মৃণাল সেন
মৃণাল সেনকে আমরা চিনি প্রথিতযশা চিত্রপরিচালক হিসেবে। তাঁর অন্য দুটি পরিচয় একদিকে তিনি লেখক, অন্যদিকে তিনি চিত্রনাট্যকার। তাঁর কর্মজীবন ছিল চার যুগের ওপরে। ১৯৫৫ সাল থেকে তাঁর চিত্র পরিচালক ও চিত্রনাট্যকারের পথচলা শুরু হয়।
৪৭ বছরের এই কর্মজীবনে তিনি দাদা সাহেব ফালকে পুরস্কার পেয়েছেন বাংলা তথা বিশ্বের চিত্রজগতে অবদানের জন্য। তাঁর সমসাময়িক প্রথিতযশা চিত্রপরিচালক ছিলেন সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, তপন সিংহ। তিনি ও সত্যজিৎ রায় বাংলা তথা বাঙালিকে বিশ্বের দরবারে একটা অন্য মাত্রায় পরিচিতি দিয়েছিলেন।
বিখ্যাত চিত্রপরিচালক মৃণাল সেন ১৪ মে ১৯২৩ সালে জন্মগ্রহণ করেন তৎকালীন বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলায়। তাঁর প্রথম পরিচালনা ছিল ‘রাতভর’। ছবিটি মুক্তি পেলও তিনি সেভাবে খ্যাতি লাভ করতে পারেননি। এরপর তিনি কলকাতা ট্রিলজির ওপর ‘ইন্টারভিউ’, ‘কলকাতা একাত্তর’ এবং ‘পদাতিক’—এই তিন সিনেমার মাধ্যমে বিখ্যাত হন তিনি। সে সময়কার কলকাতার বিভীষিকাময় জীবনের প্রকৃত রূপ এই কলকাতা ট্রিলজির মাধ্যমে তুলে ধরেছিলেন।
মৃণাল সেন তাঁর প্রথম জীবনে তিনটি পেশার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। একদিকে তিনি সাংবাদিকতা করেছিলেন, পরবর্তী সময়ে ওষুধ ব্যবসায়ী এবং তার পরে তিনি শব্দ বা সাউন্ড টেকনিশিয়ান হিসেবে কাজ করেছিলেন।
মৃণাল সেন তাঁর চিত্রপরিচালনায় বাস্তবের কাহিনিগুলোকে চিত্রনাট্যে কিছুটা কাল্পনিক ও বাস্তব রূপে তুলে ধরেছিলেন ‘অকালের সন্ধানে’। এটি ১৯৪০ দুর্ভিক্ষকে সেলুলয়েডের পর্দায় চিত্রায়িত করেছিলেন তিনি। তাঁর ‘খারিজ’ ছবিটি কান চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কৃত হয়েছিল।
১৪টি জাতীয় পুরস্কার, ৪টি আঞ্চলিক চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং আন্তর্জাতিক পুরস্কারে তাঁর ছবিগুলো ভূষিত হয়েছে। এর মধ্যে ‘অকালের সন্ধানে’, ‘ভুবন সোম’, ‘পরশুরাম’ এই সিনেমাগুলো উল্লেখযোগ্য। তিনি আন্তর্জাতিক স্তরে ফ্রান্স ও রাশিয়া থেকে সেই দেশে সর্বোচ্চ পুরস্কার লাভ করেন। তিনি ১৯৮২, ১৯৮৩ এবং ১৯৯৭ সালে কান, বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবের জুরির সদস্য ছিলেন।
মৃণাল সেন তাঁর ছবিতে কলকাতার জনজীবনকে চারটি চিত্রনাট্যের প্রেক্ষাপটে রেখেছেন। ‘একদিন প্রতিদিন’ সিনেমায় তিনি জীবনযুদ্ধের যন্ত্রণাকে সামনে এনেছেন। তাঁর সিনেমার চিত্রনাট্যে তাঁর রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের ছায়া দেখতে পাওয়া যায়। তিনি ১৯৯৭ সালে এবং ২০০৩ সালে রাজ্যসভার সংসদ সদস্য ছিলেন।
‘পুনশ্চ’ ও ‘মহাপৃথিবী’—এই দুটি সিনেমা তাঁর কলকাতার জনজীবনকে ঘিরে ছিল। ‘খান্ডার’ ও ‘খারিজ’—এই সিনেমা দুটির জন্য তিনি দুবার আন্তর্জাতিক পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন। এ ছাড়া ‘ভুবন সোম’ এবং ‘অকালের সন্ধানে’ এই দুটি সিনেমার জন্য আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করেছেন।
তাঁর সিনেমায় ছিল সংলাপের ছড়াছড়ি। সমাজের অনেক কিছু বিষয় নিয়ে তাঁর এই সিনেমা অনেক প্রশ্ন তুলে দিয়ে গেছে, তার এখন পর্যন্ত উত্তর মেলেনি। মৃণাল সেন তাঁর সিনেমাশিল্পকে একটা প্রতিষ্ঠান হিসেবে তৈরি করেছিলেন। যেখানে তিনি সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, তপন সিংহের পাশাপাশি নিজের অবস্থানে একটা আলাদা মাত্রা তৈরি করতে পেরেছিলেন। সেই মাত্রা তিনি সিনেমাশিল্পে তাঁর চিত্রনাট্য, তাঁর ক্যামেরার পেছনের কর্মকুশলতা দিয়ে শৈল্পিক নিদর্শন তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছিলেন।
মৃণাল সেন তাঁর সিনেমায় অসামান্য অবদানের জন্য বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিলিট উপাধি লাভ করেছিলেন।
*রথীন কুমার চন্দ, চন্দননগর, হুগলী, ভারত
‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]