ভারত কি গ্লোবাল সাউথের নেতৃত্ব দিতে পারবে?
২০২৪ সালের ১৭ আগস্ট ভারতে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ভয়েস অব গ্লোবাল সাউথের শীর্ষ সম্মেলন। ভারতের আয়োজনে এটা ছিল গ্লোবাল সাউথের তৃতীয় সম্মেলন। এর আগের দুটি সম্মেলন ভারতেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসও এই বহুপক্ষীয় সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। গ্লোবাল সাউথের এই সম্মেলনের উদ্যোগটি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ‘সবকা সাথ সবকা বিকাশ সবকা বিশ্বাস অর সবকা প্রয়াস’-এর দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিল। এ দৃষ্টিভঙ্গির মূল হোতা ছিলেন প্রাচীন ভারতের দার্শনিক বাসুধৈব কুটুম্বকম, যার দর্শন ছিল ‘এক পৃথিবী, এক পরিবার, এক ভবিষ্যৎ।’
সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো, যেমন কোভিড মহামারি, ইউক্রেন যুদ্ধ, ক্রমবর্ধমান ঋণ, খাদ্য এবং জ্বালানিনিরাপত্তা উন্নয়নশীল বিশ্বকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। আর উন্নয়নশীল দেশের এ উদ্বেগগুলো বর্তমানে জি-৭ বা জি-২০ মতো বিশ্বমঞ্চে যথাযথ প্রাধান্য বা মনোযোগ পাচ্ছে না। তা ছাড়া উন্নয়নশীল দেশগুলোর কাছে যুক্তরাষ্ট্র বা চীন কেউই বিশেষভাবে পছন্দের নয়। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র আর্থিক সহায়তার চেয়ে সামরিক শক্তির দিকে বেশি মনোযোগ দেয় আর চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড অবকাঠামো উন্নয়নের উদ্যোগ অনেক দেশকে খেলাপি হওয়ার ঝুঁকির মুখে ফেলে দিয়েছে। তাই ভারতের জন্য নেতৃত্ব দেওয়ার একটা সুযোগ তৈরি হয়েছে। এ প্রয়োজনীয়তা থেকেই ভারতের উদ্যোগে ভয়েস অব গ্লোবাল সাউথের শীর্ষ সম্মেলনটি দেশগুলোকে একত্র করে তাদের সমস্যা একটি সাধারণ প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে সমাধান করার জন্য করা হয়েছে।
গ্লোবাল সাউথে যেহেতু ভারত ও চীন দুটি দেশই অন্তর্ভুক্ত, তাই এ জোটের নেতৃত্ব কে দেবে, এটা নিয়ে অনেক দিন ধরেই এই দুই দেশের মধ্যে একটা ঠান্ডা লড়াই চলে আসছে। দুই দেশই মনে করে, তারা গ্লোবাল সাউথের নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্য। চীনের পক্ষে যুক্তি হচ্ছে গত তিন দশকে তাদের যে আশ্চর্যজনক অর্থনৈতিক উন্নতি হয়েছে, সেটা হতে পারে দরিদ্র দেশগুলোর জন্য রোল মডেল। আর ভারতের যুক্তি হচ্ছে তারা পৃথিবীর জনবহুল গণতন্ত্রের দেশ। যেটা হতে পারে আফ্রিকান দেশগুলোর রোল মডেল, যাদের দেশে গণতন্ত্রের কোনো চর্চা নেই। উদীয়মান অর্থনীতির দেশ হিসেবে ভারত ইতিমধ্যে বেশ সুনাম অর্জন করেছে। তাই পশ্চিমা দেশগুলো চীনের বিকল্প হিসেবে ভারতকে গ্লোবাল সাউথের নেতৃত্বে দেখতে চায়। আজকের এ প্রতিবেদনে চীন ও ভারতের মধ্যে তুলনা করা হবে না। বরং বিশ্লেষণ করা হবে ভারত কি এই নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্যতা রাখে কি না। ভারতের এই নেতৃত্ব দেওয়ার আর্থিক, সামরিক ও মানসিক পরিপক্বতা আছে কি না। ভারতের সক্ষমতা যাচাই করার আগে জেনে নেওয়া যাক গ্লোবাল সাউথ কী।
১৯৫৫ সালে ইন্দোনেশিয়ার বান্দুংয়ে এশিয়া-আফ্রিকা সম্মেলনকে গ্লোবাল সাউথ দেশগুলোর প্রথম সভা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এ সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীরা অন্য বিষয়গুলোর পাশাপাশি উপনিবেশবাদ এবং জাতিগত বৈষম্যের বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করে। পশ্চিমা আধিপত্য ও হস্তক্ষেপ প্রতিরোধ করার পাশাপাশি জোটনিরপেক্ষতা বজায় রাখার জন্য এ দেশগুলো ইচ্ছা পোষণ করে। এ প্রথম সম্মেলন থেকেই চীন ও ভারত গ্লোবাল সাউথের নেতৃত্বের জন্য লড়াই শুরু করে।
গ্লোবাল সাউথে বর্তমানে ১৩৪টি দেশ রয়েছে। সাধারণ ভৌগোলিক সীমারেখা অনুযায়ী, ইকুয়েডরের নিচের দিক হচ্ছে সাউথ আর ওপরের দিক হলো নর্থ। কিন্তু গ্লোবাল সাউথ জোট কোনো ভৌগোলিক সীমারেখার ওপর ভিত্তি করে করা হয়নি। যেমন গ্লোবাল সাউথে ইকুয়েডরের নর্থের দেশ ভারত, চীন ও বাংলাদেশ আছে আবার ইকুয়েডরের সাউথের দেশ কোরিয়া, জাপান, অস্ট্রেলিয়া নেই। কারণ, তারা উন্নত দেশের মধ্যে পড়ে। গ্লোবাল সাউথের দেশগুলোকে আবার তৃতীয় বিশ্বের দেশও বলা যাবে না। কারণ, তৃতীয় বিশ্ব কথাটা এসেছিল ঠান্ডা যুদ্ধের সময়, নিম্ন আয় ও অনগ্রসর দেশগুলোকে বোঝাতে। তখন ধনী আর উন্নত দেশগুলোকে বলা হতো প্রথম বিশ্ব, সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে থাকা দেশগুলোকে বলা হতো দ্বিতীয় বিশ্ব আর বাকি সব দরিদ্র দেশগুলোকে বলা হতো তৃতীয় বিশ্ব। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর তাদের সঙ্গে থাকা দেশগুলো মারাত্মক আর্থিক দৈন্যের মধ্যে পড়ে, অতএব তাদের তো আর দ্বিতীয় বিশ্ব বলা যায় না। তা ছাড়া তৃতীয় বিশ্বের উপাধিটা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেকটা অবমাননাকর উপাধিতে পরিণত হয়েছে। তাই নতুন নামকরণ অনুযায়ী উন্নত দেশগুলোকে বলা হয় গ্লোবাল নর্থ আর বাকি সব দেশগুলোকে মিলিয়ে বলা হয় গ্লোবাল সাউথ। সুতরাং গ্লোবাল সাউথ বলতে মূলত বিশ্বের নিম্ন আয়, কম উন্নত আর উন্নয়নশীল দেশগুলোকে বোঝায়।
গ্লোবাল সাউথ ইদানীং আরও বেশি আলোচনায় এসেছে ইউক্রেন ও গাজা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর। রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণের পর রাশিয়ার বিরুদ্ধে জি-৭ দেশগুলোর আনা জাতিসংঘের নিন্দা প্রস্তাবে গ্লোবাল সাউথের ৩২টি দেশ যোগ দেয়নি। বাংলাদেশ, ভারত, চীন, পাকিস্তান, আফ্রিকার মতো দেশগুলো ভোটদানে বিরত থাকে। আবার গাজা যুদ্ধে জাতিসংঘের আনা যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাবে গ্লোবাল সাউথের অধিকাংশ দেশগুলো ভোট দেয়, কিন্তু জি-৭ দেশগুলোর অনেকে ভোটদানে বিরত থাকে। এই দুটি আন্তর্জাতিক ঘটনায় গ্লোবাল সাউথের দেশগুলো তাদের জোরালো মতামতের আর শক্তির জানান দেয়, যেটা আজ থেকে এক দশক আগেও কল্পনা করা যেত না। আর এটা সম্ভব হয়েছে ভারত, চীনের মতো দেশগুলোর বলিষ্ঠ ভূমিকার জন্য। তাই গ্লোবাল সাউথকে কতগুলো অনুন্নত দেশ হিসেবে দেখলেই চলবে না, গ্লোবাল সাউথ হচ্ছে উন্নত জি-৭ দেশগুলোর বিপরীতে এক প্রতিবাদী মহাজোট। এই মহাজোট পশ্চিমা বিশ্বের শত বছরের শোষণ, নিপীড়ন, কপটতা, নেতৃত্ব আর মেনে নিতে চাইছে না।
এবার আসা যাক ভারতের নেতৃত্বের সক্ষমতার আলোচনায়। গ্লোবাল সাউথে আফ্রিকার ৪৮টি দেশ অন্তর্ভুক্ত। আফ্রিকার এই দেশগুলো খুব অনুন্নত আর অনগ্রসর। সুতরাং গ্লোবাল সাউথের নেতৃত্ব দিতে হলে অবশ্যই আফ্রিকার আশা–আকাঙ্ক্ষা আর সমস্যার দিকে নজর দিতে হবে। আফ্রিকার এই অনুন্নত দেশগুলো গণতন্ত্রের শাসনকে স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধির প্রধান কারণ হিসেবে দেখে। ভারত বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ। তাই আফ্রিকায় দেশগুলো যেখানে গণতান্ত্রিক শাসন প্রায়ই ব্যাহত হয়, ভারতের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে অত্যন্ত সমীহের সঙ্গে দেখে। আফ্রিকার অনেক দেশের সঙ্গে ভারতের ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে। ভারতের স্বাধীনতার প্রাণপুরুষ মহাত্মা গান্ধী একজন আইনজীবী এবং মানবাধিকারকর্মী হারাবে দক্ষিণ আফ্রিকায় ২০ বছরেরও বেশি সময় কাটিয়েছেন। তাই আফ্রিকায় ভারতীয় প্রবাসীদের প্রভাবশালী ভূমিকা ভারতকে গ্লোবাল সাউথের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য একটা সুবিধাজনক স্থানে নিয়ে গেছে।
জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন নেতৃত্ব ও ঔপনিবেশিকবিরোধী সংহতির কারণেও ভারতকে আফ্রিকার এক বিশ্বস্ত অংশীদার হিসেবে দেখা হয়। আফ্রিকার মতো ভারতও বৈচিত্র্যময় জনসংখ্যার দেশ আর ভারতের উন্নয়নের মূলে রয়েছে সেই জনসংখ্যা, প্রযুক্তি এবং বেসরকারি খাত। বিশ্বমঞ্চে ভারত কোয়াড এবং জি-২০-এর মতো বহুপক্ষীয় গোষ্ঠীগুলোর সদস্য এবং যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ এবং ব্রিক্সের দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছে। তাই বিশ্বব্যাপী গ্লোবাল নর্থ আর সাউথের মধ্যে সেতু হিসেবে ভারত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
সুতরাং দেখা যায়, ভারত গুণগতভাবে গ্লোবাল সাউথের নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্যতা রাখে কিন্তু ইংরেজিতে একটা প্রবাদ আছে ‘Money talks’, যার অর্থ বাংলা প্রবাদে বলা যায় খালি কথায় চিড়া ভিজে না। গ্লোবাল সাউথের উন্নয়নশীল দেশগুলোর অবকাঠামো, মানবসম্পদ, স্বাস্থ্য, সেবা ও দারিদ্র্য বিমোচনে হাজার কোটি টাকার অর্থ সাহায্য দরকার। ভারত যদি এই অর্থের জোগান ঋণ বা অনুদান হিসেবে বন্দোবস্ত করতে না পারে তাহলে ভারতের নেতৃত্ব অনুন্নত দেশগুলো কীভাবে লাভবান হবে? তা ছাড়া গ্লোবাল সাউথের অনুন্নত দেশগুলো যেসব সামাজিক এবং আর্থিক সমস্যাজর্জর ভারত যদি নিজের দেশেই সেসব সমস্যার সমাধান করতে না পারে, তাহলে ভারত গ্লোবাল সাউথের নেতৃত্ব দেবে কীভাবে? তাহলে দেখা যাক ভারতের আর্থিক সক্ষমতা আছে কি না।
মাথাপিছু মোট জাতীয় আয়—
ভারত বিশ্বের ৫তম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। বিশ্বের ১৯৫টি দেশের মধ্যে ৫তম হওয়াটা নিশ্চয়ই মুখের কথা নয়। তবে এটা মনে রাখতে হবে যে ভারত বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ। সেই কারণে ভারতের অর্থনীতির আকারটা বড় হওয়াটাই স্বাভাবিক। তাই শুধু অর্থনীতির আকার দিয়ে বিচার করলেই চলবে না, দেখতে হবে একটা দেশের মাথাপিছু আয় কেমন। কারণ, জিডিপি পরিমাপ দেশে বৈষম্য ও দারিদ্র্য প্রতিফলিত করে না। দেশে প্রচুর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হতে পারে, কিন্তু সেই প্রবৃদ্ধির অনেকাংশ যদি অল্প কয়েকজন অভিজাত শ্রেণির কাছে কুক্ষিগত থাকে তাহলে সেটা সাধারণ জনগণের জন্য কোনো সুফল বয়ে আনবে না।
ভারত যদিও বিশ্বের ৫তম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ, কিন্তু মাথাপিছু আয়ের ক্ষেত্রে ভারত বিশ্বের ১৯৫টি দেশের মধ্যে অনেক পেছনে ১৪১তম স্থানে রয়েছে। ব্যাপারটা অবাক করার মতো নিশ্চয়ই, তাই একটা দেশের মাথাপিছু আয়ের পাশাপাশি ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে আয়ের বণ্টন কেমন, সেটাও পর্যালোচনা করতে হবে। পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে ধনী আর দরিদ্রের মধ্যে সম্পদ আর আয়ের ব্যবধানটা একটু বেশি হয়ে থাকে, কিন্তু ভারতের ক্ষেত্রে এই ব্যবধানটা অত্যন্ত বেশি। ভারতে জনসংখ্যার সবচেয়ে ধনী ১ শতাংশ মানুষ দেশের মোট সম্পদের ৪০ শতাংশ ভোগ করে, যেটা বিশ্বে বিরল। তাই ভারতের জিডিপি প্রধানত ১০ শতাংশ ধনীর অবদানে চলে, কারণ বাকি ৯০ শতাংশ মানুষ সম্পদের অসম বণ্টনের কারণে জিডিপিতে খুব কমই অবদান রাখে। বর্তমানে ভারতের মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৯৪০ মার্কিন ডলার। যদি মাথাপিছু আয়ের সমীকরণ থেকে শীর্ষ ১০ শতাংশ ধনী লোকদের আয় বাদ দেওয়া হয় তাহলে বাকি ৯০ শতাংশ মানুষের মাথাপিছু আয় গিয়ে দাঁড়ায় মাত্র ১ হাজার ৭৩০ ডলার, যেটা আফ্রিকার দরিদ্রতম দেশগুলোর থেকেও কম।
আর্থিক দীনতার পাশাপাশি উন্নয়নশীল দেশগুলো মোট জাতীয় আয়ের তুলনায় উচ্চঋণ, নিম্নমানের মানব উন্নয়ন ও নারীবৈষম্যের মতো সমস্যায় জর্জরিত। গ্লোবাল সাউথের নেতৃত্ব দিতে হলে ভারতকে এই সমস্যাগুলোর সমাধানেও সহযোগিতা করতে হবে। ভারত কি নিজের দেশে এই সমস্যাগুলোর সমাধান করতে পেরেছে?
জাতীয় আয়ের তুলনায় ঋণ
ভারতের মোট জাতীয় আয়ের (জিডিপি) তুলনায় ঋণের পরিমাণ ৮২.৬ শতাংশ। জিডিপির তুলনায় ঋণের পরিমাণ কত শতাংশ হওয়া উচিত এই নিয়ে বিশ্বে অনেক বিতর্ক আছে। কিছু অর্থনীতিবিদের ভাষায় ঋণের পরিমাণটা ৫০ শতাংশ বেশি হওয়াটা উচিত না। অবশ্য বিশ্বের অনেক উন্নত দেশের এই ঋণের হার অনেক বেশি। যেমন জাপানের জিডিপির তুলনায় ঋণের পরিমাণ ২৬৪ শতাংশ, আমেরিকার ১২৯ শতাংশ এবং সিঙ্গাপুরর ১৬৮ শতাংশ। তাই ভারতের এই ঋণের পরিমাণটা মোটামুটি ভালো অবস্থানে আছে।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, বাংলাদেশের জিডিপির তুলনায় ঋণের পরিমাণ ৩৯.২ শতাংশ, এই ক্ষেত্রে অবশ্য বাংলাদেশ ভারতের তুলনায় বেশ সুবিধাজনক অবস্থানে আছে।
মানব উন্নয়ন সূচক
একটি দেশের মানব উন্নয়ন পরিমাপ করা হয় তিনটি মূল উপাদানকে অন্তর্ভুক্ত করে: জন্মের সময় আয়ু (স্বাস্থ্যের প্রতিনিধিত্ব করে), শিক্ষার স্তর (স্কুলিংয়ের গড় বছর এবং স্কুলে পড়ার প্রত্যাশিত বছর দিয়ে পরিমাপ করা হয়) এবং জীবনযাত্রার মান (ক্রয়ক্ষমতা সমতা অনুযায়ী মাথাপিছু মোট জাতীয় আয়)। এই সূচকটি মূলত একটি দীর্ঘ এবং স্বাস্থ্যকর জীবন, জ্ঞানের আহরণের সুবিধা এবং একটি শালীন জীবনযাত্রার মান নির্ধারণ করে। ইউএন ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভারতের মানব উন্নয়ন সূচকের মান ০.৬৪৪, এটা বিশ্বের ১৯৫ দেশের মধ্যে ১৩৪তম, শিক্ষার হারে ভারত ১০৫তম, ক্ষুধার সূচকে ১০৪তম।
নারীবৈষম্য সূচক
সূচকটি সাধারণত তিনটি মূল মাত্রায় পরিমাপ করা হয় প্রজননস্বাস্থ্য (মাতৃমৃত্যুর অনুপাত এবং বয়ঃসন্ধিকালের জন্মহার), ক্ষমতায়ন (সংসদীয় আসনের ভাগ এবং মাধ্যমিক শিক্ষা) এবং শ্রমবাজার (নারী ও পুরুষদের শ্রমশক্তির অংশগ্রহণের হার)। ইউএন ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভারতের মানব উন্নয়ন সূচকের মান ০.৪৩৭, এটা বিশ্বের ১৯৫ দেশের মধ্যে ১০৮তম।
ভারতের সংবিধান নারী ক্ষমতায়ন ও সমতার নিশ্চয়তা দেয়। তবু দেশটি এখনো উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। ভারতের নারীরা অহরহ শারীরিক সহিংসতা, জোর করে বিয়ে এবং যৌন সহিংসতাসহ নানা লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার সম্মুখীন হয়। উল্লেখ্য, নারীর ক্ষমতায়ন, শ্রমবাজার নারীদের অংশগ্রহণ এবং প্রজনন মাতৃমৃত্যুর সূচকে বাংলাদেশ ভারতের তুলনায় অনেক এগিয়ে আছে।
উপরিউক্ত সমস্যাগুলোর পাশাপাশি ভারতের একান্ত ও নিজস্ব কিছু সমস্যা আছে যেগুলো বিশ্বের খুব কম দেশেই দেখা যায়। যেমন জাতিভেদ প্রথা। এটি ভারতের একটি ঐতিহ্যগত সামাজিক স্তরবিন্যাস। এ প্রথা অনুযায়ী দেশের মানুষকে জন্মের ভিত্তিতে বিভিন্ন দলে বিভক্ত করা হয়। প্রাথমিক বর্ণগুলো হলো ব্রাহ্মণ (পুরোহিত এবং পণ্ডিত), ক্ষত্রিয় (যোদ্ধা এবং শাসক), বৈশ্য (ব্যবসায়ী এবং কৃষিবিদ), এবং শূদ্র (শ্রমিক এবং সেবা প্রদানকারী)। এ বর্ণপ্রথা ভারতে সামাজিক বৈষম্যের সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে, কারণ নিম্নবর্ণের লোকেরা প্রায়ই শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। এই বর্ণপ্রথা এতটাই প্রকট যে এটা ভারতের গণ্ডি ছাড়িয়ে পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলোয় বিস্তৃত। ড. বি আর আম্বেদকর, একজন নিম্নবর্ণের দলিত কর্মী, যিনি ভারতের সংবিধানের খসড়া তৈরির কমিটির সভাপতিত্ব করেছিলেন, সতর্ক করেছিলেন ‘যদি হিন্দুরা পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলে চলে যায়, তাহলে ভারতীয় বর্ণ একটি বিশ্ব সমস্যা হয়ে উঠবে।’ যেটা বর্তমানে দেখা যাচ্ছে কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে যেখানে অধিকসংখ্যক ভারতীয়রা অবস্থান করে। আরও একটি একান্ত সমস্যা, যেটা ভারতের উত্থানকে ধীর করে দিচ্ছে তা হলো ভাষার বাধা, বৈচিত্র্যময় ধর্ম ও সংস্কৃতি। আপাতদৃষ্টে বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি ও ভাষা একটা দেশের জন্য মঙ্গলকর হলেও দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে তা একটি প্রধান বাধা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ভারতে ১০০টির বেশি ভিন্ন ভাষা রয়েছে, যা কার্যকরভাবে দেশ পরিচালনা ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করছে। দেশ পরিচালনায় আর একটি সমস্যা ভারতের উন্নয়নকে ম্লান করে দিচ্ছে, সেটা হলো উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদী। নরেন্দ্র মোদি, একজন হিন্দু জাতীয়তাবাদী এবং ডানপন্থী ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) নেতা। ভারতের অর্থনীতির সংস্কার এবং উন্নয়নের একটি নতুন যুগের সূচনা করার প্রতিশ্রুতি নিয়ে ২০১৪ সালে বিজেপি ক্ষমতায় এসেছে। কিন্তু নির্বাচনে বিজেপির অভূতপূর্ব বিজয়ের দ্বারা উত্সাহিত হয়ে, মোদির চরমপন্থী জাতীয়তাবাদী সমর্থকেরা একটি সম্পূর্ণ হিন্দু রাষ্ট্র কায়েম করার জন্য সারা দেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংসতা এবং ভীতি প্রদর্শন করে যাচ্ছে। মুসলমানদের হিন্দুধর্মে ধর্মান্তরিত করতে বাধ্য করা হচ্ছে, বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, এমনকি গোমাংস খাওয়ার অভিযোগে মানুষ হত্যা করা হচ্ছে; উল্লেখ্য হিন্দুধর্মে গরুর বিশেষ মর্যাদা রয়েছে। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে হিন্দুধর্ম একটি সহনশীল ধর্ম হিসেবে পরিচিত। ভারত বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের দেশ। ভারতীয় সংবিধানে সংখ্যালঘু গোষ্ঠীদের ভয় ছাড়াই তাদের ধর্ম পালনের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু হিন্দু জাতীয়তাবাদী আন্দোলন হিন্দুধর্মের এই সহনশীল পরিচয়কে কলুষিত করছে।
সর্বোপরি ভারতের নেতৃত্বের সক্ষমতা যাচাই করতে, প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক কেমন সেটা বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন। কারণ, ভারত যদি সফলভাবে মাত্র আটটি প্রতিবেশী দেশের নেতৃত্ব দিতে না পারে তাহলে ভারত গ্লোবাল সাউথের ১৩৪টি দেশের নেতৃত্ব দেবে কীভাবে?
দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত ভৌগোলিকভাবে বিভিন্ন দেশ দ্বারা বেষ্টিত, যার ফলে প্রতিবেশীদের সঙ্গে ভারতের একটি জটিল এবং বহুমুখী সম্পর্ক রয়েছে। এ সম্পর্কগুলো শুধু আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা এবং নিরাপত্তার জন্যই নয়, বৈশ্বিক মঞ্চে ভারতের আকাঙ্ক্ষার জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তান, চীন, নেপাল, ভুটান, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, আফগানিস্তান এবং মালদ্বীপ-ভারতের সঙ্গে এক ঐতিহাসিক সম্পর্ক ভাগ করে, যা মাঝেমধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ সীমান্ত এবং রাজনৈতিক উত্তেজনা দ্বারা চিহ্নিত হয়ে থাকে।
চীনের সঙ্গে ভারতের সীমান্ত নিয়ে উত্তেজনা লেগেই আছে এবং ১৯৬২ সালে দেশ দুটি যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এক মাসের এই যুদ্ধে চীন ভারতের বেশ কিছু অংশ দখল করে নেয়, যা আজও চীন ভারতকে ফেরত দেয়নি। ভারতের বিরুদ্ধে পূর্ণাঙ্গ এই যুদ্ধ চীন শুরু করেছিল।
পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে ৪টি (১৯৪৭, ১৯৬৫, ১৯৭১, ১৯৯৯) যুদ্ধ হয়েছে।
নেপালের রাজনৈতিক দৃশ্যপট, বিশেষ করে এর বিকাশমান গণতন্ত্র এবং একটি নতুন সংবিধানের খসড়া ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে ক্ষেত্রে জটিলতার তৈরি করেছে। সীমান্ত বিরোধ এবং চীনের সঙ্গে নেপালের ক্রমবর্ধমান সম্পৃক্ততার মতো বিষয়গুলো মাঝেমধ্যে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনার সৃষ্টি করে। নেপালের বিরুদ্ধে ভারতের দেওয়া ২০১৫ সালের অবরোধ দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত। ছয় মাসের এ অবরোধে স্থলবেষ্টিত নেপালে ভারত সব ধরনের পণ্য সরবরাহ বন্ধ করে দেয়, যা নেপালের জনগণের জন্য চরম ভোগান্তির সৃষ্টি করে।
যদিও ভুটানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক অনেকাংশে ইতিবাচক, এটিও চ্যালেঞ্জ ছাড়া নয়। বিশেষ করে চীনসহ অন্য দেশের সঙ্গে ভুটানের সম্পর্ক বৃদ্ধি ভারত কখনোই ভালো চোখে দেখে না।
শ্রীলঙ্কার সঙ্গে ভারতের দৃঢ় সম্পর্ক থাকলেও সম্পর্কটি বিভিন্ন সময় চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে পল্ক প্রণালিতে তামিলনাড়ুর জেলেদের মাছ ধরার অধিকার, অবকাঠামো প্রকল্পের মাধ্যমে শ্রীলঙ্কায় চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব নিয়ে ভারতের উদ্বেগ এবং জাতিগত তামিল জনসংখ্যাকে ঘিরে রাজনৈতিক উত্তেজনা। অবশ্য উভয় দেশই সংলাপ এবং কূটনৈতিক সম্পৃক্ততার মাধ্যমে এই সমস্যাগুলোর সমাধান করার চেষ্টা করে যাচ্ছে।
ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ভিত্তি দেশ দুটির ইতিহাস এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ওপর গড়ে উঠেছে। ভারতের সহায়তায় ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন এই সম্পর্কের মূল ভিত্তি হিসেবে পরিচিত। ২০১৫ সালে দুই দেশের মধ্যে সম্পাদিত ল্যান্ড বাউন্ডারি চুক্তি, যা ছিটমহল বিনিময় সহজতর করেছে এবং দীর্ঘদিনের সীমান্ত বিরোধের সমাধান করেছে। দুই দেশের এই সম্পর্কের দৃঢ়তা সত্ত্বেও ভারত ও বাংলাদেশ পানিবণ্টন, সীমান্ত ব্যবস্থাপনা এবং বাণিজ্য ভারসাম্যহীনতা–সংক্রান্ত সমস্যাসহ নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। অত্যন্ত অজনপ্রিয়তা সত্ত্বেও বাংলাদেশের জনগণের উদ্বেগ উপেক্ষা করে ভারত তার শাসনামলে হাসিনা সরকারকে সম্পূর্ণ সমর্থন করেছিল। হাসিনার শাসনামল ক্রমবর্ধমান নিপীড়ক এবং স্বৈরাচারী হয়ে উঠলেও ভারত চোখ বন্ধই করে তা সমর্থন করে গেছে। হাসিনার শাসনের পতনের কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ঘটনাগুলোর প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকারের প্রতিক্রিয়া, বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার প্রচেষ্টা, সরকারনিয়ন্ত্রিত ভারতীয় গণমাধ্যমের মিথ্যাচার আর সীমান্তে অস্থিরতা বাংলাদেশের মানুষকে শুধু ভারতবিমুখ করেনি বরং ভারত সরকারের পররাষ্ট্রনীতির অপরিপক্বতারই প্রমাণ করেছে।
সামগ্রিকভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ভারতের সঙ্গে আটটি প্রতিবেশী দেশেরই সম্পর্কের নানা টানাপোড়নে চলছে। কথায় বলে ভালো প্রতিবেশী থাকলেই ভালো প্রতিবেশী হওয়া যায়। তাই ভারতকে হয়তো এককভাবে এই সম্পর্কের টানাপোড়নের জন্য দোষ দেওয়া যায় না, কিন্তু ভারতের মতো বৃহৎ প্রভাবশালী একটি দেশ বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান ও শ্রীলঙ্কার মতো ক্ষুদ্র দেশগুলোর সঙ্গে এই সমস্যাগুলো জিইয়ে রাখা নিশ্চয়ই ভারতের নেতৃত্বর সক্ষমতা প্রকাশ করে না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ১৯৮৩ সালে সম্পাদিত বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে তিস্তা নদীর পানি বণ্টনের চুক্তি। এ চুক্তি অনুযায়ী শুষ্ক মৌসুমে ভারত তিস্তা নদীর ৩৯ শতাংশ এবং বাংলাদেশ ৩৬ শতাংশ পানি পাওয়ার কথা। কিন্তু আজ পর্যন্ত বাংলাদেশ ভারতের কাছ থেকে চুক্তি অনুযায়ী পানি পায় নাই এবং এই সমস্যাটি সমাধান করার কোনো আগ্রহই ভারত দেখায় নাই। অথচ তিস্তা নদীর পানির আশায় বাংলাদেশ ভারতের চাপে ট্রানজিট চুক্তির মতো সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘনকারী চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয়েছে— যেই চুক্তির আওতায় ভারত বাংলাদেশের রাস্তা, রেলপথ, জলপথ এবং সমুদ্রপথ ব্যবহার করে পণ্য ও মানুষ পরিবহন করে পারে।
উপরিউক্ত আর্থসামাজিক সূচকগুলোর তথ্য–উপাত্ত পর্যালোচনা, ভারতের নিজস্ব সমস্যাগুলোর প্রকটতা এবং প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ভারত সত্যিকার অর্থে গ্লোবাল সাউথের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য প্রস্তুত নয়। কারণ, গ্লোবাল সাউথের দেশগুলো যেসব সমস্যা সমাধানের জন্য নেতৃত্ব খুঁজছে, ভারত নিজেই সেই সমস্যাগুলোয় জর্জরিত। তাই প্রশ্ন উঠছে ভারত যে একটি অর্থনৈতিক পরাশক্তি, এর কতটা বাস্তব এবং কতটা প্রোপাগান্ডা? কারণ, বিগত এক দশকে ভারতের মোট জাতীয় আয় বেড়েছে গড়ে মাত্র ৫.৫%, যেটা একটা উন্নয়নশীল দেশকে কখনোই অর্থনৈতিক পরাশক্তি বানাতে পারে না। আর ভারতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি যা হচ্ছে, সেটা অল্প কিছু অভিজাতদের ওপর কেন্দ্রীভূত, যে কারণে ভারতের নগর জনসংখ্যার ৪১ শতাংশেরও বেশি এখনো বস্তির মতো পরিস্থিতিতে বাস করে, যেখানে বিশুদ্ধ পানি এবং স্যানিটেশনের মতো মৌলিক প্রয়োজনীয় সুবিধাগুলো খুব সীমিত। এটা নিশ্চয়ই অর্থনৈতিক পরাশক্তির লক্ষণ নয়।
সত্যি কথা বলতে ভারত যে একটা অর্থনৈতিক পরাশক্তি, এ প্রোপাগান্ডার পেছনে রয়েছে পশ্চিমা বিশ্বের অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা স্বার্থ এবং ক্ষমতাসীন দল বিজেপির রাজনৈতিক স্বার্থ। চীনের অভাবনীয় উত্থান পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। চীনকে প্রতিহত করতে পশ্চিমা বিশ্বের ভারতকে প্রয়োজন। তাই ভারতকে কোআড নামের সাম্রাজ্যবাদী সামরিক জোটে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে । সেই সঙ্গে ভারতকে পরাশক্তির তকমা লাগিয়ে পশ্চিমা বিশ্ব হাজার কোটি রুপির অস্ত্র বিক্রি করতে পারছে। এই প্রোপাগান্ডার আর এক বড় অংশীদার হচ্ছে ক্ষমতাসীন মোদি সরকার। অর্থনৈতিক পরাশক্তির লেবেল লাগিয়ে জনগণকে হিন্দু জাতীয়তাবাদী প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ করে বিজেপি বারবার নির্বাচিত হতে পারছে। আর পশ্চিমারা এই প্রোপাগান্ডার মধ্যে পড়ে, ভারতকে চীনের বিনিয়োগবান্ধব বিকল্প হিসেবে বিবেচনা করছে। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্ব বাস্তবে যা সম্মুখীন হয়েছে, তা হচ্ছে ভারতের উচ্চমাত্রার দারিদ্র্য, দুর্বল শিক্ষাব্যবস্থা, নিম্ন স্বাস্থ্যবিধি মান এবং ভগ্ন পরিকাঠামোসহ একটি বৃহৎ জনসংখ্যা।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় কয়েক বছর ধরে ভারত নিজেকে একটি আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে নিজেকে দাঁড় করানোর চেষ্টা করছে। ভারত এমনভাবে কাজ করছে যেন এ অঞ্চলের ওপর তার এক ঐশ্বরিক অধিকার রয়েছে। ভারতের আগ্রাসী বিদেশনীতি এবং ফাঁপা প্রতিশ্রুতি অবশেষে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর কাছে উন্মোচিত হচ্ছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রতিটি দেশ ভারতের উপস্থিতিকে এখন মিত্র হিসেবে নয় বরং অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখছে। এ অঞ্চলের দেশগুলো ভারতের বড় ভাই সুলভ মনোভাবের প্রতি ক্রমশ হতাশ এবং আসল উদ্দেশ্য বুঝে ফেলেছে যে ভারত আসলে আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধিতে আগ্রহী নয় বরং সবাইকে নিয়ন্ত্রণে রাখতেই আগ্রহী। ভারতের তথাকথিত ‘প্রতিবেশী প্রথম’ নীতিটি এই দেশগুলোকে চীনের দিকে ঝুঁকতে না দেওয়ার জন্য ভারতের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার একটি কৌশলমাত্র। ভারতীয় নেতারা দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের পরিকল্পনাকে ব্যাহত করার জন্য এতটাই সময় ব্যয় করছে যে তারা তাদের প্রতিবেশীদের সঙ্গে কোনো অর্থপূর্ণ সহযোগিতা তৈরি করতে এবং নির্ভরযোগ্য অংশীদার হিসেবে প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। নেতৃত্ব কোনো পদবি নয়, নেতৃত্ব একটি মানসিকতা। তাই ভারত যত দিন এ মানসিকতার পরিবর্তন না আনবে, তত দিন ভারত গ্লোবাল সাউথ কেন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নেতৃত্বও দিতে পারবে না।
লেখক: সাহিদুর রাহমান, মিনেসোটা, আমেরিকা। [email protected]