মন্ট্রিয়লে তপন চৌধুরীকে নিবেদন করে জমজমাট সংগীতসন্ধ্যা
বাংলাদেশের প্রখ্যাত শিল্পী তপন চৌধুরীকে নিয়ে গত ১৯ মে এক মনোমুগ্ধকর সংগীত আয়োজনে মুখর ছিল কানাডার মন্ট্রিয়লের বাঙালি কমিউনিটি। সংগীতসন্ধ্যাটিকে কেন্দ্র করে মন্ট্রিয়লের মেজোনেভ কলেজ অডিটরিয়ামে মিলিত হয়েছিলেন আমেরিকা, কানাডার বিভিন্ন শহরে বসবাসরত সাহিত্য সংস্কৃতি অঙ্গনের বিশিষ্ট ব্যক্তিরাও। শিল্পী তপন চৌধুরীকে সম্মান জানিয়ে এবং তাঁকে নিবেদন করে সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘লোকজ মন্ট্রিয়ল’ আয়োজন করেছিল এই সংগীতসন্ধ্যা। প্রায় চার ঘণ্টা হলভর্তি দর্শক-শ্রোতা পুরো অনুষ্ঠানটি প্রাণভরে উপভোগ করেন।
অনুষ্ঠান সাজানো হয়েছিল তপন চৌধুরী গীত গান দিয়ে। তাঁর জনপ্রিয় অসংখ্য গান থেকে বাছাই করা কিছু গান গেয়েছেন স্থানীয় শিল্পীরা, গেয়েছেন শিল্পী তপন চৌধুরীও। গান, কবিতা, নৃত্য, আর সংবর্ধিত শিল্পীর স্মৃতিচারণা—অনেকটা গীতিনকশার আদলে পরিবেশিত অনুষ্ঠানটি সারাক্ষণ মঞ্চমুখী রাখতে সমর্থ হয়েছিল দর্শকদের।
তপন চৌধুরীর সঙ্গে একঝাঁক স্থানীয় শিল্পী একটি দেশের গান করেন শুরুতেই। এরপর পরিপাট্য সূচিতে একে একে চলে গান ও অন্যান্য পর্ব। মঞ্চে উপবিষ্ট তপন চৌধুরী গানের ফাঁকে ফাঁকে তাঁর সংগীতজীবন নিয়ে কথা বলেন। নস্টালজিক হন নিজে, একই অনুভবে সিক্ত করেন সেখানে উপস্থিত অনেককেই। শাফিনা করিম এই ইন্টারভিউ পর্বটি সঞ্চালনা করেন।
‘শত বরষার জল, চোখে ছিল টলমল...’, ‘পাথরের পৃথিবীতে কাচের হৃদয়… ’, ‘পলাশ ফুটেছে শিমুল ফুটেছে…’, ‘আমি সবকিছু ছাড়তে পারি …’ , ‘তুমি আমার প্রথম সকাল…’ এ রকম বহু গান হয়। আশি-নব্বই দশকের উত্তুঙ্গ জনপ্রিয় গানে রোমান্টিক আবহ ছড়িয়ে পড়ে হলজুড়ে। গান করেন সোমা চৌধুরী, অনুজা দত্ত, নিলেশ ভট্টাচার্য্য, শারমিন জাহান আশা, চৈতি বর্মন, রূপা চৌধুরী, শেলি দেব, উমা দাস, জুবায়ের টিপু, আশরাফুল পাভেল, কেয়া ভট্টাচার্য্য, মুক্তা চৌধুরী, পুষ্পিতা দেব চম্পা, রদিয়া, হাসান চৌধুরী, শরিফ রহমান, গৌরব চক্রবর্তী, আশিক বিশ্বাস ও ঋতুপর্ণা ব্যানার্জি প্রমুখ।
একটি গানে তপন চৌধুরীর সঙ্গে অংশ নেন তাঁর স্ত্রী সোমা চৌধুরী ও একমাত্র সন্তান সত্যম। আবৃত্তি করেন আফাজ উদ্দিন তোতন, সন্জীব দাশ উত্তম ও মুফতি ফারুক। দলীয় নৃত্য পরিবেশনায় ছিল পুষ্পা, সিথি ও ঐশি, স্মৃতি ও পৃথি এবং এককে দেবজ্যোতি দাশ। যন্ত্রসংগীত বিভাগ পরিচালনা করে দামাল মিউজিক্যাল গ্রুপ। এই পর্বে ছিলেন লিটন ডি কস্টা, রূপতনু শর্মা, ঝলক দেব চৌধুরী, মিথুন দাস ও সজীব চৌধুরী।
বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট শিল্পী মুক্তিযোদ্ধা তাজুল ইমাম (নিউইয়র্ক), একুশে পদকপ্রাপ্ত বিশিষ্ট ছড়া সাহিত্যিক লুৎফর রহমান রিটন, বিশিষ্ট নাট্য অভিনেত্রী আফরোজা বানু ও অটোয়ার বাংলাদেশ হাইকমিশনে সদ্য যোগদান করা বিশিষ্ট টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব মিথিলা ফারজানা (অটোয়া), সংগীত পরিচালক আশিকুজ্জামান টুলু ও শিল্পী হাসান চৌধুরী (টরন্টো)। তাঁদের পু্ষ্পস্তবক দিয়ে শিল্পী তপন চৌধুরী ও ক্রেস্ট দিয়ে অনুষ্ঠানের গ্র্যান্ড স্পন্সর বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও সংগঠক শামীমুল হাসান সংবর্ধিত করেন।
অনুষ্ঠানে তপন চৌধুরীকে শুভেচ্ছা জানিয়ে ভিডিও বার্তা পাঠান শিল্পী শাকিলা জাফর, নকীব খান, গীতিকার কবির বকুল, আনিসুর রহমান তনু, শহীদ মাহমুদ জঙ্গী। স্লাইড শোর মাধ্যমে তাঁদের বক্তব্যটি প্রদর্শন করা হয়।
অনুষ্ঠানের একটি উল্লেখযোগ্য দিক ছিল গানের সঙ্গে গীতিকার ও সুরকারের ছবিসহ নাম মঞ্চের বড় পর্দায় প্রদর্শন করে তাঁদের সম্মান জানানো।
তপন চৌধুরী সংগীতসন্ধ্যার পরিকল্পক, উদ্যোক্তা ও সমন্বয়কারী অনুপ চৌধুরী মিঠু ‘লোকজ, মন্ট্রিয়লের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন। তিনি তপন চৌধুরীর মতো একজন গুণী শিল্পীকে সবার সহযোগিতায় এ রকম একটি জমজমাট অনুষ্ঠান আয়োজন করতে পারায় নিজে এবং ‘লোকজ, মন্ট্রিয়ল’ গৌরবান্বিত বোধ করছে বলে উল্লেখ করেন। শুরুতেই তপন চৌধুরীকে ফুল দিয়ে বরণ করেন অনিমেষ কর টিংকু।
পুরো অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেন শক্তিব্রত হালদার মানু ও শাফিনা করিম। অনুষ্ঠানে দর্শকদের জন্য তপন চৌধুরীর সংগীত জগৎ সম্পর্কীয় প্রশ্নোত্তর পর্বের একটি ইভেন্ট ছিল। এতে বিজয়ী পাঁচজনকে পুরস্কৃত করা হয়। হলের বাইরে ছিল মুখরোচক খাবারের স্টল।
মন্ট্রিয়লে বহু বছর যাবৎ সপরিবার বসবাসরত শিল্পী তপন চৌধুরীকে নিয়ে এই প্রথম এ রকম কোনো অনুষ্ঠান হলো এখানে। শিল্পী তাঁর অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে বলেছেন, শিল্পীর জীবদ্দশায় এই সম্মান পাওয়া অনেকটাই বিরল। তিনি জানান, তাঁর শিল্পী জীবনে শ্রোতাদের যে ভালোবাসা পেয়েছেন, তা হৃদয়ে ধারণ করেন সব সময়। একই সঙ্গে তিনি তাঁর এই পর্যায়ে আসার পেছনে সহযোগিতাকারী, অবদান রাখা বন্ধুবান্ধব, গীতিকার, সুরকার, ব্যান্ড সোলসের সব সদস্য ও পরিবারের লোকজনের কথা কৃতজ্ঞতাভরে স্মরণ করেন। সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ১১টা একটানা অনুষ্ঠান উপভোগ করে দর্শক-শ্রোতারা ‘তপনময় সুরেলা মন’ নিয়ে ঘরে ফেরেন।