেই সেই মাকে খুঁজে বেড়াই

ক্রিসমাস। দিনটি যিশুখ্রিষ্টের জন্মদিন উপলক্ষে উদ্‌যাপন করা হয়। ক্রিসমাস মানে নানা স্বাদের কেক, ঘণ্টার টুংটাং আওয়াজ, উপহার, ক্রিসমাস ট্রি, সান্তা ক্লজ। কিন্তু আমি ১০ থেকে ১২ বছর ধরে ক্রিসমাস এলেই এক মাকে খুঁজে বেড়াই, যে মা ১২ থেকে ১৩ বছর আগে ক্রিসমাসের কয়েক দিন আগে একটি ইন্টারসেকশনে বসে ভিক্ষা করছিলেন। তাঁর হাতে ছিল বড় আকারের একটি হার্ডবোর্ড, যাতে লেখা ছিল খুব সুন্দর একটি পঙ্‌ক্তিমালা, একেবারে কবির ভাষায়। এ মুহূর্তে হুবহু আমার মনে পড়ছে না। তবে এটুকু আমার মনে আছে, যা লেখা ছিল তার অর্থ হচ্ছে, ‘আসছে ক্রিসমাসে আপনি আপনার ছেলে, মেয়ে, পরিবার, পরিজন নিয়ে ক্রিসমাস উদ্‌যাপন করবেন, উপহার দেবেন, ভালো খাবার খাবেন, আনন্দ উদ্‌যাপন করবেন। আমার তো ইচ্ছা হয় আপনাদের মতন আমার বাচ্চাদের নিয়ে ক্রিসমাস উদ্‌যাপন করি।’

আমি একটি হাইওয়ে থেকে নেমে লোকাল রাস্তা ধরতেই এই ইন্টারসেকশন। সেখানে লাল বাতি থাকায় গাড়ি দাঁড় করাতেই বাঁয়ে চোখে পড়ল সেই মায়ের হাতের লেখাটি। মিশিগানের ওয়ারেন সিটিতে তখন সন্ধ্যা নামছে, রাস্তার নিয়ন বাতিগুলো জ্বলতে শুরু করেছে। সেই আলোয় পঙ্‌ক্তিমালা পড়ে মনের মধ্যে মাতৃভক্তির একটা আবেগে কাজ করল। পকেট থেকে একটা ডলার বের করে দিতে চাইলাম, কিন্তু তীব্র ঠান্ডায় গাড়ির জানালার কাচ এমন শক্ত হয়েছে যে সেটা আর খুলতে পারলাম না, এদিকে সবুজ বাতি চলে আসায় অফিস থেকে বাড়ি ফেরার তাড়ায় পেছনের গাড়িগুলোর লোকজনের একসঙ্গে হর্ন দিতে থাকায় গাড়ি ধীরে ধীরে আগ বাড়াতে লাগলাম। ফলে সেই মাকে আর সাহায্য করা হলো না। কিন্তু মায়ের হাতে হার্ডবোর্ডে লেখা পঙ্‌ক্তিমালা ভুলতে পারলাম না। মনে হলো কোনো বিখ্যাত কবির বিখ্যাত দুটি লাইন।

গুগলে অনেকবার সার্চ দিয়েও সেই পঙ্‌ক্তিমালা পেলাম না, তবে সেই পঙ্‌ক্তিমালা বুকের গভীরে একটা রেখাপাত করল। পরদিন ওই ইন্টারসেকশনে গেলাম সেই মায়ের দেখা পাওয়ার আশায়। এভাবে ক্রিসমাসের দিনটি পর্যন্ত প্রতিদিন সেখানে এবং এর আশপাশে তাঁকে খুঁজি, কিন্তু তাঁর আর দেখা পেলাম না। ১০ থেকে ১২ বছর যাবৎ ক্রিসমাস এলে এটাই আমার এক রুটিন, যদি তাঁর দেখা পাই। এবার সেই মাকে বারবার খুঁজেছি সেই ইন্টারসেকশনের আশপাশে। না, পেলাম না। সারা দিনের ক্লান্তি শেষে সোফায় একটু গা এলিয়ে দিই, একটু তন্দ্রা ভাব চলে এসেছে। আমি দেখছি, সেই মায়ের ছেলেমেয়েরা বড় হয়েছে, স্কুলে–কলেজে পড়ছে, ভালো ফলা করেছে, মা–ও একটা ভালো কাজ পেয়েছেন। বেতন আর বোনাসের অর্থ দিয়ে এই ক্রিসমাস উপলক্ষে বাচ্চাদের জন্য বাজারহাটে খাবারদাবার, ক্রিসমাস ট্রি, কেক কিনতে, উপহারসামগ্রী কিনতে খুবই ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন।

ওই ইন্টারসেকশনের সামনে দিয়েই প্রতিদিন আসছেন–যাচ্ছেন। কখনো মনে হচ্ছে না সেই দুর্দিনের কথা, দুঃসময়ের কথা। একদিন ওই ইন্টারসেকশনে লাল বাতির কারণে আটকে পড়েছেন মা, ঠিক যে জায়গায় আমি একদিন আটকে পড়েছিলাম। মায়ের চোখে ভেসে এল সেসব দিনের কথা, যখন এখানে দাঁড়িয়ে ভিক্ষা করতেন।

মনে পড়ল সেই কবিতার লাইন, ‘আসছে ক্রিসমাসে আপনি আপনার ছেলে, মেয়ে, পরিবার, পরিজন নিয়ে ক্রিসমাস উদ্‌যাপন করবেন, উপহার দেবেন, ভালো খাবার খাবেন, আনন্দ উদ্‌যাপন করবেন।

আমার তো ইচ্ছা হয় আপনাদের মতন আমার বাচ্চাদের নিয়ে ক্রিসমাস উদ্‌যাপন করি।’ মা এবার সবাইকে নিয়ে ধুমধাম করে ক্রিসমাস উদ্‌যাপন করবেন। আসলে সবকিছুই নির্ভর করে সময়ের ওপর।

সময়ই সময়কে দাঁড় করিয়ে দেয় সময়ের আয়নার সামনে। তন্দ্রা ভাবটা যখন ভাঙল, তখন মনে হলো ক্রিসমাস যে এসে গেছে। ক্রিসমাস উপলক্ষে মাকে নিয়ে লেখাটা পত্রিকায় পাঠাতে হবে।