চিঠিময় জীবন

চিঠিপ্রতীকী ছবি

সত্যিকার অর্থে এই যুগে এখন আর স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে চিঠি আদান-প্রদানের কোনো সুযোগ ঘটে না। যদি স্বামী বেচারা চাকরিগত কারণে দূরে থাকেন বা স্বল্প সময়ের জন্য কোথাও যান, তাহলে এই লেখালেখির সুযোগ ঘটে। তা না হলে নয়। মুঠোফোন, অ্যাপ, ডিভাইসের কারণে এখন মানুষ চিঠি লেখার সুযোগ থেকে বঞ্চিত। যেকোনোভাবেই হোক স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে চিঠি লেখার অভ্যাস থাকা উচিত। এখন যৌবন যার বাজারের ফর্দ লেখার শ্রেষ্ঠ সময় তার। বাজারের লিস্টও এখন ডিভাইসে লেখা হয়।

ডিভাইস ও ই-মেইল এখন এ অভ্যাস ঝেঁটিয়ে বিদায় করেছে। শুধু তা–ই নয়, মীনা কার্টুনের মীনার মতো একটি ঝাড়ু নিয়ে সে অদৃশ্যে দণ্ডায়মান। স্কুলে আমাদের বাংলা দ্বিতীয় পত্রে চিঠি লিখতে হতো। উত্তর আমেরিকায় কোনো কোনো অঙ্গরাজ্যে পোস্ট অফিস বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কানাডায় দোকানের সঙ্গে পোস্ট অফিস আত্মীকরণ করা হয়েছে। সব ধরনের কাগজ ই-মেইলে গ্রহণের জন্য গ্রাহকদের উৎসাহিত করা হচ্ছে নিয়মিত। বাংলাদেশে রাস্তায় লাল রঙের লেটার বক্স এখন আর সর্বত্র দেখা যায় না। শিগগির লেটার বক্স জাদুঘরে প্রদর্শিত হবে। পরবর্তী জেনারেশনের জন্য পোস্ট অফিস, লেটার বক্স ও চিঠি নিয়ে কার্টুন মুভি ও ডকুমেন্টারি তৈরি হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া আত্মজকে বললাম, ওই সমস্যার জন্য একটা চিঠি লেখো তো। সে বলল, এটা আবার কীভাবে লিখব? এর অর্থ হচ্ছে, স্কুলে এখন আর চিঠি লেখা শেখানো হয় না। সিলেবাস থেকে এই চ্যাপটারই বেমালুম গায়েব করে দেওয়া হয়েছে। যেকোনো সমস্যা বা প্রশাসনিক কাজের জন্য কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিলে তারা নড়েচড়ে বসে এবং চিঠির কারণ ও সমাধানের জন্য চিন্তিত হয়। করোনাকালে ল্যান্ডলর্ডের অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ম্যানেজার ই-মেইল দিলে সঙ্গে সঙ্গে সে সমাধান দিয়ে উত্তর পাঠায়। ডিভাইসেই নাহয় চিঠি লেখার অভ্যাস ও চিঠির জগৎ আমাদের মধ্যে ফিরে আসুক। চিঠির মাধ্যমে আত্মোপলব্ধির সুযোগ ঘটে।

চিঠির প্রতি কী এক দুর্দমনীয় আকাঙ্ক্ষা ছিল একসময় মানুষের! দুপুরের পর অপেক্ষায় থাকতাম কখন পিয়ন আসবে? অনেক সময় সকালেই পোস্ট অফিসের ব্যাক ডোর দিয়ে মহল্লার পিয়নের টেবিলে গিয়ে হাজির হতাম। পত্রমিতালির যুগে অনেকেই ঘটা করে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে পত্রমিতা খুঁজে নিত। এরপর ছেলে–মেয়ের বন্ধুত্ব প্রগাঢ় হলে অনেকে জীবনসঙ্গী করে নিত।

১৯৭২ সালের পর দেখেছি চিঠিতে সুগন্ধি মেখে দিত অনেকে, ফুলের পাপড়িও থাকত। নানা রঙের প্যাড, রঙিন খাম পাওয়া যেত। ১৯৮৫ সালে কলকাতায় দেখেছি লোভনীয় সব রাইটিং প্যাড ও খাম। এ যুগের সন্তানেরা জানবে না চিঠির প্রতি মানুষের কী এক আকর্ষণ ছিল একসময়। মাধ্যমিক স্কুলে আমাদের বাংলা দ্বিতীয় পত্রে চিঠি লেখার একটি অধ্যায়ও ছিল।

স্কুলে অনুপস্থিত থাকলে এক আনা জরিমানা হতো এবং অসুস্থ হয়ে দীর্ঘদিন অনুপস্থিত থাকলে তখন প্রধান শিক্ষকের বরাবর চিঠি লেখার নিয়ম ছিল। টিফিনের পর আরবি ক্লাসে অনুপস্থিত থাকলে চার আনা জরিমানা হতো, এটি পেনাল্টি। মাস শেষে বেতন দেওয়ার সময় এসব জরিমানা ক্লাস টিচার আদায় করে নিতেন। তখন চিঠি লিখতে হতো। সহপাঠীরা এসে বলত, দোস্ত, চিঠি লেইখখা দে। খলিল স্যার তো তোরে পছন্দ করে, জরিমানা মাফ করাইয়া দিবি। আচ্ছা, তাহলে দেছি (তাৎক্ষণিকভাবে বরফের গুঁড়া দিয়ে তৈরি আইসক্রিম) খাওয়াতে হবে অথবা আচার কিংবা কুলফি বরফ। দেছির দাম দুই পয়সা (তিন পাই), দেছির মাথায় গোল চাক্কি অর্থাৎ ছাতা যুক্ত করলে এক আনা (ছয় পাই)। এরপর লাল সবুজ তরল স্যাকারিনযুক্ত রঙের স্প্রে! ‘পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কি রে হায়।’

চিঠি পেতে কার না ভালো লাগে। শৈশব–কৈশোরে মহল্লার পিয়নের সঙ্গে দেখা হলে সালাম দিয়ে বলতাম, আমার চিঠি আছে? তিনি সহাস্যবদনে ডানে–বাঁয়ে মাথা নাড়তেন, অর্থাৎ নেই। আমি হেসে বলতাম, ঠিক আছে, চিঠি নেই যখন, তাহলে আপনি নিজে লিখে খামে ভরে নিয়ে আসতেন! অবশেষে দুজনেই হাসতাম। এভাবে তাঁর সঙ্গে আমার সখ্য গড়ে ওঠে। তাঁর নাম আজ আর মনে নেই।

১৯৮০-৮২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে লাঞ্চের পর ক্লাস না থাকলে বাংলা সাহিত্যের রথী–মহারথীদের রচনাবলি নিয়ে বসেছি। কারোটা যেনো বাদ না পড়ে, সবার রচনাবলি থেকে পর্যায়ক্রমে চিঠি খুঁজে নিয়ে পড়েছি। বাংলার দিকপালদের চিঠি পড়তে পারাটাও ভাগ্য এবং আনন্দের ব্যাপার।

অন্নদাশঙ্কর রায় চিঠি প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘মনের সঙ্গে মনের ছোঁয়াছুঁয়ি।’ চিঠিরও যথেষ্ট সাহিত্যমূল্য রয়েছে। যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ছিন্নপত্র’, ‘রাশিয়ার চিঠি’। জওহরলাল নেহরুরও রয়েছে এ রকম একটি চিঠির বই। চিঠিও ছাপা হয়, কী মজার ব্যাপার! চিঠি ভাবনির্ভর। ভাবের ঘোরে বসে চিঠি লিখলেই তা সুখপাঠ্য হয়। আবেগ ও ভাবেরই অভাব সর্বত্র। সেই সঙ্গে রয়েছে প্রকাশ করার ক্ষমতা। চিঠি লিখতে গেলে সতর্ক হই, এই বুঝি আমি অপরের কাছে ধরা পড়ে যাচ্ছি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এক চিঠিতে বলেছেন, ‘আমরা দৈবক্রমে প্রকাশিত হই, ইচ্ছা করলে, চেষ্টা করলে প্রকাশিত হতে পারি নে। চব্বিশ ঘন্টা যাদের কাছে থাকি তাদের কাছেও আপনাকে ব্যক্ত করা সাধ্যের অতীত।’ শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে গড়া যে শিল্পরূপ, তারই নাম চিঠি।

বিয়ের পর ছয় মাস স্ত্রীকে চিঠি লিখেছি। সেসব চিঠি হারিয়ে যাওয়ার পর খুঁজে পেয়েছি। ৩০ বছরের পুরোনো চিঠিগুলো খুলে আর পড়া হয়নি। বন্ধু কবি রেজা ফারুককে দুই ডজন চিঠি লিখেছি নব্বইয়ের দশকে। রেজাকে ফোনে বললাম, চিঠিগুলো আমাকে পাঠিয়ে দাও। না, এগুলো তো তোমার প্রাপ্য না। আমার নিজের লেখা কবিতার পাণ্ডুলিপি হারিয়ে গেছে, স্ত্রী মারা গেছে। তারপরও আমি তোমার চিঠিগুলো ৩০ বছর যাবৎ যক্ষের ধনের মতো আগলে রেখেছি। ভাবলাম, এই দুজনকে লেখা চিঠিগুলো নিয়ে একসঙ্গে একটা বই প্রকাশ করলে কেমন হয়। মেয়ে বলল, বাবা, মায়ের চিঠিগুলো প্রাইভেট। তুমি এগুলো পাবলিশ করবে না। আচ্ছা, তোমার মায়ের লেখাগুলো প্রকাশ করব না। আমারটাই করব। কয়েক দিন পর রাতের খাবারের সময় মেয়ে বলল, বাবা, একটা চিঠি পড়ে শোনাও। পড়ার পর বলল, বাবা, দিজ ইজ আ পোয়েম। দৌড়ে গিয়ে সে তার ভাইকে ডাকছে, রৌদ্র, কাম কাম, বাবা রিডিং হিজ লাভ লেটার।

শব্দপ্রেমিক রেজা—

ইহজাগতিক জটিলতায় নিমগ্ন আমি

বৃষ্টিভেজা রাতে গলির পথ ধরে

বাড়ি ফিরছিলাম একা

আমার সম্মুখে হেঁটে যাচ্ছে এক ব্যক্তি

তার প্রতি দৃষ্টি পড়তেই

ছিঁড়ে যায় আমার মগ্নতা

চোখ মেলে দেখি

সে তো আমারই ছায়া।

আমি এগিয়ে যেতেই

সে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে

এগিয়ে যায় দ্রুত

আমি এগোলে অন্ধকারে

ডুবন্ত বাড়িটিও পিছন দিকে

সরে গিয়ে নক্ষত্রহীন আকাশে

থমকে দাঁড়ায়।

আমি আলতো করে কলিং বেলে

আঙুল রাখি

নিস্তব্ধতা টুকরো টুকরো হয়ে

ভেঙে পড়তেই সেই ছায়া

দরজার ওপাশ থেকে প্রশ্ন করে

কে, কাকে চান?

*১৯৯৩ সালে বন্ধু কবি রেজা ফারুককে লেখা আমার একটি চিঠি।